
ভ্রমণ মানে চাওয়া-পাওয়া,/ ভ্রমণ মানে জ্ঞান।/ ভ্রমণ মানে অজানারে/ জানতে চাওয়ার টান।/ ভ্রমণ মানে সঙ্গী-সাথি/ মানিয়ে নিয়ে চলা। ভ্রমণ মানে মনটি খুলে/ চারটি কথা বলা।/ খুশির ভাঁড়ার ভর্তি করে/ বয়স কমায় ভ্রমণ,/ বাচ্চা-বুড়ো ছেলে-মেয়ে/ এক হয়ে যায় মন।/ ভ্রমণ মানে কাজের ফাঁকে/একটু বিরতি,/ ভ্রমণ মানে সব ভুলে আজ/ একটু স্বস্তি।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সবাইকে ডাকাডাকি করে তুললাম। সমুদ্রের ধারে হাঁটতে যাব। সুকুমারদা ছাড়া কেউ আজ যেতে রাজি হল না। অগত্যা আমরা দু’ জনেই বেরিয়ে পড়লাম। বিচে হালকা কুয়াশা। দু’ জনে মিলে বিচের ধার দিয়ে নরম সকালে কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে বহু দূর হেঁটে গেলাম। জেলেরা সমুদ্র থেকে মাছ ধরে নৌকা নিয়ে ফিরেছে। কোনো কোনো নৌকা থেকে মাছ সরাসরি বিচে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাটাডোরে উঠছে। আবার কোথাও বিচে বড়ো প্লাস্টিক পেতে মাছ ঝাড়াইবাছাই চলছে। মাছের সঙ্গে স্কুইড, ছোট ছোটো হাঙ্গর, সাপ, জেলিফিস, কাঁকড়া – এ সবও উঠেছে।
প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে সমুদ্রকে সামনে রেখে দু’ জনে বালির উপর বসলাম। এ দিকটা একেবারেই নির্জন। আমরা দু’ জন ছাড়া কয়েকটা পাখি আছে অবশ্য, কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে রাজি নয়। ভারী দেমাক!
অনেকটা সময় কাটালাম সমুদ্রের কবিতা শুনে। অদ্ভুত এক মাদকতা আছে এই নিস্তব্ধতা ভরা একাকিত্বের। বসে থাকি সমুদ্রের দিকে চেয়ে। পিছন থেকে সুর্যদেব কড়া সুরে ধমক দেয়, “কটা বাজে খেয়াল আছে? আজ না তোমরা সাউথ গোয়া বেড়াতে যাবে?” অগত্যা দু’জনে উঠে পড়লাম। সমুদ্রকে বললাম, “চলো, আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।” সমুদ্রের সঙ্গে গল্প, হাসাহাসি, খুনসুটি করতে করতে পৌঁছে গেলাম হোটেলে।
ব্রেকফাস্ট সারছি এমন সময় আসিফ হাসিমুখে হাজির। কালকের মতো আজও লাঞ্চপ্যাক গাড়িতে উঠল। খাওয়া শেষ করে আমরাও গাড়িতে উঠলাম।
আজ হোটেলের সামনের দোকান থেকে একটা কালো রঙের পর্তুগিজ স্টাইলের টুপি কিনে সৈকত আমায় উপহার দিয়েছে। এই ভ্রমণে এ পর্যন্ত দলনেতা হিসাবে আমার সাফল্যের জন্য এই উপহার। সেই সঙ্গে আমার নতুন নামও দিয়েছে – পল ডিকস্টার। সৈকতের এই উপহারে আমি ভীষণ ভাবে আপ্লুত এবং সম্মানিত বোধ করেছি।

আজ প্রথমেই এলাম গোয়া চিত্র মিউজিয়ামে। টিকিট কাটার পর আমাদের স্বাগত জানিয়ে একজন হিন্দিভাষী গাইড আমাদের ভিতরে নিয়ে এল। নামে চিত্র মিউজিয়াম হলেও এর সঙ্গে ছবির কোনো সম্পর্ক নেই। পর্তুগিজ আমলে গোয়ার মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিল, এখানে বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের মাধ্যমে সেটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়াও রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক-সহ সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেরও কিছু দ্রষ্টব্য এখানে রাখা আছে। রয়েছে কলকাতার টানা রিকশাও।
২০১০ সালে ভিক্টর হুগো গোমস প্রায় একক প্রচেষ্টায় ২০০টি প্রদর্শিত বস্তু নিয়ে এই মিউজিয়ামটি স্থাপন করেন। এখানে এখন সব মিলে প্রায় চার হাজারেরও বেশি বস্তুর প্রদর্শনী হচ্ছে। তার মধ্যে আছে প্রাচীন যানবাহন, কৃষক, কর্মকার, কুম্ভকার, তাঁতি, স্বর্ণকার, ছুতোর প্রভৃতি সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাজের দ্রব্যসামগ্রী। এ ছাড়াও গেরস্থালির দ্রব্য, বিভিন্ন ধর্মীয় দ্রব্যও প্রদর্শিত হয়েছে।
প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে এই মিউজিয়াম ঘুরে দেখার পর আসিফের গাড়ি আমাদের পৌঁছে দিল অ্যাকোরিয়ামে। সুলতার শরীরটা খারাপ থাকায় সে গাড়িতেই রয়ে গেল। আমরা বাকিরা অ্যাকোরিয়াম আর ঘোস্ট হাউসের কম্বো টিকিট কেটে ঢুকে গেলাম।
সুন্দর করে সাজানো অ্যাকোরিয়াম। কপার মেটাল সার্ক, পিরানহা, স্টিং রে, বিভিন্ন প্রকার ইল, তারামাছ, লায়ন ফিশ, ব্ল্যাক ঘোস্ট ফিশ, লাকি ফিশ, চিংড়ি, কচ্ছপ, কার্পেট ফিশ প্রভৃতি বিভিন্ন রকম আকর্ষণীয় মাছের সম্ভার এখানে।
অ্যাকোরিয়ামের বাইরের দরজা দিয়ে বেরোতেই নাক ঘেঁষে খানিকটা জল পিচকিরির মতো ডান দিক থেকে বাঁ দিকে গিয়ে পড়ল। চমকে ডান দিকে তাকিয়ে দেখি একটা পুতুল বসানো। ওটার সামনে গেলেই ছিরিক করে খানিকটা জল বেরিয়ে আসে। বা রে বা! বরাতজোরে ভিজতে ভিজতে বেঁচে গেল সবাই।
নজরে পড়ল সামনেই একটা ভূত। ভূতের পিছনে ভূতুড়ে গাছ। না না আসল নয়, সব বড়ো বড়ো মডেল। আমরা এখন ভূতুড়ে বাড়িতে ঢুকতে চলেছি। রূপকে বাদ দিয়ে আমরা ছ’ জন। গেটকিপার তিন জন করে আমাদের দু’টো দলে ভাগ করে দিল। প্রথম দলে আমি, মৌসুমি আর সৈকত। রূপ আমাদের দলেই আছে। দ্বিতীয় দলে সুকুমারদা, বউদি আর সুপ্রিয়।
আমরাই প্রথম প্রবেশ করলাম। সামেই পর্দা ঢাকা দরজা। তার উপর মাথায় কালো কাপড় ঢাকা বুক পর্যন্ত কঙ্কাল। দু’হাতে দু’টো লাইট ধরে আছে। ঘরের মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠল, “ওয়েলকাম টু দ্য ঘোস্ট হাউস”।

কালো পর্দা সরিয়ে প্রথমে আমি, তার পর রূপকে নিয়ে মৌসুমি ও শেষে সৈকত ঢুকল। অন্ধকার ঘর। শুধু ডান দিকে একটা কফিন। কফিনের উপর হালকা আলো পড়েছে। কফিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ কফিন থেকে একটা কঙ্কাল উঠে বসল। ভূতুড়ে অট্টহাসিতে ঘর ভরে গেল।
রূপ চোখ বন্ধ করে তার মায়ের কোলে চেপে কাঁধে মাথা রেখে যাচ্ছে। কিছুটা দূরে একটা নীল নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। সেই আলো লক্ষ করে সাবধানে এগোচ্ছি। হঠাৎ একটা ক্যাচ করে আওয়াজ আর তার পরেই উপর থেকে আমার গায়ে চুলের ঝাপটা দিয়ে একটা মহিলার লাশ নীচের দিকে মাথা করে ঝুলে পড়ল। সেই সঙ্গে খিল খিল হাসি। কিছুক্ষণ দোল খেয়ে বাঁ দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল বডিটা। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।
কোনো কথা না বলে পকেট থেকে লাইটার বার করলাম। সেই আলোয় কয়েক পা এগোতেই সাদা কাপড় পরা একটা ডেডবডি ডান দিক থেকে ছিটকে এসে ছটফট করতে শুরু করল। ঘটনার আকস্মিকতায় কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম। তার পর বডিটা ডান হাত দিয়ে সরিয়ে চলার পথ পরিষ্কার করে এগিয়ে চললাম।
ওদিকে সুকুমার দা, বউদি আর সুপ্রিয় প্রবেশ করেছে। সামনেই কঙ্কাল দেখে সুপ্রিয়র আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম। সে ‘আমি যাব না’ বলে পিছন ফিরে পালিয়ে গেল। সুকুমারদাও সুপ্রিয়র পদাঙ্ক অনুসরণ করার জন্য সবে পিছন ফিরেছে, অমনি বউদি খপ করে সুকুমারদার হাত খানা চেপে ধরল। সুকুমারদা বাধ্য হয়ে রামনাম জপ করতে করতে সামনে এগিয়ে চলল। পিছনে পিছনে বউদি।
এদিকে সৈকত আমায় বলে চলেছে – “সুদীপ ফিরে চল। বাচ্চাটা ভয় পাবে।” বাচ্চাটা ভয় পেতে পারে এটা যেমন সত্যি, তেমনি ও নিজেও যে খুব ভয় পেয়েছে সেটাও সত্যি। কিন্তু আমার মনে হল, পিছনে যাওয়ার থেকে সামনে এগোনোই ভালো। কারণ মনে হচ্ছে আর একটু এগোলেই বাইরে বেরিয়ে যাব।
একটা ইউ টার্ন দিতেই একটা কদাকার মুখ আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এই অন্ধকার দমবন্ধ করা ঘরে এমন একটা মুখ সত্যিই ভয় লাগিয়ে দেয়। মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম তার পর এগিয়ে চললাম। দূর থেকে অট্টহাসি ভেসে আসছে।

শেষ পর্যন্ত একটা দরজার কাছে পৌঁছে গেলাম। দরজার ফাঁকফোঁকর দিয়ে আলো আসছে। হাতল ধরে টান দিলাম, খুলল না। আরও জোরে টানলাম। একটু নড়ল, কিন্তু খুলল না।
তবে কি এটা বেরোনোর দরজা নয়? চার পাশে এক বার চোখ বুলিয়ে নিলাম। নাঃ, এটাই বেরোনোর দরজা। আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য চেপে আটকানো আছে। এ বারে হাতল ধরে প্রচণ্ড জোরে একটা হ্যাঁচকা টান দিলাম। ভক করে খানিকটা তাজা হাওয়া আর একরাশ আলো প্রবেশ করল। খুলে গিয়েছে দরজা। আমরা বাইরে বেরিয়ে এসে বুক ভরে খানিকটা তাজা হাওয়া নিলাম।
বাইরে সুপ্রিয় দাঁড়িয়ে আছে। বলল, কেমন লাগল? খুব ভয়ংকর, এক কথায় বলল মৌসুমি। সৈকত বলল, এমন হবে জানলে আমি যেতাম না।
সুকুমারদারাও এ বার বেরোবে। দরজার কাছে গিয়ে ওদের হেল্প করা দরকার। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখি দরজা নড়ছে। সুকুমারদা হাতল ধরে টেনে খুলতে না পেরে দরজার ফাঁক দিয়ে আঙুলগুলো গলিয়ে দরজা ধরে টানছে। আমি বাইরে থেকে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।
বেরিয়ে এসেই দাদা রাগে ফেটে পড়ল বৌদির উপর। বৌদি খিল খিল করে সমানে হেসে চলেছে সুকুমারদার কথায়। তাতে আরও খেপে গেল সুকুমারদা। সৈকতও ভয় পেয়েছিল, তাই সুকুমারদার পক্ষ নিল। আমি হেসে বললাম, একটু বসে নিন। স্বাভাবিক হয়ে তার পর যাওয়া যাবে।
আর বসতে হবে না গাড়িতে চল, সুকুমারদা বলল। আমরা আবার সবাই আসিফের গাড়িতে। এক সময় পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। আসিফ গাড়ি থামিয়ে বলল, এই হল ডোনা পাওলা। (চলবে)