
আগের দিন অব্দি গৌড়ের ইতিকথা বলার চেষ্টা করেছি। এটা বলতেই হবে যে তথ্যের জন্য ইন্টারনেট ঘাঁটতে হয়েছে। যা পেয়েছি সেটাই কেটেছেঁটে আমার ভাষায় আপনাদের কাছে পেশ করেছি মাত্র। তাই এই লেখায় আমি প্রধানত পেশকারের ভূমিকা পালন করেছি, লেখকের ভূমিকা নয়।
গৌড়ের যেখানে কোতোয়ালি দরওয়াজা, সেটাই পাপাইবাবগঞ্জের সীমানা। সেখান দিয়েই সারে সারে লরি চলেছে প্রধানত স্টোনচিপস বোঝাই করে। আমরা সেখান থেকে যাব পাণ্ডুয়া। মালদহ শহরের গা ছুঁয়ে যেতে হবে অন্য দিকে। শহরের গায়ে ঢোকার পর পেটের হাতিটাকে অল্পবিস্তর শান্ত করার চেষ্টা। তার পর আবার চলা। চল্লিশ মিনিটের রাস্তা ঘণ্টা দেড় লেগে গেল বিশাল বপু জ্যামের সৌজন্যে। গাড়ির মধ্যে সবাই ঝিমন্ত।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের দেশে ১ / এলাম বড়ো সোনা মসজিদে
কোনো রকমে পৌঁছোলাম পাণ্ডুয়া। এখানে প্রধানত তিনটি মসজিদ দ্রষ্টব্য। কুতুবশাহী মসজিদ, একলাখি মসজিদ আর আদিনা মসজিদ।
প্রথমেই পৌঁছোলাম একলাখি মসজিদে। এটা যেমন পাণ্ডুয়া, তেমনি বর্ধমানের কাছেও একটা পাণ্ডুয়া আছে। আগে নাকি বর্ধমানের পাণ্ডুয়াকে বলা হত ছোটো পাণ্ডুয়া।

বাংলা, বিহার এবং ওড়িশার রাজধানী ছিল গৌড়। সে তো আগেও বলেছি। সেই সময় ছিল হিন্দু রাজত্বকাল। সেই রাজত্ব মুসলিমদের হাতে যায় সম্ভবত শশাঙ্কের শেষ দিকে, যখন বখতিয়ার খিলজি বাংলা দখল করতে থাকেন। বাংলার রাজত্ব চলে যায় দিল্লির হাতে। তখন পাণ্ডুয়ার নাম পৌন্ড্রবর্ধন। মুসলিম রাজত্বের সময় পৌন্ড্রবর্ধন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। এর নাম অপভ্রংশ হয়ে, হয়ে যায় পাণ্ডুয়া। আর মুসলিম সম্রাটরা তার আগে জুড়ে দেন হজরত। অর্থাৎ হুগলির পাণ্ডুয়া হল ছোটো পাণ্ডুয়া আর এটা হল হজরত পাণ্ডুয়া।
এর পর ইলিয়াস শাহ দিল্লি থেকে বাংলা ছিনিয়ে নেন, আর গৌড় থেকে রাজধানী উঠিয়ে নিয়ে চলে আসেন পাণ্ডুয়ায়। যদিও পরে রাজধানী আবার গৌড়ে চলে গিয়েছিল। এই সময়টাই পাণ্ডুয়ার স্বর্ণযুগ। অনেক মসজিদ আর সৌধ এখানে তৈরি হয়েছিল সেই সময়। তাই মনে করা যেতেই পারে এই তিনটি মিসজিদ ওই সময়েই তৈরি।
একলাখি মসজিদের নাম একলাখি কেন হল তা নিয়ে দু’টি মত আছে। এক লাখ টাকা খরচ হয়েছিল এই মসজিদ তৈরি করতে। আর একটি মত হল মসজিদ তৈরি করতে এক লক্ষ ইট লেগেছিল। কোনটা যে ঠিক জানি না। এখানে আছে জালালুদ্দিন শাহের সমাধি। পাশে স্ত্রী আর ছেলেরও সমাধি আছে। জালালুদ্দিন শাহ আসলে যদু। হিন্দু। মুসলিম হয়েছিলেন পরে। এ নিয়ে একটা গল্পও আছে।

গণেশ ছিলেন যদুর বাবা। তিনি গৌড়ের রাজা ছিলেন। এই সময়ে ইব্রাহিম শাহ গৌড় আক্রমণ করেন। গণেশ বুঝলেন এই যুদ্ধে জয় সম্ভব নয়। তাই ছেলে যদুকে রাজা করে, নিজে অবসর নেন। যদু বুদ্ধিমান ছিল। রাজা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বুঝলেন যে পিতা কেন তাঁকে সিংহাসনে বসালেন। সেই সময় সেখানে এক পীরবাবা ছিলেন। তাঁর নাম ছিল নুরকুতুব আলম। তিনিই কানে কানে যদুকে কিছু বললেন। একজন মুসলিম একজন হিন্দুর কানে কিছু বলছে। তাই দ্বিজগণ খেপে লাল। যদু ঝট করে মুসলিম হয়ে গেলেন। এর পর নুরকুতুব রাজদূত হয়ে যান ইব্রাহিমের কাছে এবং বুঝিয়ে বলেন সম-ধর্মের সঙ্গে যুদ্ধ করা ঠিক নয়। সেটা ইব্রাহিম মেনেও নিলেন আর পাণ্ডুয়া ছেড়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে চলে গেলেন। পাণ্ডুয়া নিরাপদ হল।
এ বার রাজা গণেশ আবার ছেলের জায়গায় রাজা হলেন আর ছেলে যদুকে ফের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। গল্প শোনা যায় একটু বিশাল সোনার গোরু বানানো হয়েছিল। যদু গোরুর মুখ দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে বেরিয়ে আসেন। ব্যাস। আবার হিন্দু হয়ে গেলেন।
কিন্তু ট্রাজেডি হল গণেশ মৃত্যুর আগে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে যান। তাঁর নাম ছিল মহেন্দ্র। এটা যদু মেনে নিতে পারেননি। তাই মহেন্দ্রকে পরাস্ত করে আবার পাণ্ডুয়ার সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে বসেই তিনি ফের মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন। যদু থেকে হয়ে যান জালালুদ্দিন শাহ।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের দেশে ২ / দাখিল দরওয়াজা, ফিরোজ মিনার, বাইশগজী দেওয়াল
এই একলাখি মসজিদের পর দেখলাম কুতুবশাহী মসজিদ। একলাখি মসজিদের কাছেই। এটার আর এক নাম সোনা মসজিদ। আমরা গৌড়ে বড় সোনা মসজিদ দেখেছি। তার মতোই এটারও চূড়া ছিল সোনা রঙের। এ ছাড়াও শুনলাম আরও একটা ছোটো সোনা মসজিদ আছে, যেটা এখন বাংলাদেশে। পীরবাবা নুরকুতুব আলমের স্মৃতির উদ্দেশে তাঁরই এক বংশধর কুতুবশাহী মসজিদ বানিয়েছিলেন। চারটি মিনার ছিল, যেটার একটাও আর নেই। দশটি গম্বুজের একটাও আর নেই। ভেঙে পড়ছে। কালের চাকা যত গড়াবে ততই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ইতিহাসের এই স্মৃতি। তবু আমরা ভাগ্যবান, যারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগেই দেখে নিলাম।
আরও এগিয়ে গেলাম। পৌঁছে গেলাম এই অঞ্চলের সব চেয়ে বড় আদিনা মসজিদে। সুলতান ইলিয়াস শাহের ছেলে সিকান্দার শাহ এই বিশাল আকারের মসজিদটি তৈরি করেন হিন্দু মন্দির ভেঙে। হিন্দু মন্দির ভেঙে যে তার থেকে অনেক টেরাকোটা এখানে কাজে লাগানো হয়েছে তার অনেক নিদর্শন এখানে দেখা যায়। যদিও কেউ কেউ বলেন এটা আদৌ মসজিদ নয়। এটা জৈন দেবতা আদিনাথের মন্দির।

জুম্মাবার মানে শুক্রবার। আদিনার ও মানে শুক্রবার, তবে এটা ফারসি শব্দ। মুঘলরা যেমন বিশাল মসজিদকে জুম্মা মসজিদ বলে, তেমনি এখানে আদিনা মসজিদ।
শোনা যায় জিতু সাঁওতাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে দলবল নিয়ে আদিনা দখল করেন। পরে পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হন জিতু। আদিনা খুঁটিয়ে দেখতে গেলে যে সময় লাগবে তাতে সন্দেহ নেই। অনেক বড়ো এই মসজিদ।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের দেশে ৩ / গৌড় দেখা শেষ করে পান্ডুয়ার পথে
কাছেই আদিনা মৃগদাব। সে দিকে গেলাম। শুনলাম সেখানে একটা জায়গা আছে, নাম সাতঘরা। সাতটি ভাঙাচোরা জঙ্গলাকীর্ণ ঘর। মাঝে একটু উঠোন, তার চারিদিকে জল। বেশ অ্যাডভেঞ্চারের জায়গা। সাপ-টাপ তো আছেই।
আমাদের পাণ্ডুয়া দেখা এখানেই শেষ। একদিনের প্রোগ্রামে পঁচাত্তর কিলোমিটার দূরে বৌদ্ধবিহার জগজীবনপুর দেখা সম্ভব হল না। (শেষ)
কী ভাবে যাবেন
ভারতের সব বড়ো শহরের সঙ্গেই মালদার ট্রেন যোগাযোগ আছে। কলকাতা থেকে মালদা যাওয়ার অজস্র ট্রেন। ছাড়ে হাওড়া, শিয়ালদহ আর কলকাতা স্টেশন থেকে। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in ।
সংক্ষিপ্ততম সড়কপথে কলকাতা থেকে মালদার দূরত্ব ৩৬০ কিমি। এই পথ বর্ধমান, ভাতার, খড়গ্রাম, রমাকান্তপুর, ফারাক্কা হয়ে। নিজেরা গাড়ি নিয়ে গেলে এই পথে যেতে পারেন।
কলকাতা থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে (পথ কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, ফারাক্কা হয়ে) নিয়মিত বাস চলে মালদার।
কোথায় থাকবেন
পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের টুরিস্ট লজ রয়েছে মালদায়। অনলাইন বুকিং www.wbtdcl.com । এ ছাড়া মালদায় অনেক বেসররকারি হোটেল, রিসর্ট রয়েছে। গুগলে ‘accommodation in malda’ সার্চ করলে এদের সন্ধান পেয়ে যাবেন। পেয়ে যাবেন এদের সম্পর্কে রিভিউও।
ছবি: লেখক