বর্ষায় চলুন মুম্বই থেকে শনি শিংনাপুর-শিরডি-নাসিক

a road trip from mumbai
সুদীপ মাইতি

মনে করুন পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উপর দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলেছেন আপনি। সঙ্গী চার-পাঁচ জন। চলেছেন মুম্বই থেকে, জাতীয় সড়ক বরাবর। পাশ দিয়ে চলেছে রেলপথ। এই সড়কপথে রয়েছে বেশ কিছু টানেলও।  আর রাস্তার দু’ ধারে যে দিকে তাকান সবুজ, সবুজ আর সবুজ বনরাশির মাখামাখি। কখনও দেখা মিলবে উপত্যকাভূমির। আবার এ-দিক ও-দিক ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে ছোটো ছোটো টিলা বা পাহাড়। কখনও কখনও লেকেরও দেখা মিলবে।

আরও মনে করুন, প্রকৃতি এ সময় কখনও ঝিরঝিরে, কখনও বা মুষলধারে বারিবর্ষণ করে চলেছে। তা হলে এই বৃষ্টির মধ্যেই আপনি পেয়ে যাচ্ছেন দু’-চারটি পাহাড়ি ঝরনাও। ইচ্ছে হবে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে, সবাইকে নিয়ে প্রকৃতির কোলে ঝরনার জলে অবগাহন করতে। আর এই পথ চলার সময় আপনার গাড়ি থেকে যদি ভেসে আসে ‘রিমঝিম ঘিরে শাওন, সুলগ সুলগ যায় মন’, বা ‘জিন্দেগি আউর কুছ ভি নেহি, তেরি মেরি  কহানি হ্যায়’, তা হলে কেমন লাগে?

হাঁ, আমিও অভিভূত হয়ে থেকেছিলাম দু’ দিন, যার রেশ থেকে যাবে আজীবন। এক শনিবার সকাল সকাল  চার বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়েছিলাম মুম্বই থেকে, উদ্দেশ্য শনি শিংনাপুর, শিরডি, নাসিক এবং ত্র্যম্বকেশ্বর দর্শন। যে সব জায়গার উল্লেখ করলাম তা সবই মহারাষ্ট্রে। এবং  এগুলি সবই  ইতিহাস বা পুরাণপ্রসিদ্ধ।

আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল শনি শিংনাপুর। পথ লোনাভলা-তালেগাঁও-শিরুর-আহমেদনগর হয়ে, দূরত্ব ২৯২ কিমি। আওরঙ্গাবাদ থেকে এর দূরত্ব ৮১ কিমি। এখানে খোলা আকাশের নীচে রয়েছে একটি কালো শনিমূর্তি। কথিত আছে এই শনিমূর্তিটি মাটি থেকে আপনাআপনিই উঠে এসেছে। তাই প্রথম থেকেই এটি জাগ্রত মূর্তি বলে মনে করেন মানুষজন। এবং এটি এতটাই জাগ্রত যে এই গ্রামে কোনো চুরি হয় না। ফলে কোনো বাড়িতেই দরজা নেই বা দরজায় তালাচাবির লাগানোর ব্যাপার নেই। তবে ইদানীং দু’-একটি চুরির ঘটনার পর মানুষের সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। এ দিকে চারশো বছরের পুরোনো প্রথা ভেঙে মেয়েদের জন্য শনি শিংনাপুর মন্দিরের দরজা খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ হেন মন্দির দর্শনের ইচ্ছা আজ পূরণ হল।

শনি শিংনাপুর থেকে আমরা চললাম শিরডির পথে। ৭৪ কিমি রাস্তা। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে পৌছে গেলাম। দেশের অন্যতম একটি পুণ্যস্থান হল শিরডি সাইবাবা মন্দির। এটি মুম্বই থেকে প্রায় ২৩৮ কিমি দূরে। উনিশ-বিশ শতকের  এক ধর্মগুরু, যোগী ও ফকির হলেন সাইবাবা। হিন্দু ও মুসলিম, উভয় সম্প্রদায়ের ভক্তরাই তাঁকে সন্ত আখ্যা দিয়েছিলেন। ষোলো বছর বয়স থেকে ১৯১৮ সালে তাঁর মৃত্যুদিন অবধি এই শিরডিতে তিনি কাটিয়েছেন। শিরডিতে আসার পর তাঁকে ‘সাই’ নাম দেওয়া হয়। সংস্কৃতে ‘সাই’ শব্দটির অর্থ ‘সাক্ষাৎ ঈশ্বর’ বা ‘দিব্য’। অর্থাৎ সাইবাবা নামের অর্থ ‘দিব্য পিতা’ বাঁ ‘পিতৃরূপী সন্ত’। সাইবাবার পূর্বাশ্রমের কথা কিছু জানা যায় না। গরিব ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের  জন্য তাঁর কাজের কথা ছড়িয়ে রয়েছে সারা শিরডি জুড়ে। দেশ এবং বিদেশ থেকেও হাজার হাজার  ভক্ত  প্রতিদিন এখানে ভিড় জমান। সাইবাবা দর্শনের জন্য আপনাকে মোটামুটি ঘণ্টা তিনেক সময় হাতে রাখতে হবে।

শিরডিতে রাত্রিবাস করে পরের দিন সকালে আবার পথে। মাঝে মাঝেই চলছে বৃষ্টি। প্রকৃতি সবুজ থেকে আরও সবুজ হচ্ছে। ভিজছে আশেপাশের টিলা-পাহাড়। আজ আমাদের গন্তব্য নাসিক। আপনি রামরাজত্বে ফিরতে চাইলে আপনাকে নাসিকে যেতেই হবে। পুরাণমতে, লক্ষ্মণ এখানেই সুপর্নখার নাক কেটে দিয়েছিল, তাই এই জায়গার নাম নাসিক। আর এখানেই রয়েছে সেই গোদাবরী নদী, যার তীরে পুরাণের সেই তপোবন, পঞ্চবটী। মনে পড়ে যায় মাইকেল মধুসূদনের দু’ কলি – ‘ছিনু মোরা, সুলোচনে, গোদাবরী-তীরে, কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ-চূড়ে বাঁধি নীড়, থাকে সুখে; ছিনু ঘোর বনে, নাম পঞ্চবটী, মর্ত্ত্যে সুর-বন-সম’। এই পঞ্চবটী থেকেই সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় উড়িয়ে নিয়ে যায় রাবণ। যার পরেই ঘটে লঙ্কাকাণ্ড। আবার এই নাসিকেই ছত্রপতি শিবাজি অনেক দিন শাসন চালিয়েছেন। তাই এই জায়গাকে বলা হয়, ‘ল্যান্ড অব ব্রেভ’। আর এখানেই প্রতি বারো বছর অন্তর বসে পূর্ণকুম্ভ মেলা। তাই প্রতিটি ভারতবাসীর কাছেই নাসিকের একটা আকর্ষণ রয়েছে, মুম্বই থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১৭০ কিমি।

আরও পড়ুন পুজোয় চলুন: গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ ২

নাসিক দর্শন শেষে পৌঁছে গেলাম ত্র্যম্বকেশ্বরে, দূরত্ব প্রায় ৩০ কিমি । ভারতে বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম ত্র্যম্বকেশ্বর। কথিত আছে এখানে শিবের আবির্ভাব হয়েছিল। সবুজে ভরা পাহাড়ের কোলে এই গ্রামের মনোরম পরিবেশ খুবই আকর্ষণীয়। এখানকার ব্রহ্মগিরি পাহাড় থেকেই গোদাবরী নদীর সৃষ্টি।  এই জ্যোতির্লিঙ্গে দর্শন করতে আপনাকে ঘণ্টা দুয়েক সময় হাতে রাখতেই হবে। তবে বিশেষ প্রণামীর ব্যবস্থা করতে পারলে সময় অনেকটা কমে যাবে। ত্র্যম্বকেশ্বর দেখে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে এলাম মুম্বইয়ের ডেরায়।  

গোয়া বেড়াতে এসে অনেকেই মুম্বই ঘুরে যান  দু’ দিনের জন্য। তাঁরা যদি দু’দিন এ ভাবে শনি শিংনাপুর, শিরডি, নাসিক এবং ত্র্যম্বকেশ্বর ঘুরে আসেন তা হলে পুণ্যভূমি দর্শনের পাশাপাশি প্রকৃতিদর্শনও যে আপনাকে এক অন্য তৃপ্তিতে ভরিয়ে দেবে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

কী ভাবে যাবেন

সব চেয়ে ভালো হয় মুম্বই থেকে গাড়িতে যাওয়া। কারণ এই পথও দর্শনীয়। বিশেষ করে বর্ষায় এই পথের রূপ ভোলার নয়। তবে অন্য ভাবেও যাওয়া যায়। মুম্বই থেকে আহমেদনগর যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে আধ ঘণ্টা অন্তর। আহমেদনগর থেকে ৩৯ কিমি শনি শিংনাপুর, ট্যাক্সি বা বাস পাওয়া যাবে। শনি শিংনাপুরের কাছের স্টেশন রহুরি, ২৮ কিমি। মুম্বই থেকে রহুরি যাওয়ার একমাত্র ট্রেন সিএসটি থেকে রাত ১০.৫৫-এর শিরডি ফাস্ট প্যাসেঞ্জার। রহুরি পৌঁছোয় সকাল ৮.৪৯-এ। রহুরির আগের স্টেশন আহমেদনগর। এখানে নেমেও শনি শিংনাপুর চলে যেতে পারেন। ট্রেনে বা বাসে মুম্বই থেকে পুনে এসে, সেখান থেকেও ট্রেনে রহুরি যেতে পারেন। শনি শিংনাপুর থেকে শিরডি আসার বাস খুব কম থাকায়, গাড়ি ভাড়া করে চলে আসাই ভালো। শিরডি থেকে নাসিক আসার জন্য বাস পাওয়া যায়। শেয়ার ট্যাক্সিতেও আসা যায়। একটি সরাসরি ট্রেন আছে সপ্তাহে তিন দিন (মঙ্গল, বৃহস্পতি ও রবি), সাইনগর-দাদার এক্সপ্রেস। সাইনগর ছাড়ে রাত ১০.২৫-এ, নাসিক পৌঁছোয় রাত ১২.৫৭ মিনিটে। নাসিক থেকে ত্র্যম্বকেশ্বর চলুন বাস বা ট্যাক্সি করে। নাসিক থেকে মুম্বই ফেরার প্রচুর বাস বা ট্রেন পাবেন। ট্রেনের বিস্তারিত সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in ।

কোথায় থাকবেন

সর্বত্রই থাকার জন্য হোটেল আছে। তীর্থস্থান বলে সব জায়গাতেই ধর্মশালা, মন্দিরের অতিথিশালা আছে। শনি শিংনাপুরে শ্রী শনেশ্বর দেবস্থান ট্রাস্টের ধর্মশালা আছে। বিস্তারিত জানতে দেখুন http://www.shanidev.com । শিরডিতে শ্রী সাইবাবা সংস্থান ট্রাস্টের অতিথিশালা, বিস্তারিত জানতে দেখুন https://www.sai.org.in । ত্র্যম্বকেশ্বরে রয়েছে শ্রী ত্র্যম্বকেশ্বর দেবস্থান ট্রাস্টের ধর্মশালা, বিস্তারিত জানতে দেখুন www.trimbakeshwartrust.com/। নাসিকে ধর্মশালা ও সব জায়গায় বেসরকারি হোটেলের জন্য দেখুন www.booking.com ,  www.makemytrip.com ,  www.yatra.com ,  www.trivago.in ,  www.airbnb.co.in ,  www.tripsavvy.com  ইত্যাদি ওয়েবসাইট।     

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *