কলকাতা দর্শন: দেখে আসুন ‘রাজ-এর তাজ’ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল

ভ্রমণঅনলাইন ডেস্ক: কলকাতা মহানগরীর বহু দ্রষ্টব্যের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। তেমনই একটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। ব্রিটিশ ভারতে রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে তৈরি হয়েছিল এই স্মারক। করোনাভাইরাস সংক্রমণের জেরে দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হতেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ১০ নভেম্বর এই স্মৃতিসৌধ আবার খুলেছে।

ইতিহাস

ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় এ রকম একটি চোখধাঁধানো স্মৃতিসৌধ নির্মাণের চিন্তা প্রথম মাথায় আসে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের। ভারতে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনকালকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কার্জন এর পরিকল্পনা করেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর রানি ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনকর্তা হন। আমৃত্যু তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন, ১৯০১ সালে তিনি মারা যান। কার্জন চেয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়াকে উৎসর্গ করা এই সৌধটি হবে বিশাল প্রশস্ত রাজকীয় এবং থাকবে একটি মনোরম উদ্যান। ১৯০৬ সালে সৌধের শিলান্যাস করেছিলেন প্রিন্স অফ ওয়েলস পঞ্চম জর্জ। ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া আইন অনুসারে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে জাতীয় গুরুত্বের প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

স্থাপত্য

৫৭ একর জমির উপর তৈরি এই শ্রদ্ধাজাগানো অনন্য সৌধটির নকশা করেন রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেকচার–এর প্রেসিডেন্ট স্যার উইলিয়াম এমারসন। ইন্দো-ব্রিটিশ স্থাপত্যের সব চেয়ে সুন্দর নিদর্শন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। এই স্মৃতিসৌধকে ‘রাজ-এর তাজ’ নামে অভিহিত করা হয় অর্থাৎ ব্রিটিশরাজের আমলে তৈরি তাজমহল। ইন্দো-স্যার‍্যাসেনিক শৈলীতে তৈরি এই সৌধে রয়েছে মিশরীয়, ভেনেশীয়, মুঘল ও অন্যান্য ইসলামি শৈলীর ছোঁয়া। শিল্পকলার সম্পূর্ণ চারটি বিপরীত ক্ষেত্র, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা এবং উদ্যানশিল্পের নজিরবিহীন মেলবন্ধন ঘটেছে এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। ১৮৪ ফুট উঁচু এই সৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল মকরনার শ্বেতপাথর দিয়ে। রাজস্থানের জোধপুর থেকে এই পাথর নিয়ে আসা হয়েছিল।

উদ্যান

ব্রোঞ্জের সিংহাসনে উপবিষ্ট রানি ভিক্টোরিয়ার ব্রোঞ্জ মূর্তি।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উদ্যানে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। মেমোরিয়ালে প্রবেশের মুখেই রয়েছে ব্রোঞ্জের সিংহাসনে উপবিষ্ট রানি ভিক্টোরিয়ার ব্রোঞ্জ মূর্তি। উদ্যানে ঘুরলে দেখতে পাবেন সপ্তম এডোয়ার্ড, লর্ড কার্জন, লর্ড হেস্টিংস এবং লর্ড ডালহৌসির মূর্তি। রূপক বর্ণনা করা হয়েছে এমন প্রচুর ভাস্কর্য রয়েছে এই উদ্যানে, যেমন – মাতৃত্ব, স্থাপত্য, বিচার, শিক্ষা ইত্যাদি।

গ্যালারি ও প্রদর্শিত বস্তু

মিউজিয়ামের ৯টি গ্যালারিতে ২৮৩৯৪টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। এই সব শিল্পকর্মে ধরা হয়েছে আমাদের জাতির তিন শতকের বেশি সময়ের ইতিহাস, যার শুরু ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে। এই সব শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে তেলরঙ ও জলরঙে আঁকা চিত্রকলা, স্কেচ ও পেন্সিল ড্রয়িং, লিথোগ্রাফ, আলোকচিত্র, তাম্রফলকে খোদাই, বিরল গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি, স্ট্যাম্প ও ডাক বিভাগের নানা স্টেশনারি, মুদ্রা ও পদক, অস্ত্রশস্ত্র, ভাস্কর্য, কস্টিউমস, ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন এবং সংরক্ষণযোগ্য দলিলপত্র।

জোহান জোফানি, জোশুয়া রেনোল্ডস, উইলিয়াম হজেস, জর্জ চিনারি, রবার্ট হোলমস, টমাস হিকি, টিলি কেট্‌ল, বালৎজার সোলভিনস, চার্লস ডি ওলি, এমিলি ইডেন, জন ফ্লেমিং এবং স্যামুয়েল ডেভিসের মতো অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের নামকরা শিল্পীদের চিত্রকলার সংগ্রহ রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মিউজিয়ামে। বিখ্যাত কাকা-ভাইপো শিল্পীজুটি টমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েলের চিত্রকলার সব চেয়ে বেশি সংগ্রহ রয়েছে এই মিউজিয়ামে। একটিমাত্র ক্যানভাসে আঁকা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম চিত্রকলা রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহে। এটি রুশ শিল্পী ভাসালি ভেরেস্তশাগিনস-এর আঁকা। ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস-এর জয়পুর আগমন উপলক্ষ্যে যে মিছিল হয়, সেই মিছিলই এই চিত্রকলার বিষয়বস্তু।

রাতের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ছবি পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের সৌজন্যে।

এ ছাড়াও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহে রয়েছে ফারসি ভাষায় লেখা নানা পাণ্ডুলিপি – যেমন, সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে লেখা সচিত্র কোরান, আবুল ফৈজ ফৈজির করা নল-দময়ন্তী কাহিনির অনুবাদ, দারাশিকোর করা উপনিষদের অনুবাদ, আইন-ই আকবরি ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে টিপু সুলতানের ব্যক্তিগত ডায়েরি, পলাশির যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান ও কামানের গোলা,  মহারাজ রণজিৎ সিংয়ের ব্যক্তিগত তলোয়ার, তাঁতিয়া টোপির ওভারকোট ইত্যাদি।      

ইদানীং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহ আরও সমৃদ্ধ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, যামিনী রায়-সহ বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের বিভিন্ন শিল্পীর প্রায় ৫০০ শিল্পকলা রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির কাছ থেকে আসায়।  

৯টি গ্যালারিতে এই সব শিল্পকলা প্রদর্শিত হচ্ছে –

দ্য রয়্যাল গ্যালারি, এনট্রান্স হল, পোর্ট্রেট গ্যালারি, দ্য কুইন্‌স হল, দ্য প্রিন্স হল, ন্যাশনাল লিডার্স গ্যালারি, ইন্ডিয়ানস স্কুল্‌স অফ আর্ট, ক্যালকাটা গ্যালারি এবং দরবার হল।

দর্শনের সময়

গ্যালারিতে প্রবেশের সময়

সোমবার ও জাতীয় ছুটির দিন ছাড়া অন্যান্য দিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা।

উদ্যানে প্রবেশের সময়

প্রতি দিন সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা। কোনো দিন বন্ধ নয়।  

গোধূলির আলোয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।

টিকিটের হার

গ্যালারিতে প্রবেশের জন্য

ভারতীয়দের ক্ষেত্রে জনপ্রতি ২০ টাকা, বিদেশিদের জন্য জনপ্রতি ২০০ টাকা। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের (স্কুল ইউনিফর্ম পরা থাকতে হবে) এবং সেনাকর্মীরা বিনা টিকিটে প্রবেশ করতে পারবেন।

উদ্যানে প্রবেশের জন্য

ভারতীয়দের ক্ষেত্রে মাথাপিছু ২০ টাকা। ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সিদের জন্য বার্ষিক ১০০০ টাকা এবং অন্যদের ক্ষেত্রে বার্ষিক ২০০০ টাকা।

টিকিট কাউন্টার খোলা থাকে বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত। কাউন্টার থেকে টিকিট কেনা ছাড়া অনলাইনেও টিকিট কেনা যায় http://www.victoriamemorial-cal.org/ থেকে।  

করোনাবিধি

৫০০ জনের বেশি দর্শনার্থীকে উদ্যানে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না আর মিউজিয়ামে সর্বাধিক ২০০ দর্শনার্থী প্রবেশ করতে পারবেন।  

মাস্ক ছাড়া মিউজিয়ামে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলতে হবে। দর্শনার্থীদের স্যানিটাইজ করা হবে এবং থার্মাল স্ক্রিনিং করে ঢোকানো হবে।    

কিছু পরামর্শ

মূল ভবনের ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ।

যাঁরা শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উদ্যানে ঘুরে বেড়াতে চান, তাঁদের জন্য আলাদা টিকিটের ব্যবস্থা আছে। টিকিট কাউন্টারে খোঁজ করলেই বলে দেবে।

অতিরিক্ত আকর্ষণ

ঘোড়ার গাড়ি চেপে ময়দান ঘুরে নিতে পারেন।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উত্তর দিকে মূল ফটকের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে অনেক সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। আপনাকে কলকাতার ময়দান এলাকায় জয়রাইড করানোর জন্য তারা প্রস্তুত। ঘোড়ার গাড়ি চেপে ময়দান ঘুরে নিতে পারেন, একটা অন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পাবেন। এক সময়ে এই ঘোড়ার গাড়িই ছিল ‘সিটি অফ জয়’-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন। বেশ কয়েক দশক আগে মহানগরীতে ঘোড়ার গাড়ির যাত্রা কেমন ছিল তা অনুভব করতে একটা জয়রাইড করে নিতেই পারেন।

আরও পড়ুন: কলকাতা দর্শন: দেখে আসুন সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *