বাগবাজারের নব বৃন্দাবন মন্দির ও মদনমোহন মন্দিরে অন্নকূট উৎসব

অনুসূয়া ঘোষ

কার্তিক মাসের শুক্লাপ্রতিপদে দেশ জুড়ে পালিত হয় অন্নকূট উৎসব। এ বার ওই তিথি পড়েছিল ২৬ অক্টোবর। ওই দিন বিভিন্ন মন্দিরের পাশাপাশি বাগবাজারের দু’টি মন্দিরেও পালিত হল অন্নকূট উৎসব। এই পুজোয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভোগ নিবেদন করা হয়।

বাগবাজারের কড়ুই পরিবারের প্রতিষ্ঠিত নব বৃন্দাবন মন্দিরের অন্নকূট উৎসব এ বার ৮২ বছরে পড়ল। সেখানে তিনশো রকমেরও বেশি ভোগ নিবেদন করা হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণকে। বিশেষ এই দিনে মন্দিরে ভিড় করেছিলেন অসংখ্য ভক্ত।

‘অন্নকূট’ – অন্ন মানে ভাত আর কূট মানে পর্বত। অন্নের পর্বতের ওপর বিরাজ করেন শ্রীকৃষ্ণ। 

পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, কার্তিক অমাবস্যার মহাপ্রলয়ের রাতে ব্রজবাসীকে রক্ষা করেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ব্রজবাসী বিভিন্ন রকম খাবার রান্না করে নিবেদন করেন শ্রীকৃষ্ণকে। সেই থেকেই এই উৎসবের শুরু।

তিনশো রকম ভোগের আয়োজন নব বৃন্দাবন মন্দিরে।

এই একই দিনে বাগবাজারের আর-এক ঐতিহাসিক মন্দিরেও মহাসমারোহে পালিত হল অন্নকূট উৎসব।

বাগবাজারের রবীন্দ্র সরণিতে রয়েছে রাধা মদনমোহন মন্দির। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গোকুলচন্দ্র মিত্র। তাঁর বাবা সীতারাম মিত্র আদিতে ছিলেন হাওড়ার বাসিন্দা। কলকাতায় লবণ ব্যবসা করে শহরের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন গোকুলচন্দ্র। তাঁর অচল বিশ্বাস ছিল মদনমোহনের উপর। বিশ্বাস করতেন, বিষ্ণুপুর থেকে আনা মদনমোহনের বিগ্ৰহই তাঁর ভাগ্য খুলে দিয়েছিল।

এই মদনমোহনের বিগ্ৰহটি প্রথমে গোকুলচন্দ্র মিত্রের কাছে ছিল না। বিষ্ণুপুরের মহারাজ বীর হাম্বির একবার এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই ছিল মদনমোহনের এই বিগ্ৰহটি। ভগবানের এই মূর্তিটি দেখে রাজা মুগ্ধ হয়ে যান। ওই মূর্তি দেওয়ার জন্য সেই ব্রাহ্মণকে তিনি অনুরোধ করেন। তার জন্য  অর্থ ব্যয় করতেও রাজি ছিলেন রাজা। কিন্তু ব্রাহ্মণ রাজি হননি। তখন রাজা তাঁকে না বলেই মূর্তিটি নিয়ে চলে যান। মূর্তিটি বিষ্ণুপুরের রাজবাড়ির লক্ষ্মীগৃহে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

যেখানে ভক্তি আর আবেগ মিলেমিশে একাকার। মদনমোহন মন্দির।

তার পর ১৬৯৪ সালে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ বিষ্ণুপুরে মদনমোহন মন্দির স্থাপন করেন।  সেখানেই মদনমোহনের বিগ্ৰহটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওই মন্দির ছিল ইষ্টকনির্মিত একরত্নবিশিষ্ট। মন্দিরটির ছাদ চৌকো ও বাঁকানো, কিনারা বাঁকযুক্ত ও মধ্যে গম্বুজাকৃতি শীর্ষ ছিল। মন্দিরের দেওয়ালে কৃষ্ণলীলা, দশাবতার ও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনির বিভিন্ন দৃশ্য ভাস্কর্যের মাধ্যমে রূপায়িত ছিল।

তবে বিষ্ণুপুরে বেশি দিন স্থায়ী হননি মদনমোহন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ তাঁর পরিবারের সদস্য দামোদর সিংহের সঙ্গে সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় জড়িয়ে পড়েন। এই মামলার খরচ চালাতে ঋণগ্ৰস্ত হয়ে পড়েন রাজা। তাই বাধ্য হয়েই মদনমোহনের মুর্তিটিকে কলকাতার নুন ব্যবসায়ী গোকুলচন্দ্র মিত্রের কাছে বন্ধক রাখতে হয়েছিল। পরে অবশ্য আবার তিন লক্ষ টাকা নিয়ে বিগ্ৰহটি গোকুল মিত্রের থেকে আনতে গিয়েছিলেন বিষ্ণুপুরের মহারানি। কিন্তু তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গোকুলচন্দ্র। শোনা যায়, গোকুলচন্দ্র মিত্র হুবহু একই রকম দেখতে একটি মূর্তি তৈরি করিয়েছিলেন। আসল মূর্তিটি নিজের কাছে রেখে বিষ্ণুপুরের রাজাকে নতুন তৈরি মূর্তিটি দিয়েছিলেন তিনি।

অন্ন পাওয়ার অপেক্ষায়। মদনমোহন মন্দির।

গোকুল মিত্রের ঠাকুরবাড়িতে আজও পূজিত হন মদনমোহন। সেখানেই রয়েছে আসল মূর্তিটি। প্রায় দেড় বিঘা জমির ওপর অবস্থিত এই ঠাকুরবাড়িতে রয়েছে একটি চাঁদনি আকৃতির নাটমন্দির। শহরে এই ধরনের নাটমন্দির প্রায় নেই বললেই চলে। নাটমন্দিরে রয়েছে একটি বিরাট হলঘর যেখানে অধিষ্ঠিত মদনমোহন, রাধিকা ও তার দুই সখী। বৈষ্ণবদের জন্যে খুবই পবিত্র এই ঠাকুরবাড়ি।

প্রত্যেক বছর দোল, রাধাষ্টমী, রাসযাত্রা, ঝুলন, অন্নকূট উৎসব পালন করতে মদনমোহনের ভক্তরা আসেন এখানে। বিশেষ করে অন্নকূট উৎসবের সময় মদনমোহন ও রাধিকার অন্নভোগ ছোড়া হয় ভক্তদের দিকে। এই সময় ভিড় জমে যায় ঠাকুরবাড়ির সামনে। এ ছাড়া প্রত্যেক দিন সকাল সাতটা থেকে বেলা বারোটা ও বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ভক্তরা মদনমোহনকে দর্শন করার সুযোগ পান।

ছবি: দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, প্রথম ছবিটি নব বৃন্দাবন মন্দিরে আরতির

আরও পড়তে পারেন

সোনায় মুড়ল কেদারনাথ মন্দিরের গর্ভগৃহ, সাজানো হল সাড়ে পাঁচশো পাতে

নভেম্বরে কাশ্মীরে জাফরান উৎসব, শিকারা উৎসব, প্রস্তুতি তুঙ্গে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *