দ্য গ্রেট গোয়া ৬ / সেরা সৈকত পালোলেমে

স্বপ্ন পাল

সময়মতো গাড়ি নিয়ে আসিফ হাজির। আমরাও তৈরি। আজ আর লাঞ্চ প্যাকের দরকার নেই, বদলে রয়েছে প্রাতরাশের প্যাকেট। আজকের লাঞ্চ হবে স্পাইস গার্ডেনে। ওখানে টিকিটের সঙ্গেই লাঞ্চের দাম ধরা থাকে।

কিছুক্ষণ পরেই আসিফ এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বলল, এটা বেনোলিম বিচ। আপনারা যেখানে আছেন সেই কোলভার পাশের বিচ। চট করে ঘুরে আসুন। এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম একটু ঘুরিয়ে দিই।

হই হই করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। পুরীর মতোই আলগা বালি, ন্যাড়া বিচ। এ-দিক ও-দিক কিছু ফোটো তুলে গাড়িতে ফিরে এলাম।

পাহাড়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলেছে। আঁকা-বাঁকা চওড়া রাস্তা, শিশুর গালের মতো মসৃণ। চারি দিকে সবুজ, সবুজ আর সবুজ। পাহাড়ের সবুজ আর সমতলের সবুজের মধ্যে কোথাও যেন একটা পার্থক্য আছে। পাহাড়ি সবুজ মনকে আরও বেশি তাজা করে তোলে। নিজেকে আরও বেশি প্রাণবন্ত লাগে। এরই মাঝে আমাদের প্রাতরাশ চলছে।

প্যাললেমের কাছে গণেশ গাছ।

এক সময় আসিফ গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, বাঁ দিকে দেখুন, গাছের মধ্যে গনেশ।

হ্যাঁ… তাই তো! একটা চালার নীচে ফুল-মালা পড়ে, একটা মরা গাছ দাঁড়িয়ে আছে। সেটার কাণ্ডের উপর তিনটে ডাল। দু’টো দু’পাশ থেকে উপর দিকে উঠে গিয়েছে এবং মাঝেরটা অদ্ভুত ভাবে নীচের দিকে নেমে এসেছে। শুঁড়ের দু’পাশে কপালের নীচে দু’টো চোখও লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। গোটা দুই ফটো তুলে ফের যাত্রা। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ পালোলেমে।

অদ্ভুত রকম সুন্দর বিচ। দু’দিকে সবুজ পাহাড়, পায়ের নীচে জমাট বালি আর সামনে মেরিন ব্লু সমুদ্র। বিচে মানুষ আছে, কিন্তু কোলাহল নেই। গোয়ার অন্য সব বিচের মতোই এখানেও ঢেউয়ের কোন দাপট নেই। ছোটো ছোটো ঢেউগুলোর উচ্চতা এক-দেড় ফুটের বেশি হবে না।

পালোলেমে খাঁড়ি।

আসিফের মধ্যস্থতায় তারই পরিচিত এক নৌকাওলার সঙ্গে ২৫০০ টাকায় ব্যাকওয়াটার যাওয়ার চুক্তি হল। ওখানে নাকি এখন ২৮০০ টাকা করে রেট যাচ্ছে। মাঝির সঙ্গে বিচ বরাবর ডান দিকে হাঁটা শুরু করলাম। পূর্ণ মাত্রায় ক্যামেরার ব্যবহার চলছে। এই বিচেও প্রচুর বিদেশি আছে। তারাও আমার লেন্সে ধরা দিচ্ছে।

বিদেশিনির রৌদ্রস্নান।

আমরা নৌকার কাছে এসে গিয়েছি। নৌকাটা বিচের একদম শেষ প্রান্তে রাখা আছে। এখানকার নৌকাগুলোর নীচেটা একদম ছুঁচলো। তাই একে সোজা করে দাঁড় করানোর জন্য শক্তপোক্ত বিশাল একটা স্ট্যান্ড লাগানো থাকে। আমরা সবাই নৌকায় উঠলাম। যে আমাদের নিয়ে এসেছে সে আবার অন্য মাঝিকে ভিড়িয়ে দিল আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য।

পানকৌড়ি।

অগভীর জলে কখনও লগা দিয়ে ঠেলে ঠেলে নৌকা নিয়ে যেতে হচ্ছে, আবার কখনও দাঁড় বেয়ে নৌকা চালাতে হচ্ছে। চার পাশে সবুজ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই জঙ্গলের মধ্যে থেকে ঘোমটা দেওয়া বউয়ের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে। না বলা ভুল হল, এখানে মনুষ্যসৃষ্ট কোনো শব্দ নেই। যা আছে তা হল পাখির কলতান। প্রকৃতির বরদান। কখনও কখনও দু’পাশের জঙ্গলের ভিতর থেকে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ভেসে আসছে এই দিনেরবেলাতেও। ঝিঁঝিঁপোকা আর পাখিদের যেন এক অপার্থিব সঙ্গীতলহরা চলছে। এই জায়গা প্রকৃতিপ্রেমী ও বার্ডওয়াচারদের স্বর্গ। কারোও মুখে কোনো কথা নেই। সবাই প্রাণভরে প্রকৃতির এই রসসুধা পান করে চলেছে। মাথার উপর দিয়ে চিল উড়ে যাচ্ছে শনশন করে। তাদের রাজ্যে আমাদের অনধিকার প্রবেশ যে তারা মোটেই ভালো ভাবে নিচ্ছে না তা যেন ভালো করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে।

এখানে আমরা ছাড়া আর কোনো মানুষ ছিল না এতক্ষণ। এখন এক জনকে দেখলাম, জলের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজছে। হয়তো শামুক বা ঝিনুক। জঙ্গলের শ্বাসমূল, ঠেসমূল দেখে সৈকত আর থাকতে পারল না। অতীব উচ্ছ্বাসে আমার উদ্দেশে বলে উঠল, জায়গাটা পুরো সুন্দরবনের মতো লাগছে না?

এই পরিবেশে আমার কথা বলতে একটুও ইচ্ছা করছিল না। তাই সংক্ষেপে বললাম- হুম।

পাথরের ভারসাম্য, পালোলেম।

সৈকত সুন্দরবনের সঙ্গে পালোলেম ব্যাকওয়াটারের মিল খুঁজে পেয়েছে, তাই খুব উচ্ছ্বসিত। ইতিমধ্যে আমি চিল, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বক ক্যামেরায় শিকার করে নিয়েছি। তাই লোভ আরও বেড়েছে। মাঝি দূরে আঙুল দেখিয়ে প্রকৃতির এক অত্যাশ্চর্য ব্যালেন্সের খেলা দেখাল। একটা বিশাল আকৃতির পাথরের উপর একটা বড়ো পাথর নামমাত্র ঠেকে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকশো বছর পার করে দিল এ ভাবেই!

এতক্ষণ আমরা নৌকা নিয়ে পাখি দেখে বেড়াচ্ছিলাম। গাছের ডালে চিলের দল, জলের উপর ভেসে থাকা মরা গাছের ডালে বসে থাকা পানকৌড়ি, জলের ধারে বকের ছোকছোকানি, গাছের ডালে মাছরাঙার উশখুশিনি, কিছুই আমাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু এ বার যা ঘটল, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মাঝি নৌকায় করে বেশ কিছু মুরগির ছাঁট নিয়ে এসেছে, এটা জানতাম না। সে এ বার সেগুলো জলে ছুড়ে ছুড়ে ফেলতে লাগল।

মাছরাঙা।

আর তার পরেই শুরু হল চিলেদের দাপাদাপি। যে যেখানে ছিল সবাই এখানে হাজির হয়ে গেল। সাধারণ চিলের পাশাপাশি শঙ্খচিলও এসেছে। খুব নিচু দিয়ে উড়ছে। মাঝে মাঝে তাদের পাখার বাতাসও গায়ে লাগছে। জেট বিমানের গতিতে ছোঁ মেরে জল থেকে মাংস তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এক সঙ্গে ৩০/৪০টা চিল আমি কখনও দেখিনি। অবাক হয়ে দেখছি আর ফোটো তুলছি। কখনও ওদের ফোটো তুলতে পারছি আবার কখনও ওদের গতির কাছে হার স্বীকার করছি। বেশ কিছুক্ষণ এই পর্ব চলল। তার পর সব মাংসের টুকরো তুলে নিয়ে গিয়ে চিলেরা যখন নিজেদের আস্তানায় চলে গেল তখন আমরাও সেই স্থান ত্যাগ করলাম।

এ বার আমাদের নৌকা ফেরার পথ ধরল। এক জায়গায় কিছু হোট্টিটি (Red wattled Lapwing) পাখি উড়ে যেতে দেখলাম। ফোটো তোলার সুযোগ পেলাম না। একটু দূরে একটি হোট্টিটি আমাদের দয়াপরবশত একটা ফোটো তুলতে দিল। পরে জেনেছিলাম আমাদের ছোটোবেলায় পড়া ‘হাট্টিমাটিম টিম মোদের খাড়া দুটো শিং’ ছড়াটি এই পাখিকে নিয়েই লেখা। এদের শিং নেই তবে চোখের পাশে লাল দাগকেই কবি শিং হিসাবে দেখেছেন।

হোট্টিটি।

চলতে চলতে আরও দু’টো নতুন পাখি দেখলাম। তাদের নাম জানি না। একটা নৌকায় দু’জন বিদেশিকে নৌকায় ব্যাকওয়াটার ঘুরতে যেতে দেখলাম। আসতে আসতে আমরা এই স্বর্গরাজ্য থেকে বেরিয়ে এলাম। নৌকা থেকে নামলাম একদম কাঁকড়াদের কলোনিতে। গোটা বিচ জুড়েই ভিজে বালিতে কাঁকড়াদের ছোট্টো ছোট্টো গর্ত। শিউলি ফুলের মতো ছোটো ছোটো কাঁকড়া। ভিজে বালির মতোই তাদের গায়ের রঙ হওয়াতে সহজে চোখে পড়ে না। সারা জীবন ধরে এরা শুধু বালিতে গর্ত করে বাসা বানিয়ে চলে। সমুদ্রকে এরা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সমুদ্র রোজ কয়েক বার এদের বাসা ভেঙে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ এরা আবার বাসা বানানোর কাজে লেগে পড়ে। এদের জীবনযুদ্ধের কাছে রবার্ট ব্রুসের গল্প নেহাতই হাস্যকর এক দৃষ্টান্ত।

আমাদের ভ্রমণসূচি অনুযায়ী আজ আমাদের দুধসাগর দেখতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরে যখন জানলাম দুধসাগরে যাওয়ার অনুমতি সামনের সপ্তাহের আগে পাওয়া যাবে না তখনই স্থির করেছিলাম পালোলেমে আসব। এখানে এসে মনে হল এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। এখানে না এলে ভুল হত। আমার মতে গোয়ার সেরা বিচ এই পালোলেম। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *