বোলপুরের কাছেই গুপ্ত, পাল, সেন প্রভৃতি আমলের নিদর্শন! যেন এক সংগ্রহশালা

মুকুট তপাদার

পর্ব ১

সপ্তাহান্তে ঘুরে আসুন, ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’। খুব দূরে নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর বীরভূমের অজয় নদের পাড়ে সেনকাপুর ও দেউলী থেকে। আর ইতিহাস ভালবাসেন? তাহলে এই জায়গাগুলো ঘুরতে যাওয়ার জন্য এক বিশেষ তৃপ্তি আছে।

অতীতের বজ্রভূমিতে ছড়িয়ে আছে একাধিক জায়গা। আর প্রাচীনকালের বজ্রভূমি হল আজকের বীরভূম। কঠিন বজ্রের মত মাটি।

পুণ্ড্ৰ, বঙ্গ, সমতট, রাঢ়, গৌড়, হরিকেল, বরেন্দ্র এই সকল জনপদ ভৌগলিক সীমারেখা নির্দেশ করে। রাঢ় দেশে তখন বজ্রযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাস। সেই বজ্রযান নাম থেকে বীরভূম। অজয়ের তীরে সেনকাপুর ও দেউলী গ্রামে বৌদ্ধ যুগের প্রমাণ পাওয়া যায়।

শোনা যায়, রামপুরহাটের কাছে অতীতে বৌদ্ধদের মঠ ছিল। বজ্রযান বৌদ্ধদের বৌদ্ধ বিহার ও মঠ এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে এককালে ছড়িয়ে ছিল। কিছু প্রত্নস্থল থেকে অতীতের এইসব নিদর্শন আজও মাঝেমধ্যে মাটি খুঁড়লে বেরিয়ে আসে।

বৌদ্ধ কাহিনী ‘দিব্যাবদান’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বুদ্ধদেব এই সকল অঞ্চলের উপর দিয়ে ধর্মপ্রচার করেছেন। গন্তব্য ছিল অতীতের পুণ্ড্রবর্দ্ধন ও সমতট অঞ্চল। এটি জৈন ধর্মেরও এক তীর্থস্থান। জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর এখানকার নানা জায়গায় বাস করেছিলেন। জৈন শাস্ত্রের লেখক ভদ্রবাহুর গ্রন্থে এখানকার জৈনধর্মাবলম্বীদের কথা জানা যায়। শুধু যে পীঠস্থান বা সতীপিঠের জন্য নয়, যেন নানা ধর্মের মিলনক্ষেত্র। চীনা পন্ডিত হিউয়েন সাঙ এর ভ্রমণ বিবরণীতেও সেকথা পাওয়া যায়।

অজয় নদের পাড়ে দেউলীতে উৎখননের ফলে একাধিক পাল ও সেন যুগের মূর্তির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। দেউলিতে স্থানীয় পুকুর থেকে জল নিষ্কাশন ও খননের ফলে পাল ও সেন যুগের বহু মূল্যবান মূর্তি উদ্ধার হয়েছে। এখানকার স্থানীয় মন্দিরগুলোতে তাদের পুজো করা হয়। বেশিরভাগই বিষ্ণুমূর্তি। কিছু মাটির তলদেশ থেকেও উদ্ধার হয়। ঐতিহাসিক গবেষণার কাজে মূর্তিগুলি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

পাল রাজারা ছিলেন শিল্পের অনুরাগী। দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে দেউলীর কারুকাজ করা পাথরের মূর্তিগুলো অনুমান করা যায়। মূর্তিগুলোতে দাঁড়িয়ে থাকা বা বসার জন্য আছে পাদপীঠ। পাল আমলের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। ধর্মপাল ও দেবপালের মতো রাজারা ছিলেন ধর্মীয় আচারে বৌদ্ধ। সেই সময়কার নিদর্শনও এখান থেকে পাওয়া যায়।

দেউলিতে অজয় নদের বন্যায় ভেসে এসেছে কিছু প্রাচীন পাল যুগের মূর্তি। নদীর ধার থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। সেগুলিকে স্থানীয় মন্দিরে রেখে বর্তমানে পুজো-অর্চনা করা হচ্ছে। পুরাতত্ত্ববিদদের গবেষণায় জানা যায় যে, পাল রাজাদের প্রতিষ্ঠিত এরমধ্যে একটি দ্বিখণ্ডিত বিষ্ণুমূর্তিও এখানে পূজিত হচ্ছে।

মন্দির গুলোর কাছ দিয়েই বয়ে গেছে অজয় নদ। কত প্রাচীন জনপদ এই নদীকে কেন্দ্র করে। কোন এক অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়িয়ে মনে হবে, এই নদ বয়ে নিয়ে চলেছে কারো বীরত্ব বা কারো ঐতিহাসিক খ্যাতি।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *