ভ্রমণ কাহিনিভ্রমণকথা

মরাঠাভূমে আবার, শেষ পর্ব: মায়ানগরী মুম্বইকে টাটা!

শ্রয়ণ সেন

“মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”

বাবার কথায় কিঞ্চিৎ চমকৃত হলাম। এই তো কিছুক্ষণ আগেও খুব উৎসাহ নিয়ে হাঁটছিল, এখন কী হল হঠাৎ?

কী হল বাবার? প্রশ্ন করতেই উত্তর এল, “এরা দোতলা বাসগুলো কী সুন্দর ভাবে ফিরিয়ে এনেছে দেখ! অথচ আমরা কী করেছি!”

বুঝলাম। বাবা আসলে মুম্বইয়ের দোতলা বাসগুলো দেখে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছে। মুম্বইয়ের রাস্তায় ইতিহাস ফিরে এসেছে, পুরোনো দিনের সেই দোতলা বাসগুলো আবার নতুন ফর্মে নতুন রূপে ফিরে এসেছে, তা-ও আবার এসি!

আমি আর বাবা ইতিমধ্যেই হেঁটে ফেলেছি ঘন্টাখানেক, আমাদের সেই পুরোনো তত্ত্বের সওয়ার হয়ে। কী সেই তত্ত্ব?

‘শহর চিনতে হলে হেঁটে দেখো বন্ধু।’

সকাল দশটায় রওনা হলাম হোটেল থেকে। সে অর্থে কোনো টার্গেট নেই, জাস্ট হেঁটে হেঁটে শরীরকে বেশি চাপ না দিয়ে যতটা যাওয়া যায়, যে দিকে যাওয়া যায়, ততটাই যাব।

ওভাল ময়দান। পিছনে হাই কোর্ট।

শুরু হল যাত্রা। কিছুটা যেতেই পৌঁছে গেলাম ওভাল ময়দান। ময়দানের ও পারেই উঁকি দিচ্ছে বম্বে হাইকোর্টের আইকনিক বিল্ডিং। তার পাশেই ব্রিটিশ ঘরানার এক বিশাল অট্টালিকা – রাজাবাই ক্লক টাওয়ার।

বাবা বলল, “হাঁটছি যখন, চল গেটওয়েটা দেখে আসি!” একপায়ে খাড়া আমি। বাবার কথামতো গুগল ম্যাপে নির্দেশিকা দিয়ে দেখলাম গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া এক কিলোমিটার মতো দূর। এগিয়ে চললাম।

গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া।

আরও মিনিট পনেরোর হাঁটা, পৌঁছে গেলাম গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া। এই নিয়ে তৃতীয় বার এলাম গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায়। কিন্তু এই প্রথম বার হেঁটে হেঁটে এলাম। ফলে আশেপাশের জায়গাগুলোর ব্যাপারে একটা ধারণা করতে পারলাম।

শহরের প্রধান প্রধান রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিটিশ আমলে তৈরি বাড়িগুলো দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। কী স্থাপত্য! মুম্বইয়ের পথে পথে ব্রিটিশ আমলের একটা ‘ভাইব’ আসছে প্রচণ্ড ভাবে।

গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায় এখন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। উল্টো দিকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তাজ হোটেল। কত ঘটনার যে সাক্ষী এই তাজ, সেটা বলাই বাহুল্য।

তাজ হোটেল।

“এই ভিটি যাবি?”

বাবার দেখি উৎসাহে ভাটা পড়েনি। আমি তো এমনিতেই একপায়ে খাড়া সব সময়ই থাকি। রওনা হয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী রাউন্ডে।

১৭৩৫ সালে তৈরি ন্যাভাল ডকইয়ার্ডের ঐতিহাসিক ভবনকে পাশে রেখে শহিদ ভগৎ সিংহ রোড দিয়ে হেঁটে চলেছি। এই পাড়াটায় পুরোনো পুরোনো একটা গন্ধ রয়েছে।

১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপিত হয়েছিল কলকাতায়। এর কুড়ি বছর পর মুম্বইয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির ভবনটি তৈরি হয়েছিল। সেই বাড়িটার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, কত কত ইতিহাসের সাক্ষী এই গোটা অঞ্চল।

ব্যালার্ড এস্টেটের পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়িগুলোর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাতে তাকাতে খেয়ালই করিনি ভিটিতে পৌঁছে গেছি। ভিটি মানে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস। এখন তার নাম ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ টার্মিনাস, অর্থাৎ সিএসএমটি। এই বাড়িটাও দেখার মতো।

এশিয়াটিক সোসাইটি।

দীর্ঘক্ষণ হেঁটে বেশ ভালো ঘাম ঝরিয়ে সুন্দর আনারসের জুসে গলা ভিজিয়ে নিলাম আমি আর বাবা। তখনই পাশ দিয়ে একটার পর একটা দোতলা বাস যাচ্ছিল, যা দেখে বাবা ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে পড়ল।

জুস খেয়ে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে ফের হাঁটা লাগালাম। এ বার গন্তব্য আমাদের হোটেল। বড়ো বড়ো সব বটগাছের ছায়ার মধ্যে দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি হাজারিমল সোমালি রোড ধরে। পাশে পড়ল বোম্বে জিমখানা গ্রাউন্ড।

এই তো সেই ঐতিহাসিক মাঠ, যেখানে প্রথম বার ভারতের মাটিতে আয়োজিত হয়েছিল টেস্ট ম্যাচ। তখন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামও ছিল না, ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামও না। ১৯৩৩ সালে আয়োজিত ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে এই টেস্ট ম্যাচটি লালা অমরনাথের শতরানের জন্য আজও ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে।

এর পর হঠাৎ করেই তাঁর মূর্তি পেয়ে গেলাম, যিনি সমগ্র বাঙালির কাছে নমস্য হয়ে থাকবেন চিরকাল, গোপালকৃষ্ণ গোখেল। এই সেই মানুষ, যিনি বলেছিলেন, “বাংলা যা আজ ভাবে, গোটা ভারত সেটা ভাবে কাল!” অনেকে অনেক কিছু বলবেন হয়তো, কিন্তু মানসিকতার দিক থেকে বাংলা যে এখনও দেশের অনেকাংশে (বিশেষ করে দেশের উত্তরাংশের থেকে) এগিয়ে, সেটা বলাই বাহুল্য।

ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস, এখন যার নাম ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ টার্মিনাস।

যা-ই হোক, আড়াই ঘণ্টার পদযাত্রা শেষ করে বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ হোটেলে ফিরে এলাম আমি আর বাবা। অ্যাপে চোখ মিলিয়ে দেখে নিলাম সাত কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছি আমরা।

জ্বরটা এসেছিল মঙ্গলবার। বাবা-মাকে বলিনি তখন। আসলে এই বিদেশবিভুঁইয়ে জ্বরটর হওয়ার কথা জানলে ওরা দু’জন চিন্তা করত প্রচণ্ড। তার ওপর ওই দুর্ঘটনার পর মা আগের থেকে একটু বেশিই টেনশন করে এখন। ওদের তাই আর বেশি টেনশন দিতে চাইনি।

বরং ভরসা করেছিলাম ন্যাচরাল হিলিং-এ। ঠিক সেটাই হল, সাগরের হাওয়ার জোরে, কোনো ওষুধ না খেয়েই মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেই শরীর ঠিক হতে শুরু করে আমার। বুধবার সকাল থেকে এক্কেবারে চাঙ্গা।

সাগরের হাওয়ার গুণ আছে বলতে হবে। আর হাওয়ার টানেই মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভের ধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেন কত শতশত মানুষ।

এই মুম্বই একটা অদ্ভুত শহর। এখানে মানুষের চরমতম ব্যস্ততা রয়েছে, তবুও এখানে মানুষ ফ্রি টাইম কাটাতে জানে! এখানে অফিসযাত্রীদের লোকাল ট্রেন ধরার চূড়ান্ত তাড়া থাকে, কিন্তু তার মধ্যেও কোনো এক বয়স্ক মানুষের ব্যাগ তুলে দেওয়ার জন্য সাহায্যের অফারও থাকে। শহরটা চূড়ান্ত ব্যস্ত, কিন্তু তার মধ্যেও ভীষণভাবে মানবিক।

এককালে খুব মনে হত চাকরি যদি করতেই হয় এই মুম্বইয়ে করব। কম বার তো হল না মুম্বই আসা, এই নিয়ে চতুর্থ বার। প্রথম বার মুম্বইকে নিয়ে যে অনুভূতি হয়েছিল, সেই অনুভূতি এতটুকু বদলায়নি।

এ রকম হেরিটেজ বাড়ির ছড়াছড়ি পুরোনো মুম্বইয়ে।

আগের তিনবারের থেকে এবার মুম্বইকে আরও কাছ থেকে চিনলাম। এর কারণ আমাদের হোটেলের অবস্থান। এক্কেবারে মেরিন ড্রাইভের ওপরে, চার্চগেট স্টেশনের কাছে। উঠতে বসতে মেরিন ড্রাইভ দেখছি, আট থেকে আশির মানুষজন দেখছি। রাত বারোটার পরেও কত নিরাপদে এখানে মানুষজন ঘুরে বেড়াতে পারে।

মুম্বই আসার এবার পরিকল্পনা ছিল না সে ভাবে। মাকে নিয়ে শিরডি আসার পরিকল্পনা যে দিন থেকে শুরু করেছিলাম, মাথায় রেখেছিলাম যে বড়োজোর আর দুটো জায়গা ঘুরব। মে’র মাঝামাঝি প্ল্যান কিছুটা বদলে দিয়ে মুম্বইকে ঢোকানো হল। ভাগ্যিস ঢোকানো হল! নইলে কত কী যে মিস করে যেতাম।

কিন্তু সব কিছুরই তো একটা সমাপ্তি থাকে, আমাদের এই সফরও সমাপ্তির দিকে চলে এল। এবার কলকাতার পথে রওনা হওয়ার পালা।

গত ১২-১৩ দিন ধরে নতুন জায়গা দেখলাম, নতুন কত কী জানলাম, কর্মব্যস্ত ঘোরাঘুরির বাইরে নিজের মতো করে নিজের জন্য ঘুরলাম। এর পাশাপাশি নিজের লেখার হাত ঝালিয়ে তো নিলাম। কিন্তু সব থেকে বড়ো কথা, মাকে নিয়ে কনফিডেন্স আরও বাড়িয়ে দিল এই ট্যুর। আর এমন একটা ট্যুরের শেষ মুম্বইয়ের মতো শহরে হচ্ছে, সেটা আরও আনন্দের।

যাই হোক, মায়ায় বেঁধে রাখা মায়ানগরী মুম্বই ছেড়ে যেতে একটু মন খারাপ তো হচ্ছে বটেই। তবুও জানি যে এই শহরে, এই রাজ্যে ফিরব জলদি।

একইসঙ্গে এই ট্যুরের গল্পমালা এখানেই শেষ হল। এত দিন ধরে আমার লেখাগুলো যাঁরা মন দিয়ে পড়লেন আর সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করলেন, তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আবার ফিরব অন্য কোনো লেখা নেই। অন্য কোনো অভিজ্ঞতা নিয়ে। মুম্বই শহরকে বিদায় জানালে ‘টাটা’ বলা উচিত। কারণ এটাই তো টাটাদের শহর। তাই টাটা! (শেষ)

ছবি: লেখক

আরও পড়ুন

মরাঠাভূমে আবার: পর্ব ১

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ২: মায়ের ইচ্ছাপূরণ

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৩: ঘৃষ্ণেশ্বর হয়ে কৈলাশে 

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৪: শিরডী থেকে কারলায়

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৫: পাওনা লেক দেখে লোনাভালায়

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৬: কোঙ্কণ রেলপথে তারকারলি যাত্রা

মরাঠা ভূমে আবার, পর্ব ৭: একের পর এক সৈকত দর্শন

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৮: ভালো থেকো তারকারলি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *