মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৬: কোঙ্কণ রেলপথে তারকারলি যাত্রা
শ্রয়ণ সেন
“কত নম্বর টানেল পেরোচ্ছি গো বাবা?”
“২৩।”
মনে পড়ে যাচ্ছে আজ থেকে আঠাশ বছর আগের কথা। শিমলা যাওয়ার পথে আমাদের টয়ট্রেনটা যখন একের পর এক সুড়ঙ্গ পেরোচ্ছিল, তখন ক্লাস ওয়ানে পড়া ছোট্ট আমি প্রশ্নবাণে কার্যত বিদ্ধ করেছিলাম বাবাকে। বাবা কিন্তু বিরক্ত হয়নি এতটুকু। আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে গিয়েছিল।
এ বারও যে সেই রকম কিছুই হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত সত্তর পেরিয়ে যাওয়া প্রৌঢ়। তাই আগে থেকে একটু বেশি সজাগ থাকতে হচ্ছে তাঁকে।
জীবন পেরিয়ে গিয়েছে আঠাশ বছর, কিন্তু বাবার সঙ্গে আমার রসায়নে একটুকুও বদল হয়নি। তাই তো আজও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা কাটিয়ে দিতে পারি ভ্রমণ সংক্রান্ত নানা রকম গল্প করে।
যে পথে আমরা এখন সফর করছি, সেটা কিন্তু আমাদের খুব একটা অচেনা নয়। কারণ ষোলো বছর আগে আমরা এই অঞ্চলে বেড়াতে এসেছিলাম। কিন্তু সে বার ভ্রমণ হয়েছিল সড়কপথে। এ বার রেলপথে।
কোঙ্কণ রেল নিয়ে আমার আগ্রহ অনেক দিনের। ছোটো থেকে বিভিন্ন বই ঘেঁটে কোঙ্কণ রেলের ব্যাপারে জেনেছি। মুম্বই থেকে কর্নাটকের ম্যাঙ্গালুরু পর্যন্ত পথটা মূলত উপকূলীয় হলেও উঁচু পাহাড় আর একের পর এক নদীর কারণে তা বড্ড দুর্গম। সেই অঞ্চল দিয়ে রেলপথ তৈরি করা কার্যত এক বিস্ময়কর ব্যাপার।

চলেছি কোঙ্কণ রেলপথে।
পশ্চিমঘাটের দুর্গম পাহাড় এবং আরব সাগরের ঘন নীল জল যে ভাবে একের অপরের গা ঘেঁষে রয়েছে, তা উপভোগ করতে হলে ভারতের পশ্চিম উপকূলে, বিশেষ করে মহারাষ্ট্র থেকে গোয়া হয়ে কর্নাটক পর্যন্ত ভ্রমণ করতেই হবে। সেই পাহাড় এত বেশি দুর্গম যে এই অঞ্চলের কিছু প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছোতে হলে এখনও নিজের পায়ের ওপরেই ভরসা করতে হয় স্থানীয়দের। ট্রেন তো দূর, গাড়ি যাওয়ারও ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত হয়নি সেখানে।
পানভেল থেকে ট্রেনটা ছাড়ল পৌনে ন’টায়। জানলার ধারে আরও নড়েচড়ে বসলাম। আগামী আট ঘণ্টা জানলার ধার থেকে নড়ব না। প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে দরজার ধারে গিয়েও দাঁড়াতে পারি।
পানভেল ছাড়াতেই পাতালগঙ্গা নদী পেরোল ট্রেনটা। তার পরেই পরিবেশ বদলে যেতে থাকল। আকাশচুম্বী অট্টালিকা পেছনে চলে গিয়েছে। কাছে এসে গিয়েছে পাহাড়। যে পাহাড়ের মাথায় লেপ্টে রয়েছে বর্ষার মেঘ। এখন অবশ্য বৃষ্টি হচ্ছে না। তবে বর্ষাকাল তো, তাই যে কোনো মুহূর্তেই সে নামতে পারে ঝেঁপে।
ট্রেন এগোচ্ছে ধীরগতিতে, এরই মধ্যে কোঙ্কণ রেলের ইতিহাসটা একটু ঝালিয়ে নিলাম। এই পথটা এতটাই দুর্গম যে আধুনিক যুগেও এখানে রেলপথ নির্মাণের কোনো রকম পরিকল্পনা ছিল না। এই অঞ্চলে চিপলুন, রত্নাগিরি, ম্যাঙ্গালুরুর মতো বড়ো বড়ো শহর এবং গোয়ার মতো আস্ত একটা রাজ্য থাকলেও রেলপথ ছিল না। ভরসা ছিল শুধুমাত্র সড়কপথ।
স্বাধীনতার পরে কোঙ্কণ উপকুল বরাবর রেলপথ নির্মাণের দাবি ক্রমশ জোরালো হতে থাকে। ১৯৫৭ সালে এই অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের জন্য মহারাষ্ট্রের দাসগাঁও এবং কর্নাটকের ম্যাঙ্গালুরুর মধ্যে একটি সমীক্ষা করা হয়। ১৯৯০ সালের ১৯ জুলাই, তৎকালীন ভিপি সিংহ সরকারের রেলমন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ, অর্থমন্ত্রী মধু দন্ডবতে এবং প্ল্যানিং কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান রামকৃষ্ণ হেগড়ের উদ্যোগে তৈরি হয় কোঙ্কণ রেলওয়ে কর্পোরেশন লিমিটেড। এই দুর্গম পথ দিয়ে ট্রেন চালানোই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য।
কিন্তু বিষয়টি খাতায়-কলমে করা যতটা সহজ, মাঠে নেমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা ঠিক ততটাই কঠিন ছিল। এই অতি দুর্গম অঞ্চল দিয়ে রেলপথ নিয়ে গেলে তৈরি করতে হবে দু’হাজারেরও বেশি সেতু এবং ৯২টি সুড়ঙ্গপথ। পাহাড় কেটে এই সুড়ঙ্গ তৈরি না করলে কোনো ভাবেই ট্রেন চালানো যাবে না যে।

পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে খেত।
বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে সামলে নিয়ে অবশেষে ট্রেন চলল এই পথে। ১৯৯৩ সালের মার্চে রেলপথের দক্ষিণ প্রান্তে প্রথম বার ট্রেন চালানো হয়, কর্নাটকের ম্যাঙ্গালুরু থেকে উদুপি পর্যন্ত। দ্বিতীয় ধাপে ট্রেন চালানো হয় উত্তর প্রান্তে। ওই বছরেরই জুনে ট্রেন চলে মহারাষ্ট্রের রোহা এবং বীরের মধ্যে।
এর পর আরও পাঁচ বছর ধরে একটার পর একটা অংশ জুড়তে জুড়তে, অবশেষে ১৯৯৮ সালের মে মাসে মুম্বই থেকে ম্যাঙ্গালুরু পর্যন্ত পুরো রেলপথেই প্রথম বার যাত্রীট্রেন চালানো হয়। রেলপথে যুক্ত হয় মুম্বই-চিপলুন-রত্নাগিরি-গোয়া-কারওয়ার-উদুপি-ম্যাঙ্গালুরু।
ইতিহাস ঝালাতে গিয়ে খেয়ালই হয়নি যে এই যাত্রাপথের প্রথম সুড়ঙ্গে ঢুকে গিয়েছে ট্রেনটা। চারিদিক মিশমিশে কালো, বদ্ধ জায়গা দিয়ে যাচ্ছে সে। গুমগুম একটা আওয়াজ হচ্ছে। মিনিটখানেক পর সুড়ঙ্গ থেকে ট্রেনটা বেরোতেই আশেপাশের পরিবেশ যেন আরও কিছুটা বদলে গেল।
একটা স্টেশন এল। নাম কোলাড। জায়গাটা চেনা। ওই যে, আজ থেকে ষোলো বছর আগে এই অঞ্চল দিয়েই তো সড়কপথে ভ্রমণ করেছিলাম। সেই স্মৃতি মনে পড়ছে এ বার। রায়গড় কেল্লাটা কোলাডের কাছেই না? বাবাকে প্রশ্নটা করতেই সম্মতিসূচক উত্তর পেলাম।

পাশ দিয়ে চলেছে মুম্বই-গোয়া জাতীয় সড়ক।
ট্রেন চলছে কু-ঝিকঝিক। মুম্বই-গোয়া জাতীয় সড়কটার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে চলেছি। সেই সড়ক কখনও রেললাইনের একদম ধারে এসে যাচ্ছে, কখনও ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার কখনও রেললাইন জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
তিন নম্বর সুড়ঙ্গপথটা পেরিয়ে যেতেই বিশাল সাবিত্রী নদী। নদীটা চেনা। দেখা হয়েছিল সেই ষোলো বছর আগে। এখান থেকে হরিহরেশ্বর সমুদ্রসৈকত খুব একটা দূরে নয়। সেই হরিহরেশ্বরেই পশ্চিমঘাটের পাহাড় থেকে নেমে এসে আরব সাগরের জলে নিজেকে সোঁপে দেয় সাবিত্রী।

চিপলুন স্টেশন।
সকাল পৌনে ১২টা। ট্রেন থামল চিপলুনে। এতক্ষণে ১৮টা সুড়ঙ্গপথ এবং বেশ কয়েকটা নদী পেরিয়ে এসেছি। চিপলুনের সঙ্গেও ছোট্ট একটা স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। সে বার যখন সড়কপথে মহাবালেশ্বর থেকে গণপতিপুলে যাচ্ছিলাম, তখন মাঝপথে এই চিপলুনেই প্রাতরাশ করেছিলাম। এত অপূর্ব ধোকলা খেয়েছিলাম যে তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে।
চিপলুন ছাড়াতেই বশিষ্ঠ নদীর ওপর সেতু। এক একটা নদী কী বিশাল! এই সব নদী বৃষ্টিতেই পুষ্ট। পাহাড় থেকে নেমে আরব সাগরে মিশে যায়। অনিন্দ্যসুন্দর যাত্রাপথ প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিচ্ছে। চারদিকের নীলাভ সবুজ পাহাড়, আচমকা দেখা পাওয়া জলস্রোত আর সঙ্গে অসংখ্য সুড়ঙ্গপথের সাক্ষী থাকছে এই স্বপ্নিল ভ্রমণপথ।

বশিষ্ঠ নদী।
চিপলুনের পর সুড়ঙ্গ আরও বেড়ে গেল। একটা সুড়ঙ্গ থেকে বেরোতেই নিমেষের মধ্যে পরের সুড়ঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে ট্রেন। আবার একটা সুড়ঙ্গ থেকে বেরোতেই সঙ্গে সঙ্গে নদীসেতু। আশেপাশের পাহাড়গুলো কী উঁচু! ভাবছি এতটা দুর্গম তো দার্জিলিং বা শিমলার টয়ট্রেন পথও নয়।
“কতক্ষণ চলছে গো এই টানেলটা?”
“এই তো সাত মিনিট হয়ে গেল।”
“তা হলে এটাই বোধহয় সেই দীর্ঘতম টানেল!”
৩৯ নম্বর সুড়ঙ্গতে ঢুকেছিলাম সাত মিনিট আগে। ট্রেন কিন্তু বেশ স্পিডেই চলছে। তবুও সুড়ঙ্গটা শেষ হল না এখনও। কোঙ্কণ রেলপথ নিয়ে ইতিহাস ঘাঁটার সময় পড়েছিলাম যে রত্নাগিরির কাছে করবুডে রয়েছে এই রেলপথের দীর্ঘতম সুড়ঙ্গটি। দূরত্ব সাড়ে ছয় কিলোমিটার। একসময় এটিই ছিল ভারতীয় রেলপথে দীর্ঘতম টানেল। কিন্তু কাশ্মীরে পিরপাঞ্জাল পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছে দীর্ঘতম টানেল। যাই হোক মুশকিল হল, এক একটা সুড়ঙ্গে ঢোকার আগে সেই সুড়ঙ্গ সম্পর্কে বিশেষ কোনো পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না, যেমনটা আছে কালকা-শিমলা রেলপথে। যার ফলে কতকটা আন্দাজেই বিষয়গুলো বুঝতে হচ্ছে। তবে এই ৩৯ নম্বর সুড়ঙ্গটাই যে এই রেলপথের দীর্ঘতম সেটা বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হল না।

কোঙ্কণ রেলপথে অসংখ্য টানেলের একটি।
চলে এল রত্নাগিরি। চিপলুন থেকে রত্নাগিরির দূরত্ব ষাট কিলোমিটার মতো। এই অল্প রাস্তায় মোট ২৩টা সুড়ঙ্গপথ পেরোলাম। স্টেশনে ট্রেন থামতেই ট্রেন থেকে নেমে রত্নাগিরিকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম। রত্নাগিরিও আমার কাছে নতুন জায়গা নয়।
রত্নাগিরি হোক বা রত্নগিরি। এই কোঙ্কণী শহরটা ভারতের এক রত্নভূমি। ‘স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার এবং আমরা তা অর্জন করবই’- এই উক্তির মধ্যে দিয়ে লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যিনি, ভারতের সেই বীরপুত্র লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকের জন্মস্থান এই রত্নাগিরি।
রত্নাগিরি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সেই পুণ্যভূমি। খুব সাদামাটা কোঙ্কণী স্টাইলের বাড়ি। দু’তলা বাড়ির চাল তৈরি টালি দিয়ে। বর্তমানে পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই বাড়িটির দেখভাল করে। ১৮৫৬ সালের ২৩ জুলাই এই বাড়িতেই জন্ম নেন কেশব গঙ্গাধর তিলক ওরফে বাল গঙ্গাধর তিলক।

বৃষ্টিস্নাত রত্নাগিরি স্টেশন।
ট্রেন ছেড়ে দিল। এখনও প্রায় ১৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। এক একটা জায়গা যেন এক একটা ছোট্ট ছোট্ট টুরিস্ট স্পট। পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে খাপছাড়া খাপছাড়া কিছু রিসর্ট তৈরি হয়েছে। সবুজ দেখার জন্য এই জায়গাগুলো আদর্শ।
রত্নাগিরি ছাড়িয়ে কঙ্কভলি। তার পর ট্রেন থামল কুড়ালে। আমাদের যাত্রাপালা শেষ হল। তবে এর মধ্যেই পেরিয়ে এসেছি একাত্তরটা টানেল।
ট্রেন থেকে নেমে বাবার আবার মনে পড়ে গেল ৩৬ বছর আগের একটা ঘটনা। তখন অবশ্য ট্রেন চালু হয়নি। মাকে নিয়েই বাসেই মুম্বই থেকে গোয়া গিয়েছিল বাবা – “জানিস, তখন ভোর পাঁচটা। একটা চায়ের দোকানের সামনে বাসটা থামল। আমরা সব হইহই করে চা খেতে নেমে পড়লাম। জায়গাটা সম্ভবত এই কুড়ালই ছিল।”

তারকারলি রিসর্ট থেকে আরব সাগর।
কুড়াল স্টেশনে নেমে এগিয়ে যাচ্ছি পার্কিং-এর দিকে। সমুদ্রসৈকত তারকারলি যাব, গাড়ি বলা আছে। সে এসেও গিয়েছে।
এক অসাধারণ ট্রেনযাত্রা এবং জীবনের অন্যতম সেরা ট্রেনযাত্রা এখানেই শেষ হল। ট্রেনের লেট, কাজের তাড়ার জন্য বাধ্য হয়ে আমাদের প্লেনে সফর করতে হয়, কিন্তু ট্রেনযাত্রার আনন্দ যে সব কিছুর থেকে আলাদা, ফের একবার প্রমাণিত হল।
“বাবা যাই বলো, মন এখনও ভরল না!”
“কেন রে?”
“এর পরের লক্ষ্য এই কুড়াল থেকে ম্যাঙ্গালুরু পর্যন্ত ট্রেনভ্রমণ। তা হলেই এই অতুলনীয় সৌন্দর্যের রেলপথটা চাক্ষুষ করা পূর্ণ হবে!”
“ঠিক বলেছিস!” (চলবে)
ছবি: লেখক
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ২: মায়ের ইচ্ছাপূরণ
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৩: ঘৃষ্ণেশ্বর হয়ে কৈলাশে