ভ্রমণ কাহিনিভ্রমণকথা

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৪: শিরডী থেকে কারলায়

শ্রয়ণ সেন   

“ঋভু, আমাদের রোড জার্নির তালিকায় এটা একটা নতুন সংযোজন বল?”

বাবার আর আমার, দু’জনেরই সড়কযাত্রা ভীষণ পছন্দের। সেই একুশ বছর আগে রাজস্থানে রোড ট্র্যাভেল করতে করতে এর প্রেমে পড়েছিলাম। তার পর তামিলনাড়ু হোক বা হিমাচল, কর্নাটক হোক বা কাশ্মীর, গাড়িতে জার্নি করতে আমাদের বেশ লাগে। এমনকি ভরা কোভিডের‌ সময়ে কলকাতা থেকে দার্জিলিং গাড়িতে চলে যাওয়ার সাহসও নিয়েছিলাম আমরা।

মহারাষ্ট্র আমাদের কাছে বড়ো চেনা। ২০০৯-এ আমি প্রথম বার এসেছি এ রাজ্যে, বাবা তারও আগে। এই নিয়ে এটা আমার ষষ্ঠ বার মহারাষ্ট্রে। তবে আজকের রোড জার্নিটা প্রায় নতুন আমার কাছে।

দুটো দিন খুব সুন্দর কাটালাম সাইবাবার থান শিরডীতে। আমার এক পিসি আর পিসেমশাই সাইবাবার খুব ভক্ত। পিসেমশাই আদতে অন্ধ্রের মানুষ। কিন্তু খড়গপুরেই সব কিছু – জন্ম, পড়াশোনা, কর্মজীবন। ‘সাইবাবার জায়গায় এসে একবার কৃষ্ণমূর্তির (আমার পিসেমশাই) সঙ্গে যোগাযোগ করব না?’ – এরকম ভেবে মা পিসেমশাইকে ফোন করে অবাক হয়ে গেছে। অবাক হওয়ার মতোই ঘটনা। ওরা এই সময়ে শিরডীতেই আছে। ঘৃষ্ণেশ্বর-ইলোরা থেকে ফিরে সন্ধেটা কেটে গেল পিসিদের সঙ্গে।

চলেছি শিরডী থেকে কারলা।

আরও একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা নিয়ে চললাম শিরডী থেকে। তা হল এখানকার খাওয়াদাওয়া। হেন খাবার নেই যা পাওয়া যায় না শিরডীতে। আমরা অবশ্য প্রাতরাশ ছাড়া বাকি খাওয়া সারছিলাম এমটিডিসি রিসর্টের উল্টো দিকে ‘মিনি পাঞ্জাব’ রেস্তোরাঁয়। এখানকার বেশির ভাগ কর্মীই দেখলাম বাঙালি। তবে শুধু এই রেস্তোরাঁই নয়, শিরডীর বহু রেস্তোরাঁতেই বাঙালিরা কাজ করে, যেমন দেখেছিলাম নাসিক রোড স্টেশনের পাশের রেস্তোরাঁয়।

এই ‘মিনি পাঞ্জাব’-এই আলাপ হল আকাশ মণ্ডলের সঙ্গে। বাড়ি নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। পরিবারের সবাই ওখানে। এখানে রয়েছেন ১১ বছর হল। এখানে কাজ করে রানাঘাটের কাছে গাংনাপুরে ৫ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেছেন। আকাশরা খ্রিস্টান। বড়োদিনের সময় বাড়ি যায় দু’ সপ্তাহের জন্য। আকাশের মতো এরকম অনেক বাঙালি শিরডীতে রয়েছেন।           

প্রাতরাশ করে শিরডী থেকে রওনা হয়েছিলাম সাড়ে ন’টা নাগাদ। শিরডী থেকে দুশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছোলাম লোনাভনার অনতিদূরে কারলায়। পথে পড়ল গ্রামীণ মহারাষ্ট্রের নানা রূপ। রুক্ষ জমি, টুকটাক চাষবাস, অদ্ভুত চেহারার সব পাহাড়, মারাঠি টুপি পরিহিত মানুষজন।

মহারাষ্ট্রের পাহাড়ের রূপ বড্ড আকর্ষণ করে আমাকে। পাহাড়ের চূড়া অন্য রকম। মনে হয় সমতল। আঁকার খাতায় আমরা যে ভাবে পাহাড় আঁকি, তার থেকে একদমই আলাদা। সেই পাহাড় ভেদ করেই তৈরি হয়েছে হাইওয়ে। সাঁ সাঁ গতিতে ছুটে চলে আমাদের গাড়ি।

গ্রামীণ মহারাষ্ট্রের এক রূপ, রুক্ষ জমি।

হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে কখনও বাঁ হাতে ছেড়ে আসি মালসেজঘাটের রাস্তা, তো কখনও ডান দিকে দেখতে পাই ভীমাশঙ্করের রাস্তা। বড্ড চেনা এই জায়গাগুলো। চাকানের পর আবহাওয়া বদলে গেল। পরিষ্কার আকাশে কোত্থেকে যেন একরাশ মেঘ হাজির। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই এসে পৌঁছোলাম কারলায়।

লোনাভলার অনতিদূরে কারলায় মহারাষ্ট্র পর্যটনের রিসর্টে প্রবেশ করতেই একরাশ ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল। এমন সবুজে ঘেরা রিসর্টে খুব কমই থেকেছি। মনে পড়ে গেল ১৬ বছর আগের মহাবালেশ্বরের স্মৃতি। ওই রিসর্টের চত্বরটাও তো এমনই। আরে দুটোই তো মহারাষ্ট্র পর্যটনের। একরকম তো হতেই পারে! কারলার রিসর্টটি আমার দেখা মহারাষ্ট্র পর্যটনের একাদশতম রিসর্ট।

সমুদ্রতল থেকে হাজার দুয়েক ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই রিসর্টে যখন পৌঁছোলাম, তার আগেই একচোট জোরে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। ফলে বাতাসে এক দিকে যেমন সোঁদা সোঁদা গন্ধ, তেমনই অন্য দিকে হালকা একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব রয়েছে।

গাছগাছালির মধ্যে বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে এই রিসর্ট। দেখলাম রিসেপশন বা রেস্তোরাঁ থেকে আমাদের কটেজে হেঁটে আসতে ৫ মিনিটের বেশি লাগছে। কিছু কিছু গাছ এতই পুরোনো যে রিসর্ট কর্তৃপক্ষ সতর্কতা দিয়ে রেখেছে যে কোনো গাছের তলায় গাড়ি যেন না রাখা হয়, কারণ একটু ঝড় হলেই নাকি গাছের ডাল ভেঙে পড়তে পারে।

পাহাড় ভেদ করেই তৈরি হয়েছে হাইওয়ে।

আচ্ছা ছাঁদনাতলাটা এমনই কোনো পুরোনো গাছের নীচে হয়নি তো?

আজকাল ডেসটিনেশন ওয়েডিং বেশ নাম করেছে। এই রিসর্টেও এমনই এক বিবাহবাসরের আয়োজন হয়েছে। ছেলের নাম বিপুল, মেয়ের নাম ময়ূরী। বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাদের কটেজের পাশেই একটা জায়গায় বেশ ধুমধাম করে আয়োজন করা হয়েছে সব কিছুর।

বিকেলে গায়েহলুদ হয়েছে। এখন সংগীত আর মেহেন্দির পার্টি হচ্ছে। ব্যান্ডপার্টি গোয়ান সুর তুলেছে। দারুণ একটা পরিবেশ হয়ে রয়েছে। আগামীকাল বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়বে ওরা দু’জন। বিপুল আর ময়ূরীর আসন্ন জীবন খুব ভালো কাটুক। আমিও চেষ্টা করি আমার মহারাষ্ট্র ভ্রমণের এই গল্পগাথাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। (চলবে)

ছবি: লেখক

আরও পড়ুন

মরাঠাভূমে আবার: পর্ব ১

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ২: মায়ের ইচ্ছাপূরণ

মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৩: ঘৃষ্ণেশ্বর হয়ে কৈলাশে 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *