মরাঠা ভূমে আবার, পর্ব ৭: একের পর এক সৈকত দর্শন
শ্রয়ণ সেন
দুপুরে পেট ভরে মাছভাত খেলে মনটার একটু ভাতঘুম দিতে ইচ্ছে করে বই-কি! তাই যখন দুপুর আড়াইটের সময়ে আমাদের সারথি ফোন করে বলল, সে এসে গেছে, নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল। কেন দুপুরে বেরোব ঠিক করেছিলাম?
যা-ই হোক, ল্যাদ কাটিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা হলাম কোঙ্কোণ উপকূলের নতুন এক অফবিট গন্তব্যের উদ্দেশে।
তারকারলি থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে কুঙ্কেশ্বর। জায়গাটা সম্পর্কে জেনেছিলাম বছর ছয়েক আগে, মহারাষ্ট্র পর্যটনের ওয়েবসাইট ঘাঁটতে ঘাঁটতে। তখনই খুব পছন্দ হয়েছিল কুঙ্কেশ্বরকে। কিন্তু আজ ওখানে গিয়ে বুঝলাম, ছবির থেকেও বেশি সুন্দর এই কুঙ্কেশ্বর।

মন্দিরচত্বর থেকে কুঙ্কেশ্বর সৈকত।
তবে তার আগে পথের সৌন্দর্যের ব্যাখ্যাও করতে হয়। পশ্চিমঘাটের কোল বেয়ে ওঠানামা রাস্তা এগিয়ে গিয়েছে। সমুদ্রের এত কাছে পাহাড়ি ঘাটরাস্তা বোধহয় এই মহারাষ্ট্র উপকূলেই দেখা যায়। তিনটে নদীও পড়ল, এইগুলো সবই সমুদ্রপুষ্ট ব্যাকওয়াটার।
কুঙ্কেশ্বরের অবস্থানটা স্বপ্নের মতো। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এখানে সোজা আরব সাগরে গিয়ে মিশেছে। তৈরি হয়েছে একটা সুন্দর সমুদ্রসৈকত। আর তার ঠিক ধারেই রয়েছে অপূর্ব সুন্দর এক মন্দির। মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতা শিব। তবে মন্দিরের গঠনশৈলী ভীষণভাবে আকর্ষণ করল। গোয়ান গঠনশৈলী রয়েছে মন্দিরে। তবে সেটাকে গোয়ান না বলে কোঙ্কণী বলা ভালো।

কুঙ্কেশ্বর মন্দির।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ এই মন্দির তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। মন্দিরের পরিবেশ ভীষণই শান্ত। মহাদেব এখানে স্বয়ম্ভু। একেবারে গর্ভগৃহে প্রবেশ করে মহাদেবকে ছোঁয়া যায়।
এখানে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে তারকারলি ফেরার পথ ধরার সময় ভাবছিলাম, এখানে একটা রাত থাকলে বেশ হতো।

তারকারলি ফেরার পথে নাম-না-জানা নদী।
কুঙ্কেশ্বর থেকে ফিরতে ফিরতে ঠিক করে নিলাম, কাল আর দুপুরের পর নয়, সকালেই বেরিয়ে পড়ব এবং রিসর্টে ফিরে এসে লাঞ্চ করে বিশ্রাম নেব। সেইমতো সারথিকে জানিয়েও দিলাম।
সকাল-সকালই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। সমুদ্রের ধারে এই রিসর্টের চত্বরটা এমনই যে এখানে হেঁটে বেড়ালেই সময় কেটে যায়। প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। কাল গিয়েছিলাম তারকারলির উত্তরে। আজকের গন্তব্য দক্ষিণ। রিসর্ট থেকে বেরিয়েই পাহাড়ি পথ শুরু হয়ে গেল। মহারাষ্ট্র উপকূলের এই হল মজা। এখানে যতটা সমুদ্র ঠিক ততটাই পাহাড়। পাহাড়ি পথ ধরে যেতে যেতে বুঝতেই পারবেন না যে আপনি সমুদ্রের সঙ্গে একেবারে সমান্তরাল ভাবে চলেছেন।

কারলি নদী।
এর মধ্যেই দেখা পেলাম কারলি নদীর। কিছুক্ষণের জন্য সঙ্গী হল সে। কেরালার মতো অসংখ্য ব্যাকওয়াটার রয়েছে এই দক্ষিণ মহারাষ্ট্র উপকূলে। কারলি নদীও সেই রকমই। নদীর ওপর সেতু পেরিয়ে এগোতে থাকলাম। পথেই পড়ল নতুন তৈরি হওয়া সিন্ধুদুর্গ বিমানবন্দর। আমরা যাচ্ছি বেঙ্গুরলা।

বেঙ্গুরলা সৈকত।
ঘন্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে বেঙ্গুরলা পৌঁছোতেই মোহিত হয়ে গেলাম জায়গাটার সৌন্দর্য দেখে। দাভোলি, তুলাস আর মোচেমার – উত্তর, পূর্ব আর দক্ষিণে এই তিন পাহাড় আর পশ্চিমে আরব সাগরকে কেন্দ্র করে রয়েছে বেঙ্গুরলার সমুদ্রসৈকত। এখানে সাগরের নীল জলরাশি থেকে বেরিয়েছে মন্দভি নদী (গোয়ার মান্ডবী নদী এটা নয়)। নদীর ওপর একটা ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে নামলাম সৈকতের বালিরাশির ওপরে।
সৈকতে লোকজনের আনাগোনা বিশেষ নেই। তবে রোদের তেজ যা সাংঘাতিক, তাতে লোকজন এই সময়ে ঘুরতে আসবে, এটা ভাবাও যায় না।

সাগরেশ্বর মন্দির।
এই সৈকতের লাগোয়া সৈকতের নাম সাগরেশ্বর সৈকত, যার নামকরণ হয়েছে সাগরেশ্বর মহাদেবের নাম থেকে। সৈকতের গায়েই রয়েছে এই মন্দির। মন্দিরটাকে বাইরে থেকে দেখলে কোনো মন্দির মনেই হবে না। কোঙ্কণী ঘরানার টালির চালের এক বাড়ি। ভীষণ শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ।
বেঙ্গুরলা সৈকত ও সাগরেশ্বর মন্দির দেখে তারকারলি ফেরার পথ ধরলাম। পথে পড়ল আরো এক অজানা সৈকত, কাবানে। এর সৌর্ন্দযও অতুলনীয়। পাহাড় আর ব্যাকওয়াটারকে কেন্দ্র করেই হয়েছে এই সৈকত।

কাবানে সৈকত।
আসলে এই অঞ্চলে পরতে পরতে রয়েছে একের পর এক সুন্দর সৈকত। এ বলে আমায় দেখো তো ও বলে আমায়! কিন্তু সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে হলে অন্তত দুটো দিন হাতে রাখতেই হবে। কিন্তু আমাদের অত সময় নেই, তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরতে হল। কারণ পমফ্রেট মাছ আর দুপুরের ঘুম অপেক্ষা করছিল যে। (চলবে)
ছবি: লেখক
আরও পড়ুন
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ২: মায়ের ইচ্ছাপূরণ
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৩: ঘৃষ্ণেশ্বর হয়ে কৈলাশে
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৪: শিরডী থেকে কারলায়