আজকের দিনে যেখানে প্রতিটি নির্মাণ ভাঙে ছ’মাস অন্তর, সেখানে শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতের প্রাচীন মন্দিরগুলো যেন এক নিঃশব্দ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় আমাদের আধুনিকতার সামনে। এগুলো শুধু ইট-পাথরের গাঁথুনি নয়, এক একটি দর্শনের বহিঃপ্রকাশ, বিশ্বাসকে বাস্তবে পরিণত করার প্রমাণ।
কৈলাস মন্দির, এলোরার উপকণ্ঠে, একটি পাহাড় খোদাই করে সম্পূর্ণ তৈরি। উপর থেকে নিচে, একটিই পাথর। কোনো জোড়া নয়, কেবল অপসারণ। এই মন্দির শিখিয়ে দেয়, কখনও কখনও শ্রেষ্ঠত্ব আসে কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে—অহংকার, অতিরিক্ততা, অপ্রয়োজনীয় সবকিছু বাদ দিয়ে।
বৃহদেশ্বর মন্দির, তাঞ্জাভুর, ৮০ টন ওজনের শিখরখণ্ড ২১৬ ফুট উঁচুতে তোলা হয়েছিল এক কিলোমিটারের র্যাম্প বানিয়ে, হাজার হাজার মানুষের হাতে। আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই এই কাজ সম্ভব হয়েছিল, কারণ তখন প্রশ্ন ছিল না “সম্ভব কি?”, বরং এক শাসকের অটল বিশ্বাস ছিল ‘এটা হবেই।’
মীনাক্ষী মন্দির, মাদুরাই—একটি রঙিন, জটিল, প্রাণবন্ত সৌন্দর্য। প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি ইঞ্চিতে আছে কাহিনি, শিল্প, স্পন্দন। এই মন্দির জীবনকে তার সমস্ত বিশৃঙ্খলা ও আবেগসহ গ্রহণ করে এবং সেগুলিকেই সৌন্দর্যে পরিণত করে।
কোনার্ক সূর্য মন্দির, ওড়িশা, সূর্যদেবের রথ হিসেবে নির্মিত, যার চাকাগুলি সূর্যঘড়ির মতো কাজ করে—প্রতিটি মুহূর্ত নির্ভুল। এটি প্রমাণ করে, প্রাচীন ভারতে বিশ্বাস মানেই তা অন্ধ নয়, বরং বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা এবং স্পষ্টতায় সেই বিশ্বাস ছিল জারিত।

লেপাক্ষী মন্দির, অন্ধ্রপ্রদেশ—একটি স্তম্ভ মাটিতে স্পর্শই করে না। কেমন করে সম্ভব, তা আজও রহস্য। কেউ বলে কৌশল, কেউ বলে অলৌকিকতা। কিন্তু মন্দির নিজে কিছু বলেনা, কেবল বিস্ময়কে জায়গা দেয়।
রণকপুর জৈন মন্দির, রাজস্থান—১,৪৪৪টি স্তম্ভ, একটিও অন্যটির অনুরূপ নয়। এই মন্দির আমাদের শেখায়, শ্রদ্ধা সবসময় উচ্চকণ্ঠে আসে না। কখনও তা থাকে নিঃশব্দে, নিখুঁত কারুকার্যে।
রমেশ্বরম মন্দির, তামিলনাড়ু, সমুদ্রপৃষ্ঠে, লবণাক্ত বাতাসের ধাক্কায়। তবুও দাঁড়িয়ে। কারণ কিছু কিছুর অর্থ পেতে গেলে দূর যেতে হয়, সংগ্রাম করতে হয়। সেই অর্থেই এই মন্দির দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে।
এই সব মন্দির একবারেই নির্মিত হয়নি। এগুলো ছিল ইচ্ছাশক্তির ফসল। হাজারো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা এই মন্দিরগুলো আজও বলে—”যা হৃদয় থেকে নির্মিত, তা কালজয়ী হয়।”
এই তালিকা কেবল মন্দিরের নাম নয়, বরং অতীত থেকে আসা এক গভীর প্রশ্ন: তুমি কী এমন কিছু তৈরি করছো, যা তোমার বেঁচে থাকার অনেক পরেও থেকে যাবে?