মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৫: পাওনা লেক দেখে লোনাভালায়
শ্রয়ণ সেন
মন্দার বোস যেমন রাজস্থান দেখে বলেছিলেন, এরা কি যেখানে পেরেছে একটা করে ফোর্ট বানিয়ে রেখেছে? ঠিক একই কথা মহারাষ্ট্রের জন্যও প্রযোজ্য! এখানেও বিভিন্ন জায়গায় ফোর্ট দেখতে পাওয়া যায়। যেমন কারলাতে আমাদের রিসর্টের কাছেই রয়েছে লোহাগড় ফোর্ট।
তবে শুধু ফোর্ট না, মহারাষ্ট্রে হ্রদের আধিক্যও রয়েছে বেশ ভালোই। বিশেষ করে সহ্যাদ্রি পর্বতের কোনায় কোনায় এমনই অসংখ্য লেকের সন্ধান পাওয়া যাবে। প্রাতরাশ সেরে সক্কাল সক্কাল সে রকমই একটি অনামী লেকের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। পাওনা লেক। এই লেকের কথা আমি আমার এক দিদির কাছে শুনেছি। মুম্বই থাকাকালীন ওরা ঘুরে গিয়েছিল এই পাওনা লেকে। ও বলেছিল, কারলায় তোরা কোথাও যাস আর নাই যাস, পাওনা যাবিই। এর বিশেষত্ব হল নির্জনতা। ভালো লাগবেই। আর পাওনা লেকে যাওয়ার ব্যাপারে আরও বেশি করে উৎসাহ দিল আমার সদ্যপরিচিত এক বন্ধু।
তবে শুধু পাওনাই নয়, আজ আমাদের আরও কিছু দেখার আছে – পাওনা লেকের পরে লোনাভালা এবং শেষে কারলা ও ভাজা গুহা।
কারলায় মহারাষ্ট্র পর্যটনের রিসর্টটি মূল সড়ক থেকে একটু ভিতরে। রিসর্টের ফটকে গিয়ে রাস্তা শেষ হয়েছে। এই রাস্তাটিও ভারী সুন্দর। গাছগাছালিতে ছাওয়া এই রাস্তায় ভোরবেলায় বাবাকে নিয়ে ‘মর্নিং ওয়াক’ করে এসেছি।

পাওনা লেক থেকে অদ্ভুতদর্শন পাহাড়।
রিসর্ট থেকে বেরিয়ে সেই রাস্তা ধরেই পড়লাম মুম্বই-পুণে পুরোনো হাইওয়েতে। তার পর পুণের দিকে এগিয়ে চললাম। কিছুটা গিয়ে কামশেঠ। সেখান থেকে ডান দিকে ছোটো একটা রাস্তা ধরলাম। পথের সৌন্দর্যে বার বার মোহিত হয়ে যেতে হচ্ছে। এই অঞ্চলে বর্ষা সবে শুরু হয়েছে। নতুন বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে চারিদিক ভীষণরকম সতেজ হয়ে উঠেছে। স্বল্প উচ্চতার পাহাড়ের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি। মাঝেমাঝে এক-একটি জনপদ আসছে। কিছুটা ব্যস্ততা। তার পর আবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর নিরিবিলি পথ।
পাওনার দেখা পেলাম কিছুটা গিয়েই। চারিদিকে ঘেরা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে পাওনা লেক উঁকি দিতেই অদ্ভুত একটা ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল। আমাদের পথের ডান দিকে সেই লেক। এবার গাড়ি থামলেই হয়। কিন্তু গাড়ি আর থামছে না। নিশ্চয়ই কোনো ভিউ পয়েন্ট আছে, মনে মনে ভাবি। পথের বাঁ দিকে স্বল্প উঁচু পাহাড়ের গায়ে দু-একটা রিসর্টও চোখে পড়ছে। অবশেষে পৌঁছোলাম ফাগণে গ্রামে। একেবারে লেকের ধারে এই গ্রাম। আর গ্রাম পেরিয়েই আমাদের গাড়ি ডান দিকে পথের ঢাল ধরে নেমে এল লেকের প্রায় পাড়ে। কারলা থেকে খুব বেশি দূর আসিনি। গুগুল ম্যাপ বলছে সাড়ে ২৭ কিলোমিটার।
পাওনা লেকে না এলে একটা অসাধারণ স্থান দেখা থেকে বঞ্চিত থাকতে হত। পুনে জেলার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া পাওনা নদীকে বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে পাওনা লেক। গাড়ি থেকে নেমে উঁচুনিচু পাথুরে পথ ধরে হেঁটে পৌঁছে গেলাম লেকের একদম ধারে। পাহাড় দিয়ে ঘেরা পাওনা লেক আমাদের মাইথন-ম্যাসাঞ্জোরের কথা মনে করিয়ে দেয়। খুব মিল আছে। ফুরফুরে হাওয়া আর লেকের শান্ত ঢেউয়ে মন উতলা হয়ে উঠছিল। এখন লেকের জল কিছুটা কম। তবে বৃষ্টি বাড়লে জল ভরলে এর রূপ আরও খোলতাই হয়। দেখছি, লেকের ধারেই রাত্রিবাস করা যায়। অনেক টেন্ট অ্যাকমোডেশন রয়েছে এখানে।

এই পাহাড়েই রয়েছে সেই পথ, যেখান থেকে নেমে এলাম পাওনার ধারে।
পাওনা লেকে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে চললাম লোনাভালার পথে। লক্ষ্য টাইগার পয়েন্ট। পাওনা লেককে বেড় দিয়ে চলেছি। আমাদের ডান দিকে সে রয়েছে। স্বল্প উচ্চতার পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলা। রাস্তায় গাড়িঘোড়া বিশেহ নেই। মাঝে মাঝে অনামী জনপদ। নির্জনতাই এই পথের সম্পদ। ধীরে ধীরে পথে লোকজন বাড়তে লাগল। রাস্তার ধারে গাড়ি পার্কিং করা। বুঝলাম উদ্দিষ্ট স্থানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সারথি বাঁ দিকে একটা পাথুরে মাঠে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। আরও কিছু গাড়ি পার্ক করা আছে। এটা তো টাইগার পয়েন্ট নয়। আমরা আগেও মুম্বই থেকে এখানে এসেছি। জায়গাটা কিছু কিছু চিনি। সারথিকে বলতেই ওঁর কথা, “এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটান, টাইগার পয়েন্টে নিয়ে যাব।” হয়তো এ কথা বলে উনি মনে মনে হেসেছিলেন। গাড়ি থেকে নেমে একটু ঘোরাঘুরি করতেই বুঝলাম এই জায়গাটার নাম শিবলিঙ্গ পয়েন্ট। সামান্য হেঁটে একেবারে খাদের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। কাছে-পিঠে-দূরে অজস্র ছোটো-বড়ো পাহাড়। অদ্ভুত আকারের সব শিখর। তারই মধ্যে একটি পাহাড়ের মাথায় দেখলাম পুরো শিবলিঙ্গ। বুঝলাম, কেন এই জায়গার নাম শিবলিঙ্গ পয়েন্ট। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমেছে অনেক ঝরনা।
বেশ কিছুক্ষণ সময় শিবলিঙ্গ পয়েন্টে কাটিয়ে চললাম টাইগার পয়েন্টের দিকে। কাছেই টাইগার পয়েন্ট। কিন্তু গাড়ি আর এগোতে চায় না। মানুষের ভিড়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। মনে পড়ে গেল আজ তো রবিবার। কয়েকটা দিনের জন্য বেড়াতে বেরোলে বার-তারিখ সব গুলিয়ে যায়। টাইগার পয়েন্টে তিলধারণের জায়গা নেই। মুম্বই-পুণে থেকে সবাই চলে এসেছে ছূটির দিনটা কাটাতে। এমনই এক রবিবারে আমরাও তো মুম্বই থেকে এসেছিলাম এই লোনাভালা-খান্ডালায়।

দর্শন হল শিবলিঙ্গের।
সারথি জিগগেস করলেন, টাইগার পয়েন্টে আমরা নামব কি না। কোনো প্রশ্নই নেই। বুঝলাম, সারথি কেন আমাদের শিবলিঙ্গ পয়েন্টে নামিয়েছিলেন। ওখানে ভিড় যেমন কম এবং ভিড় কম বলেই জায়গাটা অনেকটাই পরিষ্কার। আর দৃশ্যেও কোনো ফারাক নেই। আসলে মুম্বই-পুণে থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁরা প্রথমেই পাচ্ছেন টাইগার পয়েন্ট। তাই সেখানেই গাড়ি রেখে ঘোরাঘুরি করছেন। আমরা এলাম উল্টো দিক থেকে, কম পরিচিত রাস্তা ধরে। তাই সুযোগ পেয়ে গেলাম শিবলিঙ্গ পয়েন্ট থেকেই যা কিছু দেখার।
কারলা আর ভাজা গুহা আমাদের রিসর্টের কাছেই। কিন্তু সেই রাস্তায় প্রবল জ্যাম। ঘড়িতে এখনই সাড়ে তিনটে। গুহা দেখে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। এ দিকে পেটেয় ছুঁচো ডন মারছে। দুপুরের খাওয়া এখনও হয়নি। ফিরে এলাম রিসর্টে।
রিসর্টে ফিরে এসে দেখলাম ময়ূরী আর বিপুলের বিবাহপর্ব মিটেছে। ব্যান্ডে বাজতে থাকা মরাঠি আর কোঙ্কনি সুরে নাচতে ইচ্ছে করছিল খুব। সে ইচ্ছা সংবরণ করলাম। বিবাহবাসর শেষে আগামীকাল ওরা ফিরে যাবে নিজেদের বাড়ি। আমরাও যাত্রা করব পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে। (চলবে)
ছবি: লেখক
আরও পড়ুন
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ২: মায়ের ইচ্ছাপূরণ