মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৮: ভালো থেকো তারকারলি
শ্রয়ণ সেন
তারকারলির নাম নিলেই প্রথমে যেটা মাথায় আসে, এরকম মিহি বালির সমুদ্রসৈকত ভারতে খুব কমই আছে। এই কারণেই অনেক ক্ষেত্রে একে ‘ট্যালকম পাউডার সিবিচ’ও বলা হয়। যা কানে শুনেছি, বা বই-পত্রপত্রিকায় পড়েছি, আজ চোখে দেখে তা মালুম হল। সত্যিই তারকারলি মিহি বালির সৈকত।
ষোলো বছর আগে যখন মহারাষ্ট্র ভ্রমণে এসেছিলাম, তখন এই কোঙ্কণ উপকূলে গণপতিপুলে পর্যন্ত নেমে ফিরে গিয়েছিলাম মুম্বইয়ের দিকে। তারকারলি অনেকটা দক্ষিণে হওয়াতে বাদ রাখতে হয়েছিল সে বার। কিন্তু মনে মনে একটা অতৃপ্তি থেকে গিয়েছি। ফলে এই তারকারলিতে একবার আসার সুপ্ত বাসনা মনের মধ্যে ছিলই।
সেই সুপ্ত বাসনা মায়ের জন্যই পূরণ হল এবার। মা বলল, শিরডি যাব সাইবাবাকে দর্শন করতে। মাকে সাইবাবা দর্শন করাতে এত দূর আসব, অথচ মহারাষ্ট্রের আরও কিছু জায়গা ঘুরব না, সে তো হতে পারে না। কারণ রথ দেখার সঙ্গে কলা বেচাই আমাদের ধর্ম। তাই যা ছিল শিরডি দর্শন, সেটাই দাঁড়িয়ে গেল ইলোরা, কারলা, তারকারলি, মুম্বই ভ্রমণে।
গত পরশু বিকেলে তারকারলি পৌঁছোতেই একরাশ ভালোলাগা ছুঁয়ে গিয়েছিল আমাকে। মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের রিসর্টের লাগোয়া সমুদ্রসৈকত। এটাকে রিসর্টের নিজস্ব বিচ বলাই যায়। দিগন্তবিস্তৃত মিহি বালিরাশি, তীব্র হাওয়ার কারণে ভেসে বেড়াচ্ছে।
দূরে দেখা যাচ্ছে সিন্ধুদুর্গ। মহারাষ্ট্রের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা দুর্গের অন্যতম এই সিন্ধুদুর্গ। আরব সাগরের মাঝে অবস্থিত এই দুর্গ তৈরি করেন শিবাজী, ১৬৬৪ সালে। সাগরের মাঝে হওয়ার ফলে এখানে যেতে হয় নৌকায়। এখন অবশ্য বর্ষা, তাই নৌকা পরিষেবা বন্ধ আছে।

আরব সাগরের ধারে এমটিডিসির তারকারলি রিসর্ট।
বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। সূর্য তখন পাটে নামার তোড়জোড় শুরু করেছে। সময়টা বর্ষাকাল, কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টিও হয়েছে। কিন্তু তার পরেও সূর্যাস্তের এমন অসাধারণ মুহূর্ত তৈরি হবে, ভাবতেও পারিনি। প্রথম মুহূর্তেই তারকারলি ভালো লেগে গেল। বুঝতে পারলাম কেন এই সৈকতের এত নাম। তবে নাম হলেও এর পরিচিতি কিন্তু মহারাষ্ট্রের বাইরে খুব একটা ছড়িয়ে পড়েনি। তাই এখনও ভ্রমণপাগল বাঙালির পা সে ভাবে পড়ে না এখানে। টুরিস্ট যাঁরা এখানে আসেন, তাঁরা মূলত স্থানীয় মানুষজন।
মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের রিসর্টগুলো আমার দুর্দান্ত লাগে, মূলত তাদের অবস্থানগত কারণে। বিশেষ করে, সমুদ্রসৈকতের রিসর্টগুলোর তো কোনওম তুলনা নেই। সরকারি রিসর্ট যে হেতু, সে হেতু একটু অব্যবস্থা তো থাকবেই। কিন্তু সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে এই রিসর্টগুলোর অবস্থানটা অনুভব করতে হয়। এমন সুন্দর লোকেশন পাওয়া দুষ্কর।
আমরা উঠেছি তারকারলি রিসর্টের কোঙ্কণী প্রিমিয়াম কটেজে। এগুলো স্যুট রুম। কটেজে ঢুকলে প্রথমেই একটা ছোটো বারান্দা। তার পর ছোটো বসার ঘর, তার পর বেডরুম। বসার ঘরের সোফায় বসে বসেই সমুদ্র দেখে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। আর বারান্দা তো আছেই। এখান থেকে অবাধ দৃষ্টি চালিয়ে সখ্যতা পাতা যায় সমুদ্রের সঙ্গে। ক্লান্তিহীন সমুদ্রের ঢেউভাঙা দেখতে দেখতেই হঠাৎ করে সন্ধ্যা নেমে যায়। মিশমিশে অন্ধকারে ঢেকে যায় চারপাশ। সাগরকে আর হয়তো আর চোখে দেখা যায় না, তবে তার গর্জন শোনা যায়, তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। তবে জ্যোৎস্নারাত হলে তো কথাই নেই। তার সৌন্দর্য অনন্য।
এ ভাবেই তিনটে দিন কাটিয়ে দিলাম তারকারলিতে। ঘরে বসেই আরব সাগরে দুর্দান্ত সূর্যাস্ত দেখলাম, সুন্দর ঝড়বৃষ্টি দেখলাম, পমফ্রেট মাছ দিয়ে দুরন্ত মালভানি থালি খেলাম, প্রাণভরে ল্যাদ খেলাম আর অবশ্যই ঘুরলাম। তিন তিনটে দিন কোথা দিয়ে কেটে গেল, টেরই পেলাম না।
দেখতে দেখতেই তারকারলিকে বিদায় জানানোর সময় হয়ে এল আর আমাদের ভ্রমণের শেষ লগ্নও প্রায় চলে এল। ফিরে চললাম মুম্বইয়ের পথে, সেই মান্ডবী এক্সপ্রেসে। ভালো থেকো তারকারলি। দেখা হবে খুব তাড়াতাড়ি। (চলবে)
ছবি: লেখক
আরও পড়ুন
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ২: মায়ের ইচ্ছাপূরণ
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৩: ঘৃষ্ণেশ্বর হয়ে কৈলাশে
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৪: শিরডী থেকে কারলায়
মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ৫: পাওনা লেক দেখে লোনাভালায়