বিপর্যয়ের পরে উত্তরবঙ্গে পর্ব ২: মিম থেকে ঘুরে এলাম নেপাল
শর্মিষ্ঠা সেন
ঘুম ভাঙল বেশ সকালেই। মেঘের আড়াল সরিয়ে সূর্য দেখা দিল। ধীরে ধীরে রোদটা বেশ আরামদায়ক হয়ে উঠল। প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম কন্যামের পথে।
কন্যাম। নামটা নিশ্চয় খুব পরিচিত মনে হচ্ছে না? পরিচিত হওয়ার কথা নয়। কারণ এটা দার্জিলিং পাহাড়ের গন্তব্য নয়। কন্যাম নেপালের। এবং নেপালের এই গন্তব্য ইদানীং নাম করেছে। ভারত-নেপাল সীমান্তের পশুপতি ফটক থেকে কন্যাম ১৭-১৮ কিমি। আমাদের ভারতের দিকের গাড়ি নেপালে প্রবেশের অনুমতি পায় উপযুক্ত দক্ষিণা দিয়ে। এই সুবিধাটুকু মিলছে বলেই মিম থেকে কন্যাম ঘুরে আসার পরিকল্পনা করা হয়েছে। নেপালের ভেতরে প্রায় ২০ কিলোমিটার চলে যাওয়া মানে খুব একটা বুড়িছোঁয়া নয়। ভালোই দেখা হবে নেপাল।
ফের সেই হজমোলা রোডে। নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছি। এই পথে মাঝেমাঝেই বেশ জঙ্গলও রয়েছে। তারই উপহার পেলাম একটু। বেশ কয়েকটা বনমোরগ আর বনমুরগি দর্শন দিল। বনমোরগগুলো ছোটখাটো ময়ূরের মতো। মন ভরে গেল। সাত কিলোমিটারের পথ পেরোতে আধঘণ্টা সময় লাগল। পড়লাম ঘুম-মিরিকের পথে।
ডানদিকে ঘুরে কিলোমিটার দুয়েক যেতেই পৌঁছে গেলাম সুখিয়াপোখরি। বেশ জমজমাট জায়গা। একটু এগোতেই বাঁদিকের রাস্তা নেমে গিয়েছে তাবাকোশির দিকে। বালাসনের ধারে তাবাকোশির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে চার তারিখের বিপর্যয়ে। ফুঁসে ওঠা বালাসন অনেক কিছুই ভাসিয়ে নিয়েছে তাবাকোশির। যাই হোক, আর একটু এগোতেই রাস্তা দু’ভাগ। ডানদিকের পথ চলে গিয়েছে মানেভঞ্জং হয়ে সন্দকফু। আমরা ধরলাম বাঁদিকের পথ। এই পথ গিয়েছে সীমানা, পশুপতি ফটক, মিরিক হয়ে শিলিগুড়ি। এখন অবশ্য শিলিগুড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ দুধিয়ায় বালাসনের সেই ব্রিজ ভাঙা। এগিয়ে চললাম পশুপতির দিকে।

এই পথে আমাদের গন্তব্য পশুপতি ফটক পর্যন্ত। তার পরে ঢুকে যাব নেপালের অন্দরে। সুখিয়া থেকে ৫ কিলোমিটার আসতে পৌঁছে গেলাম সীমানায়। এই জায়গা শুধু নামেই সীমানা নয়, প্রকৃতপক্ষে সীমানাই — ভারত-নেপাল সীমান্ত। তবে এই সীমানা দিয়ে নেপালে প্রবেশের কোনো পথ নেই। এখান থেকে মিরিকগামী রাস্তাটির ডানদিকটা মাঝেমাঝেই নেপালের মধ্যে পড়ছে। তাই রয়েছে সশস্ত্র সীমা বলের চৌকি। সীমানায় রয়েছে ভিউ পয়েন্ট। সুন্দর দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘাও। স্পষ্ট দেখা যায় পাহাড়শীর্ষে সন্দকফুও। শর্ত একটাই, মেঘ থাকলে চলবে না। ভাগ্য আমাদের খারাপ। কাঞ্চন তো দুরস্থান, সন্দকফুকেও বুঝতে পারলাম না।
সীমানা থেকে পথ ক্রমশ নামতে শুরু করল। বেশ কয়েকটা বাঁক নেমে আরও ৫-৭ কিলোমিটার পথ এসে পৌঁছে গেলাম পশুপতি ফটক। এখানেই নেপালের সঙ্গে সীমান্ত। পশুপতি জায়গাটা আদতে নেপালে। এখান থেকে কিলোমিটার দুয়েক দূরে পশুপতি মার্কেট। একসময়ে এই পশুপতি ফটক দিয়ে ভারতের গাড়ি ঢোকার অনুমতি ছিল না। পশুপতি মার্কেট যেতে হলে এখান থেকে লোকাল গাড়ি করতে হত। যাই হোক, প্রথমে সশস্ত্র সীমা বলের জওয়ানরা আমাদের পরিচয়পত্র দেখলেন। তার পর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ নামধাম লিখিয়ে সই করাল। নেপাল পুলিশের হ্যাপা কম। ওরা ঋভুর সঙ্গে নামমাত্র কথা বলে নিল। এর পর দু’জায়গায় মোট ৮০০ টাকা দক্ষিণা দিয়ে এগিয়ে চললাম কন্যামের পথে।

পথে পড়ল বুদ্ধ পার্ক। পাহাড়ের মাথায় বিশাল বুদ্ধমূর্তি। ঢাল বেয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে পাহাড়শীর্ষে। ওপর থেকে চারদিকের দৃশ্যাবলি অদ্ভুত সুন্দর। নজর চলে গেল ওদিকের পাহাড়ে। চা-বাগানের মাঝ দিয়ে সিঁড়ি পৌঁছে গিয়েছে পাহাড়ের টঙে। দুই পাহাড় যুক্ত পায়ে চলা লোহার ব্রিজ দিয়ে। চলে গেলাম ও পারের পাহাড়ের মাথায়। আবার যথারীতি চোখ চালিয়ে দিলাম চারদিকে। আশেপাশের সমস্ত পাহাড়ের ঢালে চা-বাগান। বুঝলাম, পূর্ব নেপালে চায়ের চাষ ভালোই হয়।

খানিকক্ষণ চা-পানের বিরতি দিয়ে আবার যাত্রা শুরু। রাস্তা সুন্দর, মসৃণ। এঁকেবেঁকে, চড়াই-উতরাই ভেঙে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। এটি কাঠমান্ডু রোড। এখান থেকে রাজধানীর দূরত্ব ৫০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। শান্ত, নিরিবিলি গ্রামীণ নেপাল। মাঝে মাঝে শহর — বরবাটো, ফিক্কল। জমজমাট শহর, কিন্তু সুশৃঙ্খল। দেখে বোঝার উপায় নেই, কিছু দিন আগেই জেন জি আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল নেপাল। সরকার বদল হয়েছে।

চার তারিখের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাদ যায়নি নেপালও। বরং এখানে বিপর্যয় আরও বড়ো আকার নিয়েছিল। সেই বিপর্যয়ের চিহ্ন রয়েছে এখানেও। পাহাড়ের গা বেয়ে ধস নেমেছে বহু জায়গায়। তার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হলেও এখন স্বাভাবিক। কন্যাম যত এগিয়ে আসছে, হোটেল-রিসর্ট-হোমস্টের সংখ্যা তত বাড়ছে। কন্যাম যে ক্রমশই জনপ্রিয় পর্যটন-গন্তব্য হয়ে উঠছে, এটিই তার প্রমাণ।

অবশেষে পৌঁছোলাম কন্যামে। বেশ চওড়া রাস্তা। তার দু’পাশে বেশ কিছু ভিউ পয়েন্ট। ভিউ পয়েন্টগুলো রাস্তার ধারেই। গাড়ি পার্ক করে আশেপাশের দৃশ্য দেখা হল। অজস্র পাহাড় আর প্রতিটির ঢালে চা-বাগান। চোখ জুড়িয়ে যায়। এমনই একটি ভিউ পয়েন্টে আমাদের তিনজনের ছবি তুলে দিলেন আমাদের সারথি রবার্ট। ফেরার পথে নজরে পড়ল আর একটি ভিউ পয়েন্ট, পাহাড়শীর্ষে। বেশ উঁচুতে। তবে ওঠার জন্য রয়েছে বাঁধানো সিঁড়ি। শ’দুয়েক ধাপ তো হবেই। এই ভিউ পয়েন্টও বাদ থাকল না আমাদের দর্শন থেকে। কন্যাম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘারও দুর্দান্ত দর্শন মেলে। কিন্তু এই ভ্রমণে যা চলছে, তাই ঘটল। কাঞ্চন চোখের আড়ালেই থাকলেন। ফিরে চললাম মিম। পথে বরবোটার বুদ্ধমন্দিরে প্রণাম করলাম বুদ্ধদেবকে। (চলবে)

ছবি: শ্রয়ণ সেন
আরও পড়ুন: বিপর্যয়ের পরে উত্তরবঙ্গে পর্ব ১: ধ্বংসের চিহ্নের মাঝেই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে পাহাড়