চলুন সড়কপথে: জয়পুর থেকে জৈসলমের
ভ্রমণ অনলাইন ডেস্ক: সড়কযাত্রার মজাই আলাদা। তার ওপর আমাদের ভারতের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে সড়কভ্রমণের অন্য আকর্ষণও রয়েছে। এ দেশে এমন অনেক পর্যটককেন্দ্র রয়েছে, যেখানে পৌঁছোতে হয় সড়কপথে। এ ছাড়াও সড়কভ্রমণে গেলে এমন অনেক জায়গা দেখা যায়, যে জায়গায় সাধারণ পর্যটকদের পা পড়ে না। অথচ সেই সব অনাঘ্রাতা জায়গাগুলো এক কথায় অনবদ্য। যাই হোক, চলুন অতিপরিচিত, স্বল্পপরিচিত এবং একেবারেই অপরিচিত গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি সড়কভ্রমণে। সড়কভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে বিভিন্ন জায়গায় রাত কাটান, সেই সব জায়গা চিনুন, তার পর পৌঁছে যান অন্তিম গন্তব্যে। আজ সড়কযাত্রায় চলুন জয়পুর থেকে জৈসলমের।
উত্তর ভারতের রাজস্থান সড়কভ্রমণের আদর্শ রাজ্য। মসৃণ পথে গাড়ি করে যাওয়ার মজাই আলাদা। জয়পুর থেকে জৈসলমের যাওয়ার রাস্তা হল ১১ নম্বর জাতীয় সড়ক। তবে আমরা মাঝেমাঝেই প্রধান সড়ক থেকে বিচ্যুত হয়ে যাব, বিভিন্ন জায়গায় রাত কাটাব, জায়গাগুলো চিনব।
জয়পুর থেকে জৈসলমের নানা ভাবে যাওয়া যায়। নাগৌর হয়ে জাতীয় সড়ক ১১ ধরে সোজা চলে গেলে ৫৬০ কিমি দূরত্ব পড়ে। কিন্তু আমরা যাব একটু ঘুরে ঘুরে, দর্শনীয় স্থান দেখতে দেখতে। রাজস্থানের উল্লেখযোগ্য কিছু স্থানে রাত্রিবাস করে। তাই আমাদের পথ –

গুন্ডেলাও লেক, কিশনগঢ়।
জয়পুর-কিশনগঢ়-পুষ্কর-অজমের-জোধপুর-ওসিয়া-ফলোদী-রামদেওরা-জৈসলমের।
ভ্রমণসূচি
প্রথম দিন – আজ চলুন পুষ্কর পর্যন্ত। দূরত্ব ১৪২ কিমি। সকালেই বেরিয়ে পড়ুন।
পুষ্কর যাওয়ার পথে পড়বে কিশনগঢ়। জয়পুর থেকে ১০২ কিমি। ১৬০৩ সালে যারা কিষাণ সিংহের গড়া কিশনগঢ়। এখানে রয়েছে গুন্ডেলাও লেক, লেকের পাড়ে ফুলমহল প্রাসাদ তথা দুর্গ, কৃষ্ণমন্দির, মাঝেলা প্রাসাদ। আর রয়েছে কিশনগঢ় স্কুল অব আর্টস, বিশ্বজোড়া যার খ্যাতি। আর অবশ্যই দেখবেন কিশনগঢ়ের মর্মরের ভাস্কর্য।
কিশনগঢ় দেখে চলে আসুন পুষ্করে। কিশনগঢ়ের দ্রষ্টব্য দেখে পুষ্করে আসতে আসতে বিকেল হয়ে যাব। রাত্রিবাস পুষ্কর।

পুষ্কর সরোবর।
দ্বিতীয় দিন – আজ ঘুরে দেখুন পুষ্কর। মূল দ্রষ্টব্য পুষ্কর সরোবর। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর অর্থাৎ ত্রিদেবের যজ্ঞস্থল এই সরোবর। ৫২টি ঘাট রয়েছে এই সরোবরে। সরোবরের পশ্চিম দিকে ব্রহ্মাঘাটে ভারতে অন্যতম প্রাচীন ব্রহ্মা মন্দির। সরোবরের অপর পাড়ে সাবিত্রী পাহাড়। পাহাড়চুড়োয় ১৬৮৭-র সাবিত্রী মন্দির। মন্দিরে রয়েছেন ব্রহ্মার প্রথম স্ত্রী দেবী সাবিত্রী এবং বীণাহীন সরস্বতী। শিবও রয়েছে লিঙ্গে। সাবিত্রী পাহাড় থেকে চার পাশের দৃশ্যও সুন্দর। সাবিত্রী পাহাড়ে হেঁটে উঠতে পারেন। ব্রহ্মা মন্দির থেকে প্রায় ২ কিমি। প্রথমে কিছুটা বালির রাস্তা, তার পর ৩৬০ ধাপ সিঁড়ি। তবে রোপওয়েও রয়েছে পাহাড়ে চড়ার জন্য। রাত্রিবাস পুষ্কর।
তৃতীয় দিন – সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ুন পুষ্কর থেকে। অজমের হয়ে চলুন জোধপুর। মোট দূরত্ব ২২১ কিমি।
পুষ্কর থেকে অজমের ১৫ কিমি। আন্নাসাগর লেকের পাড়ে পাহাড়ে ঘেরা অজমেরের মূল দ্রষ্টব্য দরগা শরিফ। হিন্দু, মুসলিম তথা সর্বধর্মীর কাছে শ্রদ্ধেয় ১২ শতকের সুফি ধর্মগুরু খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির দরগা। দরগা থেকে ৫-৭ মিনিটের হাঁটাপথে ত্রিপোলিয়া গেট পেরিয়ে আড়াই-দিন-কা ঝোপড়া। কথিত আছে, দ্বাদশ শতকের এই ‘ঝোপড়া’ নাকি আড়াই দিনে তৈরি। সিলিং-এ সুন্দর কারুকাজ, ১২৪টি থামে ভর করে ১০টি গম্বুজ। এ ছাড়াও অজমেরে দেখার জন্য রয়েছে তারাগড় পাহাড়ের মাথায় মোগল স্থাপত্যের তারাগড় দুর্গ। ৩ কিমি খাড়া পথ বেয়ে ২০৫৫ ফুট উঠতে ঘণ্টাদেড়েক সময় লাগে। এ ছাড়াও দেখে নিতে পারেন ১৫৭০ সালে সম্রাট আকবরের গড়া প্রাসাদ, আজ যেটি মিউজিয়াম।
অজমের ঘুরে জোধপুরে পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে যাবে। রাত্রিবাস জোধপুর।

(পিছনে) মেহরনগড় ফোর্ট, (সামনে) যশবন্ত থাডা।
চতুর্থ দিন – আজ সারাদিন ঘুরে নিন জোধপুর। নীল শহর জোধপুরের আকর্ষণ বহুবিধ। প্রধান আকর্ষণ মেহরনগড় ফোর্ট। মান্ডোর থেকে রাজ্যপাট তুলে এনে এই জোধপুরে এই দুর্গ গড়েন রাও জোধা ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে। ৭টি পোল তথা গেট রয়েছে এই দুর্গে। দুর্গে বহু দ্রষ্টব্য। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, বৈভব, জাফরির কাজ অনবদ্য করে তুলেছে এই দুর্গকে। র্যামপার্ট থেকে পুরনো শহরের প্যানোরামিক ভিউ সুন্দর দৃশ্যমান। দুর্গের পাদদেশে মহারাজা দ্বিতীয় যশবন্ত সিংহের যশবন্ত থাডা তথা ছত্তিশ। জোধপুরের আর-এক আকর্ষণ শহরের এক প্রান্তে ছাত্তার হিলে ইটালীয় শৈলীতে তৈরি গোলাপি পাথরের উমেদ ভবন প্যালেস। প্রাসাদের এক অংশ জুড়ে মিউজিয়াম। উমেদ ভবন প্যালেসের কাছে মহারাজার রেলওয়ে ক্যারেজ। ১৮৩৬-এ উটে টানা রেলওয়ে ক্যারেজ দিয়ে জোধপুরে ট্রেনযাত্রার শুরু। কালে কালে স্টিম ইঞ্জিন আসে ১৯২৪-এ।
জোধপুর থেকে ৮ কিমি দূরে বালসমন্দ লেক পেরিয়ে পরিহার রাজপুতদের ৬ থেকে ১৪ শতকের রাজধানী মান্ডোর। সুসজ্জিত উদ্যানে মন্দিরের ঢঙে দেবল তথা ছত্তিশ অন্যতম দ্রষ্টব্য। আরও দ্রষ্টব্য রয়েছে এই মান্ডোরে। জোধপুরের আর-এক আকর্ষণ ১০ কিমি পশ্চিমে পর্যটকপ্রিয় কৈলানা হ্রদ। মরুরাজ্য রাজস্থানে এ এক আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য। রাত্রিবাস জোধপুর।

ওসিয়াঁর মন্দির।
পঞ্চম দিন – জোধপুর থেকে সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়ুন। চলুন ওসিয়াঁ হয়ে ফলোদী। জোধপুর থেকে ওসিয়া ৬৫ কিমি। সেখান থেকে ফলোদী ৭৫ কিমি। রাত্রিবাস ফলোদী।
হিন্দু ও জৈন ধর্মের ১৬টি মন্দিরের জন্য বিখ্যাত ওসিয়াঁঁ। আট থেকে এগারো শতকের মধ্যে প্রতিহরদের নির্মিত কারুকার্যমণ্ডিত এই মন্দিরগুলি মধ্যযুগীয় ভাস্কর্যের অপূর্ব নিদর্শন। তবে এই মন্দিরগুলির সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ হল ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীরের মন্দির। আট শতকের এই মন্দির পরে সংস্কার করা হয়েছে। অদূরে সূর্য মন্দির, যেখানে সূর্য ছাড়াও রয়েছেন গণেশ ও দুর্গা।
ওসিয়ার মন্দির দর্শন করে ফলোদী পৌঁছে যান। এখানে করা যায় ক্যামেল সাফারি, ডেজার্ট সাফারি। রয়েছে জৈন মন্দির, দুর্গা মন্দির। দৃষ্টিনন্দন জাফরিমণ্ডিত নানা হাভেলিও দর্শনীয়। ৬ কিলোমিটার দূরে খিচেন। এখানকার বিশেষ আকর্ষণ সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা হাজার হাজার সারস। বালিয়াড়ির ঝোপেঝাড়ে বাসা তৈরি করে তারা ডিম পাড়ে। তাদের সমাগম হয় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে।

সোনার কেল্লা।
ষষ্ঠ দিন – আজকের গন্তব্য জৈসলমের। সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়ুন ফলোদী থেকে।
ফলোদী থেকে ৫৪ কিমি দূরে রামদেওরা। এখানে দেখে নিন চোদ্দো শতকের পির বাবা রামদেবের মন্দির এবং রাম সরোবর। রামদেওরা থেকে জৈসলমের ১২৮ কিমি। সোনার কেল্লার শহর জৈসলমের ও তার আশেপেশে দ্রষ্টব্য অনেক। তিনটে দিন দেখতে দেখতে কেটে যায় এই জৈসলমেরে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
(১) জয়পুর, পুষ্কর, জোধপুর ও জৈসলমেরে রয়েছে রাজস্থান পর্যটনের (আরটিডিসি) হোটেল। অনলাইন বুকিং: https://rtdc.tourism.rajasthan.gov.in/। এ ছাড়াও ফলোদী, পুষ্কর-সহ সব জায়গাতেই বেসরকারি হোটেল, রিসর্ট, হোমস্টে রয়েছে। নেট সার্চ করলে এর সন্ধান পেয়ে যাবেন।
(২) গাড়ি ভাড়া করতে হলে জয়পুর শহরে প্রচুর কার রেন্টাল সার্ভিস রয়েছে। নেট সার্চ করলে এর সন্ধান পেয়ে যাবেন।
(৩) রাজস্থানের গরমের কথা ভেবে এই সড়কযাত্রা শীতে করা উচিত, নভেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে।
আরও পড়ুন