ভ্রমণ কাহিনি

বিপর্যয়ের পরে উত্তরবঙ্গে পর্ব ১:  ধ্বংসের চিহ্নের মাঝেই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে পাহাড়

শর্মিষ্ঠা সেন

পরিকল্পনাটা মাসদুয়েক আগের। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ ট্রেনের আসন সংরক্ষণ তো দু’মাস আগেই করতে হয়। যাই হোক, পুজোর মধ্যেই স্কুলের কিছু কাজ সেরে যখন ভ্রমণের জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই ঘটল বিপর্যয়। আচমকা অতি প্রবল বৃষ্টি দার্জিলিঙে। একরাতের বৃষ্টির জেরে দার্জিলিঙ পাহাড় আর ডুয়ার্স বিধ্বস্ত। পাহাড়ে অসংখ্য ধস, কিছু সেতুও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। আর ডুয়ার্স বানভাসি। আমাদের ভ্রমণে দার্জিলিং পাহাড় যেমন আছে, তেমনই আছে ডুয়ার্স। আমাদের যাত্রা যদিও এক সপ্তাহ পরে, তবু আমি দ্বিধায়। তত দিনে পাহাড়-ডুয়ার্সের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে?

“দেখোই না”, আমার পুত্র ঋভু তথা শ্রয়ণ সাহস জোগাল। পুত্র সাংবাদিক, পাশাপাশি, ভ্রমণ আয়োজক। তারই সঙ্গে আবহাওয়া চর্চা করে। হোয়াটসঅ্যাপে ওর গ্রুপ আছে — শ্রয়ণের আবহাওয়া স্টেশন। ওর কাছে সারাদিন ফোন আসছে — উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ সংক্রান্ত। যাকে যা পরামর্শ দেওয়া উচিত, সেটা দিচ্ছে। ও বলল, আবহাওয়া কোনো বাগড়া দেবে না। বর্ষা বিদায় নেওয়ার আগে এটা একটা চরম ধাক্কা। আমরা যখন যাব, আবহাওয়া একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর বাকিটা হল রাস্তাঘাটের অবস্থা। আমাদের যে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা সেই পাঙ্খাবাড়ি রোড খোলা আছে। আর যে সব জায়গায় যাব, সে সব জায়গা একদম ঠিক আছে। নিরাপদে যাওয়া যাবে। সেখানকার হোমস্টে-রিসর্টের মালিকরাও নিশ্চিন্তে চলে আসতে বলেছেন। সুতরাং এ বার ভাসাও তরী। ১১ অক্টোবর রাতে বেরিয়ে পড়লাম তিনজনে, কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে।

চড়াই পথ পাঙ্খাবাড়ি রোডে।

কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস শিলিগুড়ি জংশনে পৌঁছোল নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকক্ষণ আগে। খুব সক্কালেই আমাদের সারথির সঙ্গে ঋভুর কথা হয়ে গিয়েছে। উনি স্টেশনে চলে এসেছেন।  স্টেশন থেকে বেরিয়ে কার পার্কিং এসে আলাপ হল রবার্ট গুরুংয়ের সঙ্গে। সুভদ্র মানুষটি আপাতত আমাদের ভ্রমণে প্রথম দিনকয়েকের সারথি। রওনা হলাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য মিম টি এস্টেট, সুকিয়াপোখরির কাছে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম হিলকার্ট রোডে। তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড বাঁদিকে রেখে এগিয়ে চললাম। একটু পরেই ডানদিকে ঘুরলাম। আপাতত আমরা হিলকার্ট রোডে আছি। তবে এই পথে আমরা যাব না। যাব পাঙ্খাবাড়ি রোড দিয়ে। কার্শিয়াঙে মিলব হিলকার্ট রোডের সঙ্গে। বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। রোদ উঠেছে। সপ্তাহখানেক আগেই যে সাংঘাতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল দার্জিলিং পাহাড় আর ডুয়ার্স, আপাতত তার কোনো চিহ্ন এখনও নজরে পড়েনি।

পাশ দিয়ে চলেছে টয় ট্রেনের লাইন। কুয়াশা রয়েছে ভালোই।  ফলে অনতিদূরের পাহাড়ও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। পেরোলাম শালবাড়ি। একটু পরেই বাঁদিকের রাস্তা ধরলাম। এই রাস্তাই কিছুটা গিয়ে ভাগ হয়েছে। একটি পাঙ্খাবাড়ি রোড, আর-একটি রোহিণী রোড। দু’পাশে বেশ জঙ্গল। মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের অংশ। পথের ধারে দুটো ময়ূরও দর্শন দিল। পেরোলাম বালাসন। এই বালাসনই খেপে উঠেছিল না? দেখে বোঝার উপায় নেই। আগের চেহারায় ফিরে গেছে। নুড়িপাথরে ভর্তি, সামান্য জল তিরতির করে বইছে।

পেরোলাম সিমুলবারি টি এস্টেট। ডানদিকে বেরিয়ে গেল রোহিণী রোড। রাস্তা বন্ধ। বোর্ড লাগানো আছে। আমরা চললাম সোজা, পাঙ্খাবাড়ির দিকে।  এখনও সে ভাবে চড়াই শুরু হয়নি।  কিছুক্ষণ পরে বাঁদিকে বেরিয়ে গেল মিরিকের রাস্তা, দুধিয়া হয়ে। আপাতত এই রাস্তাও বন্ধ, দুধিয়ায় বালাসন নদীর ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার দরুন।

দু’ধারে মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।

এ বার পাঙ্খাবাড়ি রোড ধরে উপরে ওঠা শুরু হল। কিছুক্ষণ পরে পথের ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সেরে নিলাম প্রাতরাশ জবা’স কিচেনের পোহা দিয়ে। শিলিগুড়ির সুজিত-জবা তাদের কিচেন চালাচ্ছে। তাদের সরবরাহ করা খাবারের তুলনা নেই। পোহাও তার ব্যতিক্রম হল না। শিলিগুড়ি স্টেশনেই সুজিত প্রাতরাশের আহার দিয়ে গিয়েছিল। ব্রেকফাস্ট সেরে তাশি রেস্টুরেন্টে মকাইবাড়ির চা-এর স্বাদ নিয়ে শুরু হল আবার পাহাড় চড়া। এখান থেকে কার্শিয়াং ১২ কিলোমিটার, চড়ব অন্তত হাজারতিনেক ফুট। মালুম হচ্ছে তো, কতটা চড়াই?

ঘুম স্টেশন থেকে ধরলাম বাঁদিকের পথ, সুখিয়ার দিকে।

পেরিয়ে গেলাম মকাইবাড়ি, যার চায়ের স্বাদ নিলাম একটু আগেই। পড়লাম হিলকার্ট রোডে, কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজের কাছে। ডান দিকে সঙ্গী হল টয় ট্রেনের লাইন। কিছুটা এগোতেই দিলারাম। হিলকার্ট রোড তেমনই জমজমাট। তবে মাঝেমাঝে বাঁদিক ঘেঁষে রাস্তার খানিকটা করে অংশ বন্ধ। সারথি বুঝিয়ে দিলেন, বৃষ্টিতে ভেঙেছিল, এখন সারাইয়ের কাজ চলছে। কথায় কথায় ঋভু জানতে চাইল, কেমন বৃষ্টি হয়েছিল। সারথি বললেন, বৃষ্টি প্রচুর হয়েছিল, তবে বাজ পড়েছিল সাংঘাতিক। এইটথ মাইল পেরিয়ে এলাম সোনাদা। রবিবারেও সোনাদার বাজার জমজমাট। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ দেখে ভাল লাগল। এরই মাঝে রোদ-মেঘের খেলা চলছে। কখনো মেঘ ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে দূরের পাহাড়, আবার কখনো রোদে ভেসে যাচ্ছে চতুর্দিক। ভালো লাগছে। এটাই তো পাহাড়ের আসল মেজাজ।

মিমগামী রাস্তার দুরবস্থা।

পেরোলাম রংবুল। চলে এলাম ঘুম। ৭২০০ ফুট উঁচু ঘুমের পর থেকে হিলকার্ট রোড সামান্য নেমেছে দার্জিলিঙের দিকে। হিলকার্ট রোড ধরে যাত্রা আমাদের এখানেই শেষ। ডান দিকে বেরিয়ে গেল জলাপাহাড়ের রাস্তা। হিলকার্ট রোড ছেড়ে ঘুম স্টেশনের বাঁ দিকের পথ ধরলাম। এই পথই গেছে সুখিয়াপোখরি হয়ে মিরিক। আমাদের গন্তব্য সুখিয়ার কাছে মিম টি এস্টেট। ঘুম স্টেশন থেকে দশ কিলোমিটার সুখিয়া। তার দু’কিমি আগে ডানদিকে বেরিয়েছে মিমের পথ। লেপচাজগত পেরিয়ে খানিকটা পথ গিয়ে মিমের পথ ধরলাম। অবর্ণনীয় অবস্থা। গাড়ি চলেছে লাফাতে লাফাতে। ঠিক করে বসে থাকতে দিচ্ছে না। বসে বসেই লাফাচ্ছি। সপ্তাহখানেক আগের দুর্যোগের জন্য কি রাস্তার এই দুরবস্থা? মৃদু হাসলেন সারথি। তাঁর কথায়, “আমরা একে বলি হজমোলা রোড। মিনি সুইৎজারল্যান্ডের হজমোলা রোড। এই রাস্তা এইরকম। সাত কিলোমিটার পথ এভাবে যেতে যেতে খাবারদাবার সব হজম হয়ে যাবে। এরকম বরাবর। তবে, এক সপ্তাহ আগের বৃষ্টিতে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।”

ধ্বংসের জন্য মিমের পথে।

তার চিহ্ন পথে দেখলাম। প্রচুর জায়গায় পাহাড় ধসেছে। তবে সেই ধস খুব বড়ো নয় বলে এই রাস্তায় যাতায়াত বন্ধ হয়নি। ধ্বংসের এই চিহ্ন প্রত্যক্ষ করতে করতেই চলে এলাম মিমে। ঘড়িতে সাড়ে বারো। (চলবে)

ছবি: শ্রয়ণ সেন

আরও পড়ুন: মরাঠাভূমে আবার, পর্ব ১: শুরুতেই বিপত্তি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *