বিপর্যয়ের পরে উত্তরবঙ্গে পর্ব ৪: প্রকৃতি যেখানে আপনার সঙ্গে বসত করে
শর্মিষ্ঠা সেন
যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় ও পারের পাহাড়মালা। আমরাও রয়েছি পাহাড়ের কোলে। এ পারে। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি স্রোতস্বতী। নদীর বুকে অসংখ্য ছোটো-বড়ো পাথর। তাদের বাধা কাটিয়ে ছোটো ছোটো ঢেউ তুলে তির তির করে বইছে সেই নদী, নাম যার রেশিখোলা। সিকিমের ভাষায় খোলা মানে নদী।
চারিদিকে সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা এই জায়গাটার নামও রেশিখোলা — সিকিম আর পশ্চিমবঙ্গের সীমানায়। আমরা রয়েছি সিকিমে, সামনের পাহাড় পশ্চিমবঙ্গে। সবুজ পাহাড়ের কোলে পাহাড়ি স্রোতার ধারে অবস্থিত রেশিখোলায় সত্যিই প্রকৃতি বসত করে। এখানে যে রিসর্টটিতে এসে উঠেছি তারও ক্যাচলাইন — হোয়্যার নেচার স্টেস উইথ ইউ। সত্যিই তা-ই — এখানে প্রকৃতির মাঝে আপনার বাস বা আপনাকে নিয়ে প্রকৃতির বাস।
এই ভ্রমণে পাহাড়ে আমাদের তৃতীয় গন্তব্য ছিল এই রেশিখোলা। দুটো দিন দাওয়াইপানিতে মন ভরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের পর তৃতীয় দিনে ছেড়ে চললাম তাঁর সঙ্গ। মনটা বড়ো খারাপ। প্রাতরাশ সেরেই রওনা হলাম।

লাভার্স মিট। তিস্তা ও রঙ্গিতের সংগম।
‘হজমোলা রোডের’ আড়াই কিমি পথ ভেঙে এলাম পেশক রোডে। মিনিটখানেকের মধ্যে সিক্সথ মাইল — বেশ বড়ো গঞ্জ। আরও খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে নেমে গেল তাকদার পথ। পেরিয়ে এলাম লামাহাট্টা, লপচু। খানিকক্ষণ পরেই তিনচুলের রাস্তা উঠে গেল ডান দিকে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে। পেশক পেরিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ‘লাভার্স মিট’-এ।
সত্যিই ‘লাভার্স মিট’ – প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন। প্রেমিক রঙ্গিত, আর প্রেমিকা তিস্তা। এই অঞ্চলের লোককাহিনি এ কথাই বলে। দেখা হল তিস্তার সঙ্গে রঙ্গিতের। তিস্তার প্রেমেই নিজেকে সঁপে দিল রঙ্গিত। যত বার এ পথে যাই, একবার তিস্তা-রঙ্গিত সংগম না দেখলে সাধ মেটে না। এবারেও তার অন্যথা হল না। উপর থেকে দুই নদীর সংগমস্থলটি খুব সুন্দর লাগে। পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিম এখানে একাকার।

রিসর্ট থেকে রেশি নদী।
ক্রমশ নেমে এলাম তিস্তাবাজারে। সাম্প্রতিক দুর্যোগে তিস্তা ভাসিয়ে দিয়েছিল এই এলাকা। নদীর ধার বরাবর যত নির্মাণ ছিল, সব নদীগর্ভে। এখানে পেশক রোডও একেবারে নদীর ধার ঘেঁষে গেছে। এই সড়কও যে জলে ভেসেছিল, তার প্রমাণ সর্বত্র। পেশক রোড ঘুরে উঠল ১০ নং জাতীয় সড়কে। পেরোলাম তিস্তা ব্রিজ। দার্জিলিং পাহাড় ছেড়ে এলাম কালিম্পং পাহাড়ে। রেশিখোলা যাওয়ার আদত রাস্তা গ্যাংটকগামী জাতীয় সড়ক ১০ দিয়ে। কিন্তু এই সড়ক এখন অনিশ্চয়তার পথ। কখন খোলা থাকে, আর বন্ধ থাকে, দেবা না জানন্তি…। তাই আমরা চললাম ঘুরপথে, কালিম্পং দিয়ে। কালিম্পং ছাড়িয়ে লাভামুখী রাস্তা ধরলাম। না, লাভা হয়ে নয়, তার আগেই বাঁ দিকের রাস্তা ধরব। একটু পরেই বাঁ দিকে উঠে গেল ডেলোর রাস্তা। কিছুক্ষণ পরেই চলে এলাম আলাগাড়া। সোজা বেরিয়ে গেল লাভার রাস্তা। আমরা চললাম বাঁ দিকে।

পথের পাঁচালী। আমাদের দু’দিনের আবাস।
১০ নম্বর জাতীয় সড়কের অনিশ্চয়তার জন্য পেডং হয়ে সিকিম যাওয়ার বিকল্প রাস্তাটি এখন যথেষ্ট জনপ্রিয়। এটাকেও সম্ভবত জাতীয় সড়কের রূপ দেওয়া হচ্ছে। যথেষ্ট চওড়া এবং এখনও অনেক জায়গায় কাজ চলছে। পেডং পেরিয়ে এক জায়গায় সিকিমে ঢোকার ছাড়পত্র তৈরি করানো হল। তার পর নদী পেরোতেই সেই ছাড়পত্র পরীক্ষা করা হল সিকিম পুলিশের তরফ থেকে। পরে বুঝেছিলাম এই নদীই রেশিখোলা। কিছুক্ষণ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পাথুরে এবড়োখেবড়ো পথ ধরে নেমে এলাম। ঘণ্টাচারেকের যাত্রা শেষ হল রেশির ধারে সেই রিসর্টে, যেখানে প্রকৃতি বসত করে আপনার সঙ্গে।

লগ হাউস — শাখা প্রশাখা।
দু’দিন ছিলাম রেশিখোলায়। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা রিসর্ট। ছড়িয়েছিটিয়ে কটেজগুলো। আর প্রত্যেকটা কটেজের একটি করে নাম – পথের পাঁচালী, অপুর সংসার, গুপী বাঘা ফিরে এলো, শাখা প্রশাখা, ঘরে বাইরে ইত্যাদি। ডরমিটরির নাম চিড়িয়াখানা, লগ হাউসের নাম শাখা প্রশাখা। যেখানে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে, সেই ঘরের নাম জলসাঘর। রিসর্টচত্বরে একটি খোলা জায়গায় রয়েছে সকালের চা, প্রাতরাশ ও সন্ধের স্যানক্স খাওয়ার জায়গা – নাম, খাইবার বাস। রয়েছে একটি দোলনা – নাম, সেদিন দু’জনে। যুগলের বসার জায়গা রয়েছে – সেটির আকার হৃদয়ের, তাই নাম রব নে বনা দি জোড়ি। কাঠের তৈরি একটি বসার জায়গা রয়েছে, কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে পৌঁছোতে হয় সেখানে, নাম চার মূর্তি। রিসর্টে ঢুকে ‘পথের পাঁচালী’তে মালপত্র রেখে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। মন ভরে গেল। আপাতত পর্যটক প্রায় নেই বললেই চলে। রিসর্টচত্বরে আর রেশি নদীর ধারে বিচরণ করে দিনটা কেটে গেল। এখান থেকে কয়েকটা জায়গা গেলেই হয়, বিশেষ করে আরিতার লেক। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য, পূর্ণ বিশ্রাম।

‘জলসাঘর’-এর অন্দরে — সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন সিনেমার ছবি দিয়ে সাজানো।
দ্বিতীয় দিন দশ-বারো জনের একটি পর্যটকদল এল। দেখে মনে হল মা-বাবা এবং তাঁদের এক বা একাধিক সন্তান। সন্তানরা শিশু থেকে কিশোরবয়সি। দলটি রিসর্টে ঢুকল। সেই দলেরই দুটি শিশুকন্যা গোটা রিসর্টচত্বর দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করল। কত বয়স হবে — চার-পাঁচ! আমরা এক জায়গায় বসে ওদের নজর করছিলাম। ওরা এক একটা কটেজের সামনে যাচ্ছে আর কটেজের নাম পড়ছে জোরে জোরে — পথের পাঁচালী, অপুর সংসার, চিড়িয়াখানা, গুপী বাঘা ফিরে এলো, শাখা প্রশাখা, ঘরে বাইরে। ওরা নাম পড়ছে আর অবাক হয়ে যাচ্ছে — এ কেমন নাম! কাছেই ছিলেন ওদের মা। ওরা মাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলল — এগুলো কী নাম, কেন এরকম নাম ইত্যাদি ইত্যাদি। ওদের মা ধৈর্য ধরে সব বুঝিয়ে দিলেন — এগুলো সিনেমার নাম, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা, সত্যজিৎ রায় কে ইত্যাদি। সুন্দর করে বললেন। ওরা মন দিয়ে শুনল। প্রশ্নও করল। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। আমরা গোটা ব্যাপারটা উপভোগ করলাম। সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানটুকু ওদের হয়ে গেল। শুধু কি কটেজ, ‘জলসাঘর’-এর ভিতরেও স্মরণ করা হয়েছে সত্যজিৎকে – তাঁর বিভিন্ন সিনেমার ছবির মাধ্যমে। যা-ই হোক, রেশিখোলার রিসর্ট কর্তৃপক্ষকে অসংখ্য ধন্যবাদ, যাঁরা এইভাবে কটেজের নাম রেখে পরোক্ষে শিক্ষার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন, যে শিক্ষা ভোলার নয়।
প্রকৃতির সান্নিধ্যে দুটো দিন কাটালাম। মন ভরে বিশ্রাম করলেম। গভীর তৃপ্তি নিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে – পাহাড় থেকে নেমে ডুয়ার্সের অন্দরে। (চলবে)
ছবি: শ্রয়ণ সেন
আরও পড়ুন
বিপর্যয়ের পরে উত্তরবঙ্গে পর্ব ১: ধ্বংসের চিহ্নের মাঝেই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে পাহাড়
বিপর্যয়ের পরে উত্তরবঙ্গে পর্ব ২: মিম থেকে ঘুরে এলাম নেপাল
বিপর্যয়ের পরে উত্তরবঙ্গে পর্ব ৩: প্রতীক্ষার অবসান, অবশেষে দর্শন দিলেন তিনি
