ভ্রমণের খবর

পর্যটনের নবজাগরণে প্রাণ ফিরে পেল মানস জাতীয় উদ্যান

অরূপ চক্রবর্তী, গুয়াহাটি: পর্যটনের নতুন মরশুম শুরু হতেই যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে অসমের অমূল্য প্রাকৃতিক ঐতিহ্য — মানস জাতীয় উদ্যান। সকালের কুয়াশা সরতেই সূর্যের আলো পড়ছে নদীর ধারে, ঘাসজমির ওপরে ঝিকমিক করছে শিশিরবিন্দু, আর দূর থেকে শোনা যাচ্ছে হাতির তূর্যধ্বনি। এমন মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে ভিড় জমেছে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের।

শীতের শুরুতেই ইউনেস্কো ঘোষিত এই বিশ্ব ঐতিহ্য স্থলটি আবার হয়ে উঠেছে প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রিয় গন্তব্য। রাজ্যের বন দফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মরশুমে মানসে দর্শনার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। শুধুমাত্র দেশীয় পর্যটকই নয়, দেশের বাইরের ভ্রমণকারীরাও এখন এই অরণ্যের টানে ছুটে আসছেন। প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেন নতুন করে জাগিয়েছে মানুষের মনে ভ্রমণপিপাসা।

মানস জাতীয় উদ্যান। ছবি Manas Tiger Reserve ‘X’ থেকে নেওয়া।

বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বছর বন্যপ্রাণীর দর্শনও আগের তুলনায় অনেক বেশি, যা সংরক্ষণমূলক প্রচেষ্টার এক বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। গন্ডার, হাতি, বাইসন, হরিণ, বুনো মহিষ, এমনকি বিরল প্রজাতির পাখিদের অবাধ বিচরণ এখন মানসের দৈনন্দিন দৃশ্য। এক দিকে নদীর ধারে গন্ডারের দল চরছে নিশ্চিন্তে, অন্য দিকে অরণ্যের পথে দেখা মিলছে হাতির পাল। বহু পর্যটক জানিয়েছেন, তাঁরা প্রথমবারের মতো এত কাছ থেকে বন্যপ্রাণীর জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছেন। মানস যেন প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ পাঠশালা, যেখানে মানুষ শেখে সহাবস্থানের মানে।

মানসের বিশেষ আকর্ষণ জিপ সাফারি। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া মাটির রাস্তা ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অরণ্যের গভীরে ছুটে চলা সেই যাত্রাই পর্যটকদের কাছে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। কেউ কেউ একে বলেছেন “নগর জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তির শান্ত আশ্রয়”। কেউ আবার বলেছেন, “এমন অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, প্রকৃতিকে দেখতে হলে এখানে আসতেই হবে।”

মানস জাতীয় উদ্যান কেবলমাত্র একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি অসমের গর্ব, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের সাফল্যের প্রতীক। একসময় এই অরণ্য ছিল শিকারি ও অবৈধ কাঠচোরের আশ্রয়স্থল। তার পর স্থানীয় সম্প্রদায় ও বন বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টায় মানস ধীরে ধীরে ফিরে পেয়েছে তার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। আজ এখানকার গন্ডারসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, হাতির দল আবারও নিয়মিত চলাচল শুরু করেছে, এবং পাখিরা ফিরে এসেছে তাদের প্রিয় আবাসে। বন কর্মকর্তারা বলছেন, “মানস আজ শুধু একটি উদ্যান নয়, এটি এক জীবন্ত সাফল্যের গল্প। স্থানীয় জনগণ এখন সংরক্ষণের অংশীদার। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া এই পুনর্জাগরণ সম্ভব হত না।”\

মানসের অন্দরে। ছবি Manas Tiger Reserve ‘X’ থেকে নেওয়া।

আসলে সংরক্ষণ কেবল প্রশাসনিক উদ্যোগ নয়, এটি এক সামাজিক চেতনা — আর মানস সেই চেতনারই প্রতিফলন। অন্য দিকে পর্যটকরাও এখন মানসকে দেখছেন এক বিশেষ অনুভূতির জায়গা হিসেবে। শুধু প্রকৃতি নয়, এই সফরে অনেকেই খুঁজে পাচ্ছেন এক নীরব শ্রদ্ধার প্রতিচ্ছবি— প্রয়াত সংগীতশিল্পী ও পরিবেশপ্রেমী জুবিন গার্গের প্রতি। জুবিনদা-র হঠাৎ চলে যাওয়া এখনও ভক্তদের হৃদয়ে গভীর শোকের রেখা এঁকে দিয়েছে। তাঁর গানে যেমন প্রকৃতির ছোঁয়া ছিল, তেমনই তাঁর জীবনেও ছিল অরণ্যের প্রতি এক অনিঃশেষ ভালোবাসা। অনেক পর্যটকই জানিয়েছেন, তাঁরা মানসে এসে যেন জুবিন গার্গের উপস্থিতি অনুভব করেছেন—এই বন্যপ্রাণের রাজ্যে তিনি যেন এখনও জীবন্ত।

এক পর্যটক আবেগভরে বলেন, “আমরা এখানে এসেছি শান্তি খুঁজতে। জুবিনদা প্রকৃতিকে যতটা ভালোবাসতেন, মানসে এসে আমরা তা আরও গভীরভাবে বুঝেছি। হাতি, গন্ডার, আর দুটি ছোট্ট হাতিশাবককে খেলতে দেখে মনে হল প্রকৃতি নিজেই যেন আমাদের সান্ত্বনা দিচ্ছে। এই ভ্রমণ আমাদের কাছে শুধু আনন্দ নয়, এটি ছিল এক আত্মিক অভিজ্ঞতা।” এই আবেগঘন সংযোগই হয়তো মানসকে আলাদা করে রেখেছে অন্যান্য উদ্যানের থেকে। এখানে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, আছে মানুষের মনের সান্ত্বনা, আছে শিল্প ও অনুভূতির মিলন। পর্যটকদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ বন দফতরের কাছেও এক আশাব্যঞ্জক বার্তা। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এটি শুধু পর্যটনের নয়, সংরক্ষণেরও সাফল্য।

মানসে গন্ডার দর্শন। ছবি Manas Tiger Reserve ‘X’ থেকে নেওয়া।

মানস জাতীয় উদ্যানের পুনর্জাগরণে স্থানীয় সম্প্রদায়ের ভূমিকা আজ উদাহরণ হিসেবে ধরা হচ্ছে সারা দেশে। অনেক গ্রামবাসী আজ গাইড, সাফারি চালক বা সংরক্ষণকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। তাঁদের আয়ের উৎস যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রকৃতি রক্ষার মানসিকতাও শক্তিশালী হয়েছে। স্থানীয় শিশুদের মধ্যে সংরক্ষণের শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রাকৃতিক শিক্ষা শিবির। এর ফলে এক নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে যারা প্রকৃতিকে দেখছে বন্ধুর চোখে, শিকারের চোখে নয়।

মানসের এই সাফল্য শুধু একটি উদ্যানের গল্প নয়, এটি অসমের পুনর্জীবনের গল্প। প্রকৃতি, মানুষ ও প্রাণী—তিনের মধ্যে সহাবস্থানের যে সূক্ষ্ম সম্পর্ক, মানস তার সবচেয়ে সুন্দর প্রতিচ্ছবি। গন্ডারের পদচিহ্ন, হাতির হাঁটার পথ, নদীর ধারে বসে থাকা এক জোড়া পাখি—সব মিলিয়ে এই অরণ্য যেন জীবনেরই এক উপাখ্যান। দিনশেষে সূর্য যখন পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে যায়, তখন মানসের নিস্তব্ধতা যেন বলে যায় একটাই কথা—প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্বই মানবতার পরম শিক্ষা। আর সেই শিক্ষাই আজ মানুষকে ফিরিয়ে আনছে মানসের বুকে, বারবার, নতুন করে।

আরও পড়ুন

তাজ তাল কুটিরে উপকূলের স্বাদ! কলকাতায় ‘গোয়া হাই-টি সোয়ারি’ ও ‘পন্ডিচেরি–অ্যা স্টোরি অন দ্য প্যালেট’ আয়োজন

ঝাড়খণ্ডের প্রথম ব্যাঘ্র সাফারি প্রকল্প চালু হতে চলেছে বেতলা জাতীয় উদ্যানের কাছেই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *