বিপর্যয়ের পরে উত্তরবঙ্গে পর্ব ৩: প্রতীক্ষার অবসান, অবশেষে দর্শন দিলেন তিনি
শর্মিষ্ঠা সেন
দিনচারেক হল দার্জিলিং পাহাড়ে রয়েছি। প্রথম দুটো দিন কাটল মিম টি এস্টেটে একটা হোমস্টে-তে। কিন্তু তিনি সে ভাবে দর্শন দেননি। কখনোসখনো মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মেরেছেন। ঈষৎ আবছা দর্শন হয়েছে। তবে সেই দর্শনকে দর্শন না-বলাই ভালো। ঋভুর তরুণ চোখে তা ধরা পড়লেও, আমাদের ছানি কাটানোর পরবর্তী চোখে তা ধরা দেয়নি বললেই চলে। কিন্তু দার্জিলিং পাহাড়ে এসে যতক্ষণ না তিনি ধরা দিচ্ছেন, তৃপ্ত হচ্ছে না মন। মেঘ কাটছে না কিছুতেই।
দ্বিতীয় দিন কন্যাম থেকে ফেরার পথে বরবোটা পেরিয়ে আসতেই তেড়ে বৃষ্টি নামল। আবার বৃষ্টি আর এত জোরে! আমরা চিন্তিত, আমাদের ভ্রমণ মাটি হবে না তো? ঋভু দেখছি বেজায় খুশি। আমাদের আশ্বস্ত করে বলল, একদম চিন্তা কোরো না। এই বৃষ্টিতে মেঘ পুরো কেটে যাবে। কাল থেকে কাঞ্চন দেখা দেবেই। আর আজ রাতেই আকাশ ভরে যাবে তারায়। ঋভু যতই বলুক, আমার মন মানছিল না।
পশুপতি পৌঁছোতে বৃষ্টির তোড় কিছুটা কমল। সীমানা থেকে বৃষ্টি বন্ধ। সুখিয়ায় দেখলাম রাস্তা শুকনো। এদিকে তা হলে বৃষ্টি হয়নি। আবার হতাশা চেপে ধরল। তার মানে এদিকে মেঘ কাটল না? আমার চোখমুখ দেখে ঋভু কিছু আন্দাজ করল — চিন্তা কোরো না। কাল কাঞ্চন দেখা দেবেনই। সন্ধেবেলায় ঋভু আমাদের নিয়ে গেল হোমস্টের সামনের মাঠে। দেখাল, আকাশভরা তারা। বলল, আজ তারাভরা আকাশ দেখালাম। কাল ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাব।

তখনও সে ভাবে ভোর হয়নি। আমাদের ঘুম থেকে তুলে জানলার পর্দা সরিয়ে দিল ঋভু। ঠিক মনে হল, টাইগার হিলে সানরাইজ দেখছি। একটু একটু করে সূর্যের প্রথম আলো পড়ছে কাঞ্চনশিখরে। আর কুম্ভকর্ণ থেকে পান্ডিম — কাঞ্চনজঙ্ঘার সবকটি শিখর ধীরেধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে আমাদের চোখে। আমরা আপ্লুত। বহুবার দার্জিলিঙ পাহাড়ে এসেছি। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এই রূপে দেখেছি কতবার? বোধহয় হাতে গোনা যাবে। কিন্তু আমরা একটু পরেই বেরিয়ে যাব। পরবর্তী গন্তব্য দাওয়াইপানি। সেখানে কাঞ্চন থাকবেন তো? ঋভু বলল, দেখো হয়তো আরও ভাল পাবে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা — এই নামটা শুনেই আমরা মনে মনে সন্ধিবিচ্ছেদ করি — কাঞ্চন + জঙ্ঘা। না, এই সন্ধির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এই নামের। স্থানীয় ভাষায় ‘কাং চেং জেং গা’ কালক্রমে হয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এর অর্থ ‘তুষারের পাঁচ ধনদৌলত’। এই ধনদৌলত ঈশ্বরের পাঁচ ভাণ্ডারের প্রতিনিধিত্ব করে — সোনা, রূপা, রত্ন, শস্য এবং পবিত্র পুস্তকের ভাণ্ডার।

সেই ‘তুষারের পাঁচ ধনদৌলত’ নিয়ে চললাম দাওয়াইপানি। আধঘণ্টা লাগল হজমোলা রোড পেরোতে। পড়লাম ঘুমগামী রাস্তায়। আট কিলোমিটার দূরের ঘুম পৌঁছে গেলাম। গোটা পথেই কাঞ্চন আমাদের সঙ্গ দিয়ে গিয়েছেন। এলাম জোড়বাংলোয়। এবার হিলকার্ট ছেড়ে ধরলাম বাঁদিকের পথ পেশক রোড। কিছুক্ষণ পর থার্ড মাইল পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম দাওয়াইপানি মোড়ে। সোজা বেরিয়ে গেল পেশক রোড। আমরা বাঁদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুটা উঠে নামতে লাগলাম। রাস্তার অবস্থা কহতব্য নয়। এর অবস্থা কোনো অংশেই হজমোলা রোডের চেয়ে ভালো নয়। কিন্তু কাঞ্চন সবসময়েই সঙ্গে রয়েছেন, মাঝে ঘুম-জোড়বাংলো পথটুকু বাদ দিয়ে। ঘণ্টাদেড়েকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম দাওয়াইপানির হোমস্টে-তে। তিনতলার যে ঘরে জায়গা পেলাম, তাতে মন ভরে গেল। সামনে যে কাঞ্চনকে দেখছি, তা যেন মিমের হোমস্টে থেকে দেখা কাঞ্চনের চেয়ে আরও বেশি বিস্তৃত, আরও যেন কাছের। বাঁদিকের পাহাড়ের মাথায় দার্জিলিং শহর, স্পষ্ট। আর ডানদিকের পাহাড়ের ঢালে তাকদা ভ্যালি। নিঃসন্দেহে, দার্জিলিং পাহাড়ের এই দাওয়াইপানির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। প্রায় সারা দুপুর কাঞ্চন আমাদের সঙ্গ দিয়ে গেলেন।

পরের দিন সকালে চললাম দার্জিলিঙে। ঋভুর এক বন্ধু দম্পতি দার্জিলিং স্টেশনের কিছু আগে হিলকার্ট রোডের কার্যত ধারেই হোমস্টে করেছে। তাদের আমন্ত্রণ, একবার যেতেই হবে তাদের হোমস্টে-তে। কথা দিয়েছিলাম, যাব। সেই কথা রাখতেই সেখানে যাওয়া। ডালি মন্যাস্টেরি ছাড়িয়ে খানিকটা যেতেই বাঁদিকে সিঁড়ি। সেই সিঁড়িপথে মিনিট আটেক লাগল তাদের হোমস্টে-তে পৌঁছোতে। আর সেখানে পৌঁছোতেই কাঞ্চন আমাদের বরণ করে নিল। উজ্জ্বল পরিষ্কার আবহাওয়ায় তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা সপরিবার হাজির।
সকাল থেকে সঙ্গ করলাম কাঞ্চনের সঙ্গে। দুপুর গড়াতে বিকেলের দিকে ডেকে নিলাম আমাদের সারথি দিলীপজিকে। এখনই দাওয়াইপানি ফিরে যাব শুনে দিলীপজি অবাক — এত দূর এলেন, একবার দার্জিলিঙের ম্যালে যাবেন না? আমার কোনো তাড়া নেই। আপনারা ম্যালে ঘণ্টাদুয়েক কাটান। সন্ধের পর ফিরব। ভাগ্যিস দিলীপজির কথা শুনেছিলাম। তাই তো, কাঞ্চনজঙ্ঘায় এক অভূতপূর্ব সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকলাম। (চলবে)
ছবি: শ্রয়ণ সেন
আরও পড়ুন:
বিপর্যয়ের পরে উত্তরবঙ্গে পর্ব ১: ধ্বংসের চিহ্নের মাঝেই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে পাহাড়
