কলকাতা থেকে সড়কপথে: কবিগুরুর শান্তিনিকেতন

ভ্রমণঅনলাইন ডেস্ক: করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমরা শারীরিক আর মানসিক ভাবে  দীর্ঘ সময় ধরে ঘরবন্দি। কিন্তু শরীর ও মনের এই জড়তা কাটাতে আমরা ইচ্ছে করলেই বেরিয়ে পড়তে পারি। দেশের ভেঙে পড়া পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা করতে অনেক জায়গাতেই হোটেল, ট্যুরিস্ট লজ খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার শর্ত হল দু’টো – এক, যেতে হবে সড়কপথে, কারণ ট্রেন বা বিমান চলাচল এখনও স্বাভাবিক নয়; আর দুই, করোনা রুখতে মানতে হবে কিছু নিয়মবিধি। তা হলে নিজের বাহন বা বাহনের ব্যবস্থা করে বেরিয়ে পড়া যাক।   

আরও পড়ুন: কলকাতা থেকে সড়কপথে: পুবের ব্রাইটন দিঘা

আর শারীরিক ভাবে না বেরোতে পারলেও মানসিক ভাবে বেরিয়ে পড়তে দোষ কী? কিন্তু কোন পথ ধরবেন? আসুন তারই সন্ধান করা যাক।

কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন

সোজা রাস্তায় গেলে দূরত্ব ১৬৩ কিমি। পথ এশিয়ান হাইওয়ে ১ (দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে) বর্ধমান, তার পর গুসকরা হয়ে শান্তিনিকেতন। যদি দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে বর্ধমান ছাড়িয়ে পানাগড় পৌঁছে সেখান থেকে মোরগ্রামগামী জাতীয় সড়ক ধরে ইলামবাজার, সেখান থেকে কাঁকসার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে শান্তিনিকেতন। এ পথে দূরত্ব পড়ে ১৯৫ কিমি।

আর এই দুই পথের পরিবর্তে আমরা যদি পুরোনো জিটি রোড ধরে যাই, তা হলে পথের অনেক দ্রষ্টব্য দেখে নেওয়া যায়। এতে দূরত্ব বেশি পড়ে না, কিন্তু সময় তো কিছু বেশি লাগে। না হয়, বেশ কিছুটা সময় লাগবে শান্তিনিকেতন পৌঁছোতে। দু’টো দিন তো সেখানে থাকবেন। অসুবিধা কী? জিটি রোড ধরে দ্রষ্টব্য দেখতে দেখতে চলুন। আর সব যে দেখতে হবে তার তো কোনো কথা নেই। গুড়াপের কাছে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরুন, তার পর বর্ধমান-গুসকরা বা পানাগড়-ইলামবাজার হয়ে চলুন শান্তিনিকেতন।           

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে শান্তিনিকেতনের পথে।

তা হলে পথে দেখে নিতে পারেন (অবশ্যই এক যাত্রায় সব জায়গা দেখা সম্ভব নয়। বেছে নিন আপনার পচ্ছন্দ। কিংবা যে দ্রষ্টব্যগুলো মূল সড়কের একেবারে ধারে পড়বে, দেখে নিন শুধু সেগুলোই।) –

(১) দক্ষিণেশ্বর মন্দির – কলকাতা থেকে বিটি রোড ধরে দক্ষিণেশ্বর। গঙ্গার তীরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিধন্য, ১৮৫৫-য় রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিণীর নবরত্ন মন্দির। দেউড়ি দিয়ে ঢুকে সুবিশাল প্রাঙ্গণ, মাঝে নাটমন্দির-সহ ভবতারিনী মন্দির। প্রায় তার লাগোয়া রাধাকান্তের মন্দির। ডান দিকে ১২টি শিবমন্দির, মাঝে চাঁদনী। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা ঘর। প্রাঙ্গণের উত্তর-পশ্চিম কোণে শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর। মন্দিরপ্রাঙ্গণের বাইরে নহবত, যেখানে থাকতেন সারদা মা; কাছেই রানি রাসমণির আবাস। গঙ্গার দু’টি ঘাট। গঙ্গার ধার ধরে বাঁধানো পথ চলে গেছে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনস্থল ‘পঞ্চবটী’-তে – বট, অশ্বত্থ, নিম, বেল ও আমলকী গাছের সমাহার।

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছেই আদ্যাপীঠ – শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্ত শ্রীঅন্নদা ঠাকুরের স্বপ্নে দেখা মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৩৪০ বঙ্গাব্দে, মন্দির খোলে ১৩৭৫-এ। তিন ধাপের মন্দিরে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ, আদ্যামা ও রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ।             

বেলুড় মঠ।

(২) বেলুড় মঠ – দক্ষিণেশ্বর দর্শন করে বিবেকানন্দ সেতুতে (বালি ব্রিজ) উঠুন। গঙ্গা পেরিয়ে চলুন দক্ষিণ মুখে। পৌঁছে যান বেলুড় মঠ। গঙ্গার পশ্চিম পারে স্বামী বিবেকানন্দ পরিকল্পিত এই মঠ বাস্তব রূপ পায় ১৯৩৮ সালের ১৪ জানুয়ারি। এটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সদর দফতর। এখানে রয়েছে মন্দির-মসজিদ-গির্জার সমন্বয়ে তৈরি মূল শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির (বেলুড় মঠ বলতে আমরা মূলত এই মন্দিরকেই বোঝাই), স্বামীজির মন্দির, মাতৃমন্দির (মা সারদার মন্দির), ব্রহ্মানন্দ মন্দির, রামকৃষ্ণ-শিষ্যদের সমাধি পীঠ এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়ামের সহায়তায় গড়ে ওঠা শ্রীরামকৃষ্ণ মিউজিয়াম। আর মূল প্রবেশপথে জি টি রোডে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন সারদা মন্দির। এখানের অন্যতম আকর্ষণ রামকৃষ্ণ দর্শন অর্থাৎ ঠাকুরের কথামৃতের ছবি ও পুতুলে রূপ।

(৩) উত্তরপাড়া – বেলুড় মঠ দেখে উত্তরমুখো হোন, চলুন জিটি রোড ধরে। বালি পেরিয়ে উত্তরপাড়া। রাস্তার ডান দিকে পড়বে বাংলার প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি। ১৮৫৯-এ গড়া এই লাইব্রেরি অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। এরই দোতলায় কিছু দিন বাস করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ১৯০৯-এ জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এখানেই সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। এই সুরম্য অট্টালিকাটি গঙ্গার একেবারে ধারে।

(৪) কোন্নগর – উত্তরপাড়া থেকে কোন্নগর। ডান দিকে গঙ্গার ধারে ১৮২০ সালে হাটখোলার দত্তদের তৈরি বারো মন্দির ঘাট, দ্বাদশ শিবমন্দির। বাঁধানো ঘাটের দু’ দিকে ছ’টি করে আটচালা মন্দির। সামান্য এগিয়েই জিটি রোডের বাঁ দিকে শ্রী রাজরাজেশ্বরী মন্দির। শিবের নাভিপদ্মে অধিষ্ঠিত দেবী ত্রিপুরসুন্দরী। ৩১৯ বছরের প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। তবে বর্তমান মন্দিরটিও যথেষ্ট পুরোনো।

(৫) মাহেশ – রিষড়া পেরোলেই মাহেশ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারাণী’ উপন্যাসের পটভূমি। পথের ধারেই সেই বিখ্যাত রথ, নবরত্ন মন্দিরের আদলে তৈরি। এখানকার রথযাত্রার বয়স ৬০০ বছরেরও বেশি হলেও, বর্তমান রথটির বয়স ১৩৫ বছর। লোহার ১২ চাকার রথ। বর্তমান জগন্নাথ মন্দিরের বয়স ২৬৫ বছর। কিলোমিটার খানেক দূরে জগন্নাথের মাসির বাড়ি গোপীনাথ মন্দির। দেখে নিতে পারেন কাছেই বল্লভপুরে রাধাবল্লভ জিউয়ের আটচালা মন্দির।      

ডেনমার্ক ট্যাভার্ন।

(৫) শ্রীরামপুর – আর একটু এগোলেই শ্রীরামপুর, অতীতের ফ্রেডরিকনগর। ১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫ পর্যন্ত দিনেমারদের (ডেনমার্ক) কলোনি ছিল এই শ্রীরামপুর। তার স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে সেন্ট ওলাভ চার্চ আজ ডেনমার্ক সরকারের সহযোগিতায় সু-সংস্কৃত হয়ে শ্রীরামপুরের অন্যতম দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে। সংস্কার করা হয়েছে ১৮৩০ সালে নির্মিত গভর্নমেন্ট হাউস। গঙ্গার পাড়ে যে ডেনমার্ক ট্যাভার্ন আছে, সেটিও আজ সংস্কারের পরে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে। এখানে একটি কাফে আছে এবং থাকার ব্যবস্থাও আছে।

বাংলা সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল উইলিয়াম কেরির শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে। ডোরিক থামওয়ালা শ্রীরামপুর কলেজটিও ১৮১৯ সালে কেরি সাহেবের সৃষ্টি। শ্রীরামপুরের কালীতলায় এক সমাধিক্ষেত্রে কেরি সাহেব শুয়ে আছেন তাঁর দুই সঙ্গী মার্শম্যান আর ওয়ার্ডকে নিয়ে।         

(৫) চন্দননগর – শেওড়াফুলি আর বৈদ্যবাটী ছাড়িয়ে পৌঁছে যান চন্দননগরে – দিনেমারদের রাজত্ব থেকে ফরাসিদের আস্তানায়। এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য গঙ্গার ধারে ‘স্ট্র্যান্ড’ – শহরের প্রাণকেন্দ্র – দু’ দণ্ড বিশ্রাম করা বা হাঁটাহাঁটি করার জায়গা। এখানে রয়েছে ফরাসি শাসক দুপ্লের এক সময়ের আবাস ও দফতর ‘ইনস্তিতিউত দে চান্দেরনগর’। এখন এটি মিউজিয়াম। দেখে নিন ১৭২৬ সালে নির্মিত গির্জা। রয়েছে ১৮৮৪-তে গথিক শৈলীতে তৈরি স্যাক্রেড হার্ট চার্চ। দেখুন পাতালবাড়ি, যার সর্বনিম্ন তলাটি গঙ্গায় নিমজ্জিত। রবীন্দ্রনাথ এখানে বার বার এসেছেন, থেকেছেন।

চন্দননগরে একটু যদি বেপথু হন, তা হলে দেখে নিতে পারেন ২৮৩ বছরের পুরোনো বাংলা দোচালা মন্দিররীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নন্দদুলাল মন্দির।  

(৬) চুঁচুড়া – দিনেমার, ফরাসিদের রাজত্বের পরে এ বার ঢুকে পড়ুন ওলন্দাজদের (ডাচ) পূর্বতন কলোনিতে। জিটি রোডের ধারেই ওলন্দাজ স্থাপত্যশৈলীর সুন্দর নিদর্শন সুশানা আন্না মারিয়ার স্মৃতিসৌধ। খাদিনা মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরে শহরের প্রাণকেন্দ্র ঘড়ি মোড়। বর্গাকার ক্লক টাওয়ার। এখানেই রয়েছে অষ্টকোণী ডাচ চার্চ, একটু পশ্চিমে ডাচ সিমেট্রি। জোড়াঘাটে ‘বন্দে মাতরম’ বাড়ি। হুগলির জেলাশাসক থাকার সময়ে এই বাড়িতেই বসে ‘বন্দে মাতরম’ রচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্র।

(৭) হুগলি – চুঁচুড়া যেখানে শেষ, হুগলি সেখানে শুরু। এই হুগলি ছিল পর্তুগিজদের কলোনি, যে ইউরোপীয় বাণিজ্য-শক্তির সর্বপ্রথম পা পড়েছিল এই বাংলায়, ১৫৩৫ সালে সপ্তগ্রাম বন্দরে। এখনকার হুগলির খ্যাতি অবশ্য ইমামবাড়ার জন্য। গঙ্গার পাড়ে ইমামবাড়া, দানবীর হাজি  মহম্মদ মহসিনের তৈরি। কাছেই মহসিনের সমাধি।             

ব্যান্ডেল চার্চ।

(৮) ব্যান্ডেল – ইমামবাড়া দেখে চলে আসুন, গঙ্গার পশ্চিমপার বরাবর এই ক্ষুদ্র ‘ইউরোপ’-এর অন্যতম প্রাচীন ও শ্রেষ্ঠ স্মৃতিচিহ্ন ব্যান্ডেল চার্চে। বাংলাদেশের প্রাচীনতম গির্জা। দক্ষিণমুখী এই গির্জায় গ্রিক স্থাপত্যরীতির ছোঁয়াচ। যিশু-জীবনের নানা ঘটনা সংবলিত অসংখ্য পেন্টিং রয়েছে এই গির্জায়। ‘আওয়ার লেডি অব ভয়েজ’ নামের এই গির্জায় মাতা মেরির মূর্তিটি অনবদ্য। গির্জার ডান দিকে বিভক্ত অবস্থায় একটি জাহাজের মাস্তুল রাখা আছে। ১৬৫৫ সালে বঙ্গোপসাগরে একটি পর্তুগিজ জাহাজ ঝড়ে পড়লে নাবিকেরা মা মেরির কৃপা প্রার্থনা করেন। জাহাজ রক্ষা পায় এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জাহাজের মাস্তুলটি এই গির্জায় দান করেন। আজ প্রায় পৌনে চারশো বছর পরেও সেই মাস্তুল অটুট।    

(৯) বর্ধমান – ব্যান্ডেল চার্চ দেখে সুগন্ধা-দাদপুর হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে চলে আসুন, সোজা বর্ধমান। আলি শা মোড় দিয়ে বর্ধমান শহরে ঢুকুন। এখানে দেখে নিতে পারেন অতীতের কার্জন গেট তথা বর্তমানের বিজয় তোরণ (মূল সড়কের ধারে), গোলাপবাগে বর্ধমান রাজাদের হাওয়ামহল, মঞ্জিলবাহার, কৃষ্ণসায়র হ্রদ, পীর বাহারামে মোগলসম্রাজ্ঞী নুরজাহানের ভূতপূর্ব স্বামী শের আফগানের সমাধি, সদরঘাটের পথে পৌনে ৬ ফুট উঁচু বর্ধমানেশ্বর শিব, বোরহাটে সাধক কমলাকান্তের সাধনপীঠ। বর্ধমান থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়ার জন্য গুসকরার পথ ধরলেই নবাবহাটায় পথের ধারেই ১০৮ শিবমন্দির।

উপরের তালিকার সব জায়গা দেখা এই ভ্রমণে সম্ভব নয়। তবু আপনার পচ্ছন্দমতো জায়গা বেছে নিয়ে দেখুন। নিজেদের ক্লান্ত না করে যতটুকু সম্ভব ঘুরে পৌঁছে যান শান্তিনিকেতনে।

উপভোগ করুন শান্তিনিকেতন

আদিবাসী নৃত্যের আসর।

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন তো ঘুরে দেখবেনই। কিন্তু শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আরও এক আনন্দ প্রকৃতিকে নিবিড় ভাবে কাছে পাওয়া। প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে এই শান্তিনিকেতনে। উঁচু-নিচু ছোটো ছোটো টিলায় শাল-সোনাঝুরির জঙ্গলে বিচরণ করুন। সাঁঝবেলা নামার আগে লাল মাটির পথ ধরে পৌঁছে যান খোয়াইয়ে। উঁচু-নিচু খোয়াইয়ে সোনাঝুরির ফাঁক দিয়ে সূর্যটা হারিয়ে যাওয়ার আগে হাঁটতে হাঁটতে চলে যান ক্যানালপারে। চলে যান স্বল্প দূরে কোপাইয়ের ধারে। ঢুকে পড়ুন কোনো সাঁওতাল পল্লিতে, আলাপ করুন তাদের সঙ্গে, প্রত্যক্ষ করুন তাদের সরল জীবনযাত্রা। বাউলের সুরে আর আদিবাসী নৃত্যে নিজেকে মাতিয়ে দিন।   

কী দেখবেন শান্তিনিকেতনে

(১) উত্তরায়ণ – রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের আবাস, কয়েকটি ভবনের সমষ্টি। ‘বিচিত্রা’য় দেখুন রবীন্দ্র মিউজিয়াম। কবির ব্যবহৃত অস্টিন গাড়িটিও প্রদর্শিত হয়েছে। পাশেই রবীন্দ্র ভবন। আর রয়েছে রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য ‘উদয়ন’, ‘কোনার্ক’, ‘শ্যামলী’, ‘পুনশ্চ’ ও ‘উদীচী’ গৃহ। কবির স্বহস্তে রোপিত মালতীলতা। ‘উদীচী’র ডাইনে গোলাপ বাগিচা।

(২) ছাতিমতলা – উত্তরায়ণের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধনবেদি ছাতিমতলা। শ্বেতপাথরের বেদিতে বসে এখানেই মহর্ষি লাভ করেছিলেন ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’। ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’, এই কথাটি লেখা আছে দক্ষিণের গেটে।  

উপাসনাগৃহ।

(৩) উপাসনাগৃহ – ছাতিমতলার পেছনেই বর্ণময় কাচের তৈরি উপাসনাগৃহ। ১৮৯২ সালে এই উপাসনাগৃহের উদ্বোধন হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত এই উপাসনাগৃহে আজও প্রতি বুধবার প্রত্যুষে উপাসনা হয়।

(৪) শান্তিনিকেতন গৃহ – অদূরেই শান্তিনিকেতন ভবন। আশ্রমের সব চেয়ে পুরোনো বাড়ি, ১৮৬৩-৬৪ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৈরি। বালক রবীন্দ্রনাথের প্রথম শান্তিনিকেতন বাস এই গৃহেই। সুদীর্ঘকাল এই গৃহই ছিল শান্তিনিকেতনের অতিথিনিবাস। এই গৃহের অদূরে টিলার আকারে একটি মাটির ঢিবি আছে। মহর্ষি এখানে বসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতেন।

(৫) দেহলি – স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে এখানে বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনী দেবীর স্মরণে এখানে শিশুদের বিদ্যালয় ‘মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা’র সূচনা হয়।

দেহলি।

(৬) তালধ্বজ – উত্তরায়ণ পেরোতেই ত্রিমুখী বাঁকের মুখে তালধ্বজ। একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে তৈরি গোলাকৃতি এই মটির বাড়ি। তালগাছের পাতাগুলি ধ্বজার মতো বাড়িটির উপরে শোভা পায় বলে বাড়িটির নাম তালধ্বজ।

(৭) আম্রকুঞ্জ – বর্ধমানের মহারাজ মহতাব চাঁদ তাঁর মালি রামদাসকে পাঠিয়ে এই বাগানের পত্তন ঘটান। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথকে এখানেই সংবর্ধিত করা হয়। পাঠভবনের নিয়মিত ক্লাস হয় এখানে।  

এ ছাড়াও দেখে নিন –

কলাভবন, সংগীতভবন, তিনপাহাড়, শালবীথি, সন্তোষালয়, ঘণ্টাতলা, শমীন্দ্র পাঠাগার, গৌরপ্রাঙ্গণ, সিংহসদন, পূর্ব ও পশ্চিম তোরণ, চৈত্য, দিনান্তিকা, দ্বিজবিরাম, কালোবাড়ি ইত্যাদি।

শান্তিনিকেতনের গোটা এলাকা জুড়ে রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের নানা শিল্পকর্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সে সবও দেখার এবং বোঝার।

আরও দ্রষ্টব্য

(১) সৃজনী শিল্পগ্রাম – উত্তরায়ণ ক্যাম্পাসের অদূরে শ্রীনিকেতন যাওয়ার পথে সৃজনী শিল্পগ্রাম। ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৈরি শিল্পগ্রাম। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও এখানে দেখা যাবে পূর্ব ও উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিল্প নিদর্শন। এক একটি কুটির এক এক রাজ্যের প্রতীক। সারা চত্বরে ছড়ানো ছেটানো নানা মূর্তি-ভাস্কর্য। দেখতে দেখতে একেবারে শেষে পৌঁছে যাবেন বাঁশের তৈরি লাইটহাউসে।

আদিবাসী বাদ্যযন্ত্র। সৃজনী শিল্পগ্রামে প্রদর্শিত।

(২) শ্রীনিকেতন – ৩ কিমি দূরে, বিশ্বভারতীর পল্লি শিল্পকেন্দ্র বিভাগ। হস্তশিল্পের বিপুল সম্ভার, দেখা ও কেনার জন্য।

(৩) গীতাঞ্জলি রেল মিউজিয়াম – কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারতীয় রেল বোলপুর স্টেশনের পাশে এই মিউজিয়ামটি চালু করে ২০১২ সালে। এর অন্যতম আকর্ষণ হল ‘সেলুন কার’ – যে ‘সেলুন কার’-এ চড়ে কবিগুরু শেষ বারের মতো শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতা পাড়ি দিয়েছিলেন। এখানে আরও অনেক কিছুর মধ্যে প্রদর্শিত হয়েছে কবিগুরুর ৩৫টি দুষ্প্রাপ্য ছবিও।

(৪) বল্লভপুর ডিয়ার পার্ক – শাল, পিয়াল, শিশু, জাম, মহুয়া, কাজু, হরীতকী, আমলকী, বহেরা, শিরীষ, সোনাঝুরি আর আকাশমণিতে ছাওয়া ৭০০ একর এলাকা জুড়ে চিতল হরিণ, বার্কিং ডিয়ার, কৃষ্ণসার, ময়ূর, খরগোশ, শিয়াল আর সাপের বাস।

শান্তিনিকেতনকে কেন্দ্র করে ঘোরাঘুরি

(১) সুপুর-কাঁকুটিয়া-দেউলি – ইলামবাজারের পথে ৮ কিমি দূরে সুপুরে রাজা সুরথের তৈরি সুরথেশ্বর শিবমন্দির। আরও ৬ কিমি গিয়ে বৈষ্ণবতীর্থ কাঁকুটিয়া। দেখে নিন লোচনদাস প্রতিষ্ঠিত মহাপ্রভু মন্দির ও বামাখ্যাপার স্মৃতিবিজড়িত হাটপুকুর কালীবাড়ি। কাঁকুটিয়া গ্রাম পেরিয়ে অজয় নদের তীরে শৈবতীর্থ দেউলির খ্যাতি সুপ্রাচীন দেউলীশ্বর শিবমন্দিরের জন্য।

কেঁদুলিতে রাধাবিনোদের মন্দির।

(২) জয়দেব কেঁদুলি – ইলামবাজার পেরিয়ে, শান্তিনিকেতন থেকে ৩০ কিমি। অজয় নদের পাড়ে গীতগোবিন্দের কবি জয়দেবের জন্মস্থান। জয়দেবের ভিটের উপরে বর্ধমানরাজের অর্থানুকূল্যে ১৬৯২-তে তৈরি রাধাবিনোদের টেরাকোটা নবরত্ন মন্দির। সেই বিখ্যাত কদম্বখণ্ডি ঘাটের কাছে সমাধি মন্দির, ফুলেশ্বর ঘাটের কাছে জয়দেবের ‘সিদ্ধাসন’ পাথরখণ্ড। জম্পেশ শীতে মকর সংক্রান্তিতে বসে মেলা, যোগ দেয় নানা প্রান্ত থেকে আসা আউল-বাউলদের দল।

(৩) হেতমপুর – জয়দেব কেঁদুলি থেকে সাড়ে ১৭ কিমি। দেখুন মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির আদলে ১৭৮০ সালে তৈরি প্রাসাদবাড়ি রঞ্জন প্যালেস। রাজবাড়ির অঙ্গনে রাজপরিবারের গৃহদেবতা রাধাবল্লভ জিউয়ের মন্দির। কাছেই বিশালাকার লালদিঘি বা সায়র। দিঘির ডাইনে কদমতলায় ৫টি শিবমন্দির, অদূরে আরও ৩টি শিবমন্দির। হেতমপুরের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে গড়ের মাঠ, শেরিনা-হাফেজের প্রেম আখ্যানের জন্য বিখ্যাত। হেতমপুরের আরও এক দিঘি গোবিন্দসায়রের পাড়ে ১৮৪৭-এ তৈরি অষ্টকোনাকৃতি চন্দ্রনাথ শিবমন্দির। অদূরে টেরাকোটা কাজে সমৃদ্ধ দেওয়ানজি শিবমন্দির।

(৪) দুবরাজপুর – হেতমপুর থেকে সাড়ে ৩ কিমি দূরে দুবরাজপুর। দেখে নিন নানা কিংবদন্তিতে ভরা মামা-ভাগ্নে পাহাড়। একটার পর একটা পাথর পেরিয়ে চলে যান শীর্ষে। আর পাহাড়-শিরে মামা-ভাগ্নে দুই তালগাছ। আর এই পাহাড়ে যাওয়ার পথে দর্শন করে নিন পাহাড়েশ্বর শিবকে।

মামা-ভাগ্নে পাহাড়।

(৫) বক্রেশ্বর – দুবরাজপুরে মামা-ভাগ্নে দেখে চলুন বক্রেশ্বর, ১৪ কিমি। শান্তিনিকেতন থেকে ৫৬ কিমি। ৫১ পীঠের অন্যতম বক্রেশ্বর, সতীর ভ্রূ-মধ্য পড়ে এখানে। দ্বিমতে, সতীর দক্ষিণ বাহু পড়েছিল। মূল মন্দির বক্রনাথ শিবের, লাগোয়া মহিষমর্দিনী মন্দির। আর আছে অক্ষয়বটের নীচে কালাপাহাড়ের বিনষ্ট করা হরগৌরীর ভাঙা শিলামূর্তি। বিপরীতের ছোটো মন্দিরে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর পদচিহ্ন রক্ষিত। আরও মন্দির আছে বক্রেশ্বরে। তবে বক্রেশ্বরের খ্যাতি তার উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য। সাতটি কুণ্ডের সহাবস্থান – ব্রহ্মকুণ্ড, অগ্নিকুণ্ড, জীবিতকুণ্ড, চন্দ্রকুণ্ড বা সৌভাগ্যকুণ্ড, সূর্যকুণ্ড, খরকুণ্ড এবং ভৈরবকুণ্ড।

(৬) কঙ্কালীতলা – প্রান্তিক পেরিয়ে কঙ্কালীতলা, সাড়ে ৮ কিমি। ৫১ পীঠের শেষ পীঠ এই। সতীর কাঁকাল তথা কোমর পড়েছিল। তবে এই নিয়ে বিতর্ক আছে। জনশ্রুতি, দেবীর কাঁকালরূপী শিলাখণ্ড রয়েছে মন্দির লাগোয়া কুণ্ডে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কোপাই। অদূরে কাঞ্চীশ্বর শিব ও দেবীর রুরু ভৈরবথান।

কঙ্কালীতলা।

(৭) নানুর – দ্বিজ চণ্ডীদাসের জন্মস্থান নিয়ে গবেষকরা আজ দ্বিধান্বিত হলেও নানুরের বাতাসে আজও সজীব চণ্ডীদাস-রজকিনী প্রেমকাহিনি। জনশ্রুতি, ১৪ শতকের কবি চণ্ডীদাসের জন্ম এই নানুরে, কঙ্কালীতলা থেকে ২০ কিমি, শান্তিনিকেতন থেকে ২১ কিমি। এখানে রয়েছে কবির আরাধ্যা দেবী বিশালাক্ষীর মন্দির। লাগোয়া ঢিবিটি আজও কবির বসতবাড়ির সাক্ষ্য বহন করছে। বিশালাক্ষীর মন্দির চত্বরে রয়েছে ডজন খানেক শিবমন্দির। দু’টি মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজে মূর্ত হয়েছে রাধাকৃষ্ণলীলা। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর নকশায় তৈরি হয়েছে তোরণ। থানার ডাইনে রামী ধোপানির পাট ও রক্ষা কালীমন্দির।

(৮) লাভপুর-ফুল্লরা – নানুর থেকে ২১ কিমি। ৫১ পীঠের এক পীঠ ফুল্লরা। দেবীর ওষ্ঠ পড়েছিল। তবে এই নিয়ে বিতর্ক আছে। বর্তমান মন্দিরটি ১৩০২ বঙ্গাব্দে তৈরি। মন্দিরে দেবীর কোনো বিগ্রহ নেই। সিঁদুরে চর্চিত কচ্ছপাকৃতির শিলাখণ্ড দেবীর প্রতিভূ। মন্দির লাগোয়া দেবীদহ। দহের ঘাটে দু’টি শিবমন্দির। মন্দিরের অদূরে কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মভিটে ‘ধাত্রীদেবতা’য় আজ হয়েছে সংগ্রহশালা। লাভপুর ছেড়ে কিছুটা যেতে বক্রেশ্বর ও শাল নদীর মিলিত জলে তৈরি কুলা নদীর বাঁক – তারাশঙ্করের বিখ্যাত উপন্যাসের ‘হাঁসুলীবাঁক’।

(৯) সাঁইথিয়া নন্দীকেশ্বরী মন্দির – আরও এক সতীপীঠ বলে দাবি করা হয়। বলা হয়, দেবীর কণ্ঠহার পড়েছিল এখানে। সাঁইথিয়া রেলস্টেশনের ঠিক বাইরে নন্দীকেশ্বরী মন্দির। অশ্বত্থ ও বটবৃক্ষের বাঁধানো বেদির প্রকোষ্ঠে তেলসিঁদুরে চর্চিত ত্রিকোনা এক শিলাখণ্ডই দেবীর প্রতিভূ। আরও নানা মন্দির ওই চত্বরে। শান্তিনিকেতন থেকে তারাপীঠ যাওয়ার পথে ৩৪ কিমি।

নিত্যানন্দ মহাপ্রভু মন্দির।

(১০) বীরচন্দ্রপুর – সাঁইথিয়া থেকে ২৬ কিমি। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর জন্মস্থান। মূল সড়কের ডাইনে নিত্যানন্দের আরাধ্য দেবতা বাঁকারায়ের আটচালা মন্দির। আর রয়েছে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু মন্দির, ষষ্ঠীতলা, বিশ্বরূপতলা, জগন্নাথদেবের মন্দির। ইসকনও মন্দির গড়েছে এখানে।

(১১) তারাপীঠ – বীরচন্দ্রপুর থেকে ৯ কিমি, শান্তিনিকেতন থেকে ৬২ কিমি দূরে শক্তিপীঠ তারাপীঠ। বণিক জয় দত্তের নির্মিত তারামায়ের প্রাচীন মন্দির আজ বিধ্বস্ত। বর্তমান মন্দির ১২২৫ বঙ্গাব্দে মল্লারপুরের জগন্নাথ রায় তৈরি করান। উত্তরমুখী আটচালা মন্দির। দেবীর ভৈরব চন্দ্রচূড় শিব রয়েছেন ছোটো মন্দিরে। মন্দির লাগোয়া জীয়ৎকুণ্ড আর বিরাম মন্দিরটিও দর্শনীয়। উত্তরবাহিনী দ্বারকার পাড়ে তারাপীঠ মহাশ্মশান। পঞ্চমুণ্ডির আসনপাতা মহাশ্মশানে। বামাখ্যাপার সমাধিমন্দিরে মূর্তি রয়েছে সাধকের। অদূরেই আটলা গ্রাম, বামাখ্যাপার জন্মস্থান। জন্মভিটেতে তৈরি হয়েছে স্মারকমন্দির।

কোথায় থাকবেন

শান্তিনিকেতনে থাকার জন্য রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্ন্য়ন নিগমের দু’টি জায়গা – শান্তবিতান ট্যুরিজম প্রপার্টি (অতীতের শান্তিনিকেতন ট্যুরিস্ট লজ) এবং রাঙাবিতান ট্যুরিজম প্রপার্টি। এখন করোনাভাইরাসজনিত লকডাউনের আনলক পর্বে বুকিং দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র রাঙাবিতান ট্যুরিজম প্রপার্টিতে। অনলাইন বুকিং: https://www.wbtdcl.com/

এ ছাড়া বোলপুর, শান্তিনিকেতন আর সোনাঝুরিতে প্রচুর বেসরকারি হোটেল আছে। নেটে সন্ধান করলে পাওয়া যাবে। তবে সব হোটেল খোলেনি।       

কেনাকাটা

শান্তিনিকেতনে যাবেন, আর কিছু কেনাকাটা করবেন না, তা হতেই পারে না। নানা ধরনের হস্তশিল্পের প্রসবঘর এই শান্তিনিকেতন। এমনকি দৈনন্দিন জীবনে লাগে, এমন সব রকম জিনিস মেলে এখানে। এ অঞ্চলের ঘরে ঘরে তৈরি হয় এ সব সম্ভার। কেনার মূলত তিনটি জায়গা –

(১) শ্রীনিকেতন – বিশ্বভারতীর পল্লি শিল্পকেন্দ্র বিভাগ।

(২) আমার কুটির – শাল-সোনাঝুরির জঙ্গলে কোপাইয়ের পাড়ে ‘আমার কুটির’। গান্ধীজির অনুপ্রেরণায় বিপ্লবী সুষেণ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল এই ‘আমার কুটির’। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে আর এক স্বাধীনতা সংগ্রামী পান্নালাল দাশগুপ্তও এখানে থেকেই সমাজসেবার নানা কাজকর্ম চালিয়ে গিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে এর উদ্দেশ্য ছিল সদ্য মুক্তি পাওয়া বিপ্লবীদের একটি আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা। তাঁদের তৈরি জিনিস এখান থেকে বিপনন করে খরচ তোলা হত। পরবর্তীকালে সমবায় গড়ে স্থানীয় তাঁত, চামড়া, ডোকরা ও বিভিন্ন হস্তশিল্পীর শিল্পসামগ্রী এখান থেকে বিক্রি করা শুরু।

সোনাঝুরির হাট।

(৩) সোনাঝুরির হাট – প্রতি শনিবার হাট বসার কথা, তবে এখন রোজ বসে। তবে শনিবার দিনটা জমে বেশি। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত হাট চলে। স্থানীয় হস্তশিল্পীরা তাঁদের হাতে তৈরি করা শিল্পসম্ভার নিয়ে গুছিয়ে বসেন। এই হাটে হেন জিনিস নেই যা পাওয়া যায় না। এন্তার নেড়েচেড়ে দেখা যায়, দরদাম করা যায়।

পথে বিশেষ কিছু খাওয়া

পথে বিশেষ কিছু খাওয়ার জায়গা আছে। যাওয়ার সময় খেতে পারেন বা ফেরার সময় বাড়ি বা আত্মীয়স্বজন-বন্ধুদের জন্য কিনে আনতে পারেন। রিষড়ায় ফেলু মোদকের ভাজা মিষ্টি, চন্দননগরে সূর্য মোদকের জলভরা সন্দেশ, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের সীতাভোগ এবং গুসকরার কাছে বড়ার চৌমাথায় মন্ডা। আর যাই হোক, বড়ার চৌমাথায় দিলীপ ঘোষের অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মন্ডা খেতে বা নিতে ভুলবেন না।    

শক্তিগড়ে ল্যাংচা কিনতে ভুলবেন না।

মনে রাখুন

 (১)  শান্তিনিকেতন আসার পথে যতগুলো দ্রষ্টব্যের কথা লেখা হয়েছে, তার সবই যে দেখতে হবে, তার কোনো অর্থ নেই। কোনটা দেখবেন, কোনটা দেখবেন না, সেটা আপনার ব্যাপার। তবে জিটি রোড ধরে এলে একেবারে যেগুলো পথের ধারে পড়বে সেগুলো দেখে নিতেই পারেন। যেমন, উত্তরপাড়ায় জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি, কোন্নগরের দ্রষ্টব্যগুলি, মাহেশের রথ ও জগন্নাথ মন্দির, চুঁচুড়ায় সুশানা আন্না মারিয়ার স্মৃতিসৌধ, বর্ধমানের নবাবহাটায় ১০৮ শিবমন্দির ইত্যাদি।

(২) এই সময়ে কী ভাবে হোটেল তার অতিথিদের দেখভাল করবে তার এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) জারি করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, থার্মাল গান দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপানো ইত্যাদি সাধারণ নিয়মগুলি ছাড়া আর কী কী নিয়ম মানতে হবে তা যাত্রার আগে হোটেলের সঙ্গে ভালো করে কথা বলে জেনে নেবেন।

(৩) গাড়িকে যথাসম্ভব শীতাতপনিয়ন্ত্রিত না করে জানলা খুলে চলুন। হাওয়া যতটা চলাচল করানো যায়। তাতে যাত্রাপথে মাস্ক পরে থাকলে সুবিধা হবে। আর পুরো যাত্রাপথে মাস্ক পরে থাকা বাঞ্ছনীয়। আর হাত মাঝেমাঝেই স্যানিটাইজ করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *