চেনা পথের অচিনপুর: শেষ পর্ব/রেখে গেলাম পদচিহ্ন, নিয়ে গেলাম স্মৃতি

Mt. Everest from Sandakphu
shounak gupta
শৌনক গুপ্ত

খুব আস্তে আস্তে অনেকক্ষণ ধরে হাঁটব, এই মানসিকতা নিয়ে কিছুটা চলতেই দেখি বিকেভঞ্জন অনেক নীচে চলে গেছে। আরও কিছুক্ষণ পর পথও সমতল হয়ে এল। ভাবলাম পৌঁছোতে বোধহয় আর দেরি নেই। কিন্তু আরও আধ ঘণ্টা পর আবার চড়াই শুরু হতে বুঝলাম পাহাড়ের পথ সম্পর্কে হালকা ভাবে ধারণা করে নেওয়া কত বড়ো ভুল।

আরও পড়ুন চেনা পথের অচিনপুর: দ্বিতীয় পর্ব/রোদ পোহাচ্ছে কালিপোখরি

একটা মাইলস্টোন কিছুটা আশ্বাস দিয়ে জানিয়ে দিল, আর দু’ কিলোমিটার। আর পরের বাঁকেই রডোডেনড্রন গাছের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা রুপোলি কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝিলিক দিয়ে উঠল। কিছুটাই অংশ, তবু সেই ঝলমলে তুষারখণ্ড রোমাঞ্চ জাগায়। প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় ব্যাগে রাখা ক্যামেরা হাতে চলে আসে।

আমাদের গতি বাড়ল। প্রতি বাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘার আরও কিছুটা করে অংশ খুলে যাচ্ছে। সুনীল প্রেক্ষাপটে তার শুভ্রতা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। অবশেষে এল সেই মাইলস্টোন, যার গায়ে লেখা ‘সান্দাকফু ০ কিলোমিটার’। সেখানেই ছবি তোলার হিড়িক। আসলে এখান থেকে সান্দাকফু গ্রামের শুরু। আমাদের চেনা ‘সান্দাকফু’ পৌঁছোতে তখনও প্রায় দেড় কিলোমিটার চড়াই বাকি।

সেই পথও অবশ্য এক সময় শেষ হল। বন দফতরের অফিস আর সোলার বাতির সারি দেখতে পেয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলাম। রাস্তার দু’ ধারে দু’ দেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে। দু’ দেশেই কিছু কিছু ঘরবাড়ি। নেপালের দিকের একটা ঘরে আমাদের আশ্রয় জুটল।

মেঘ এসে পাহাড়ের রঙ্গমঞ্চে পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। আমরাও তাই এই সুযোগে সাফসুতরো হওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছি। এ দিকে গরম জলের বালতি তো দূরের কথা, খাওয়ার জল চাইলেই হোটেলের কর্মীরা আঁতকে উঠছেন। অগত্যা নিজেরাই অস্থায়ী রসুইঘরটায় গিয়ে দেখি একটা মাঝারি কড়াইয়ে জল গরম হচ্ছে আর তার সামনে চাতকের মতো সবাই বোতল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানা গেল, কলের জলও মিলবে দিনে মাত্র চার বার, প্রতি বার আধ ঘণ্টা করে। এত পরিবর্তনের মধ্যেও এটুকু যেন সান্দাকফুর সেই পুরোনো দুর্গমতার স্বাদ দিল।

বেলা পড়ে আসতেই শুরু হল প্রবল ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। হোটেলের মূল দরজাও খুলে রাখা দায়। সেই হাওয়ার ঝাপটায় কখনও কখনও মেঘের পর্দা সরে যাচ্ছে। কিছু পরে ফালুটগামী রাস্তার দিকে সূর্যাস্ত হল। গোধূলির নরম আলোয় দিনের মতো শেষ বার দেখা গেল কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। ‘ঘুমন্ত বুদ্ধ’ তাঁর মেঘ-শয্যায় শুয়ে। তাঁকে শুভ রাত্রি জানিয়ে বলে রাখলাম, কাল ভোর পাঁচটায় দেখা হচ্ছে।

হাওয়ার তাণ্ডব চলল সারাটা রাত। তার শোঁ শোঁ আওয়াজ মাঝে মাঝে বিভীষিকা তৈরি করে। এই বুঝি ঘরের চাল উড়ে যাবে। তবে অ্যালার্মের শব্দ যখন ঘুম ভাঙাল, হাওয়ার শব্দ ততক্ষণে হারিয়ে গেছে। ভোর হতে তখনও বাকি। এখানে কেবল সন্ধে ছটা থেকে রাত দশটা অবধিই বিজলিবাতি মেলে। তাই অন্ধকারেই তৈরি হয়ে নিয়ে হোটেলের ছাদে চলে এলাম।

পুব আকাশে একটা লম্বা লাল রেখা আমাদের অল্প অল্প দেখতে সাহায্য করছে। আরও যাঁরা এসেছেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই হয়তো কাল আলাপ হয়েছে, কিন্তু এখন চেনার উপায় নেই। প্রত্যেকেই আপাদমস্তক শীতবস্ত্রে মোড়া। আমাদের ঠিক সোজাসুজি সেই বিখ্যাত দৈত্যাকার শৃঙ্গসমাহার শায়িত। আধো-অন্ধকারেও তখন তার শরীর জুড়ে শীত খেলা করছে। মাঝে মাঝে সেই চোরা বাতাসে ভেসে এসে আমাদেরও ছুঁয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর সেই লাল রেখা চিরে নতুন সূর্য হীরের মতো ঝলসে উঠল। তার আলোয় দেখলাম সমস্ত মেঘ ঘনীভূত হয়ে পাহাড়ের নীচে জমা হয়েছে। যেন এক বিশাল সমুদ্র। কিছু ছোটো মেঘ তাতে ঢেউয়ের আকার নিয়েছে। সেই সমুদ্রতীরে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ-শীর্ষ তখন লাল হয়ে জ্বলছে। সে যেন ক্ষণিকের লাইট হাউস। ক্রমে ক্রমে কুম্ভকর্ণ থেকে পান্ডিম অবধি কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের সব ক’টা চূড়োয় সোনালি রঙ ধরল।

পশ্চিমে নেপাল থেকে পূর্বে অরুণাচল হিমালয় পর্যন্ত ব্যাপ্তি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভূটানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ চোমলহরী উঁকি দিচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার শরীর জুড়ে রঙের খেলা দেখতে দেখতেই আরও পশ্চিমে চোখ চলে যায়। প্রবল শীতে একটু উষ্ণতার খোঁজেই যেন অনেকগুলো রক্তিমাভ তুষারশৃঙ্গ গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে তিন জনের বন্ধুত্ব দৃশ্যতই একটু বেশি। মাঝের জন মাউন্ট এভারেস্ট। তার পরিচয় আলাদা করে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। সে স্বয়ং বিস্ময় আর রোমাঞ্চের মূর্ত প্রতীক। তার দু’পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে চতুর্থ উচ্চতম লোৎসে ও পঞ্চম উচ্চতম মাকালু। পারিষদ হিসেবে রয়েছে চামলাং, বরুণৎসে, নুপৎসে ও চোমলোনজো।

এমন আবহাওয়ার জন্য নিজের ভাগ্যকে তারিফ করি। এর সবটুকু আজ হৃদয় আর ক্যামেরায় ভরে নিতে হবে। তুষারশ্রেণি সোনালি থেকে ক্রমে রুপোলি হল। পাখির কলরবে চার দিক ভরে উঠেছে। ঘড়িতে সকাল ছটা। কলে জল এসেছে, কেবল আধটি ঘণ্টার জন্য। ঘরে ফিরে আসতেই হল।

অবশেষে বিদায়ের মুহূর্ত। টানা উৎরাই পেরিয়ে শ্রীখোলা নেমে যেতে হবে। বাইরে এসে দেখি ‘ঈশ্বর’ তখনও ‘নিদ্রিত’। প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করতে করতে আমরা তার এই শয়নকক্ষও আবর্জনায় ভরে দিয়েছি। তবু তাঁর ঘুম ভাঙেনি। তবে কি তিনি মৃত? নাকি সেই অন্ধকার রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে, বাতাস যখন পাগলের মতো মাথা কুটে মরে, তিনি হয়তো বন বিভাগের চাতালটায় এসে বসেন – ওই রডোডেনড্রন গাছটার তলায়।

আস্তে আস্তে নামতে শুরু করি। বন বিভাগের একটা বোর্ডের ওপর দিয়ে শেষ বারের মতো দেখি তাঁকে। বোর্ডে যেন সেই শীতের রাতে তিনিই দু’ কথায় লিখে রেখে গেছেন নিজের মনের কথা – “লিভ নাথিং বাট ফুটপ্রিন্টস, টেক নাথিং বাট মেমোরি”। (শেষ)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *