রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ১০ : কুপুপ থেকে গ্যাংটক

tsomgo lake
sudip paul
সুদীপ পাল

পুরোনো বাবা মন্দির থেকে মাত্র কয়েক কিমি রাস্তা, আধ ঘণ্টায় চলে এলাম কুপুপ লেক। বরফ গলতে শুরু করেছে। রাস্তায় কাদা-কাদা ভাব। অত্যন্ত স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। হালকা কুয়াশায় চারিদিকে একটা বিবর্ণতার প্রলেপ। এটাই এই পথের সর্বোচ্চ স্থান, ১৪০০০ ফুট।

আরও পড়ুন রহস্যময় রেশম পথ / পর্ব ৯ : বরফের রাজ্যে

গাড়ি থেকে নেমে এলাম। জুতো অনেক আগেই ভিজে গিয়ে রসবড়া হয়ে গিয়েছে, সুতরাং আর জুতো ভেজার ভয় নেই। অরূপদাও নামল। বাকিরা গাড়ির বন্ধ জানলার ভিতর থেকে কুপুপ লেক দর্শন করেই সন্তুষ্ট। আমাদের পিছনে পিছনে মহিলাদের গাড়িটাও চলে এসেছে। ওঁরাও নেমে পড়লেন। এ-দিক ও-দিক কিছু ফোটো তোলার পর আমার ক্যামেরাটা ওঁদেরই একজনের শ্রীহস্তে সমর্পণ করলাম আমাদের দু’জনের চাঁদবদনের ছবি তোলার জন্য। 

kupup lake
কুপুপ লেক।

জায়গাটার নাম কুপুপ, সেখান থেকেই কুপুপ লেক নামে পরিচিতি। আসল নাম এলিফ্যান্ট লেক। উপর থেকে লেকের আকার হাতির মতো দেখতে লাগে। লেকের বাম তীর বরাবর জেলেপ-লা যাওয়ার রাস্তা সরু ফিতের মতো দেখা যাচ্ছে। এ পথ এখন সেনাবাহিনীর দখলে, সাধারণ মানুষের যাওয়া নিষিদ্ধ। ভারত, চিন ও ভুটানের সংযোগস্থলে ডোকলা সীমান্ত। এই ডোকলা নিয়ে বছরখানেক ধরে ভারত ও চিনের মধ্যে উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আর এই পথ হল ডোকলা যাওয়ার।

চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন ও বরফাবৃত হয়ে থাকার কারণে লেকের জল কাকচক্ষুর মতো কালো দেখাচ্ছে।  এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে মিলিটারি ক্যাম্প ও বিশ্বের সর্বোচ্চ ইয়াক গলফ কোর্স।

আমরা ফিরতেই ভূপাল গাড়ি ছেড়ে দিল। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিল, আমরা এ বার মিলিটারি ক্যাম্প এরিয়ার ভিতর দিয়ে যাব। কেউ যেন কোনো ফোটো না তুলি। ধরা পড়লে ক্যামেরা বাজেয়াপ্ত হওয়া, জেল প্রভৃতি অনেক কিছুই সাজা হতে পারে। ক্যামেরা অফ করে রেখে দিলাম। 

yak golf course and ice hockey ground
ইয়াক গলফ কোর্স ও আইস হকির মাঠ।

সেনাশিবির পেরিয়ে আসার পরেই ডান দিকে বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর পেলাম। এটাই ইয়াক গলফ কোর্স। ইয়াক গলফ কোর্সের এক ধারে আইস হকি ফিল্ড। আইস হকি ফিল্ডের পিছনে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে । ২০/২৫ টা বাড়ি নিয়ে এই গ্রাম। এই গ্রামে বাইরের লোক বা ট্যুরিস্টদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয় না। এখানে থাকার জন্য গ্রামবাসীদের প্রতি মাসেই অনুমতি নবীকরণ করাতে হয়। 

বরফ গলা শুরু হয়ে গিয়েছে। চারিদিক থেকে জল বয়ে যাচ্ছে ফলে একটা কেমন একঘেয়ে ঝিম ধরা আওয়াজ। এক সময় ইয়াক গলফ কোর্স আড়ালে চলে গেল। আমাদের বাঁ পাশে বিশাল এক খাদ রাস্তা বরাবর চলেছে। খাদে ও পাহাড়ের গায়ে হাজার হাজার পাইন গাছ। ভূপাল জানাল, ওই খাদেই কোনো এক জায়গায় রয়েছে মেমেঞ্চ লেক। মেমেঞ্চ লেকে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু এখন সম্ভব নয়। কারণ, ২/৩ কিমি ট্রেক করে লেকে পৌঁছোতে হয়।

new baba mandir
নতুন বাবা মন্দির।

চলে এলাম নতুন বাবা মন্দিরে। আমরা পুরোনো বাবা মন্দির দেখে আসছি, যা আসল বাবা মন্দির। দীর্ঘ জার্নিতে শরীরের সঙ্গে মনেও একটা ক্লান্তি এসেছে। তাই কেউ নামতে রাজি হল না। মন্দিরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি থেকেই দেখে নিলাম। ভিতরে সিংহাসনে হরভজন সিং-এর ছবি। পুরোনো বাবা মন্দির অনেক উঁচুতে আর অনেকটাই দূরে। সবাই সেখানে যেতে পারেন না। তাই অনেকটা নীচে এখানে এই নতুন বাবামন্দির তৈরি হয়েছে।

বরফঢাকা পরিবেশের মধ্যে চলেছি। এ দিকে রূপের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ওর জ্বর এসেছিল লক্ষ্মণচকে। নাথাং ভ্যালি পৌঁছোনোর আগেই ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। এখন ক্লান্তির কারণে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে সম্ভবত। ওকে কোকা ৩০ খাইয়ে হাতে কর্পূরের শিশি ধরিয়ে দেওয়া হল শোঁকার জন্য। এই দু’টো জিনিসই শ্বাসকষ্টে খুব কাজের।

hangu lake with welcome gate
হাঙ্গু লেক ও ওয়েলকাম গেট।

আমাদের গাড়ি হাঙ্গু লেকের (ছাঙ্গু নয়) সামনে চলে এল। এটাই হল পৃথিবীর উচ্চতম লেক যেখানে বোটিং হয়। একটা ওয়েলকাম গেট রয়েছে। গেটে লেখা অ্যালপাইন পার্ক। কোত্থাও কেউ নেই। লেকে যাওয়ার জন্য প্রবেশমূল্য লাগে কিনা জানি না। একটাও বোট চোখে পড়ল না। বরফে চাপা পড়ে থাকতে পারে। 

ganju lama war museum
গঞ্জু লামা ওঅর মিউজিয়াম।

হাঙ্গু লেকের পাড় বরাবর রাস্তা। লেক পেরিয়ে কিছুটা আসার পর বাঁ দিকে পড়ল গঞ্জু লামা ওঅর মিউজিয়াম। ভারত-চিন যুদ্ধের স্মৃতিতে এই মিউজিয়াম। মিউজিয়াম সম্ভবত খোলা আছে কিন্তু কোনো জনপ্রাণীও নেই। তবে এখন মিউজিয়াম দেখতে যাওয়ার মতো ধৈর্যও আমাদের নেই।

কিছু পরে রাস্তার ডান দিকে নাথুলা যাওয়ার রাস্তা উপর দিকে উঠে গিয়েছে দেখলাম। রাস্তার শুরুতেই একটা ওয়েলকাম গেট। নাথুলা যাওয়ার জন্য আলাদা অনুমতি নিতে হয় গ্যাংটক থেকে। আমাদের সেই অনুমতি নেই, তাই যাওয়ার প্রশ্নই নেই। 

sherthang
শেরথাং।

রাস্তার বাঁ দিকে আবার এক লেকের দেখা পেলাম, নাম মঞ্জু লেক, হাঙ্গু বা ছাঙ্গুর তুলনায় অনেক ছোটো। লেকের জল পুরো হোয়াইট ওয়াশ হয়ে গিয়েছে। রাস্তার ধারে ৬ ইঞ্চি পুরু বরফ। এখানেও গাড়ি না থামিয়া চলে এলাম শেরথাং। নাথুলা বর্ডার দিয়ে যে সব ট্যুরিস্ট কৈলাস-মানস সরবোর যান তাঁদের জন্য সুন্দর সুন্দর কিছু ঘর করা আছে এখানে। অর্থাৎ তাঁদের আক্লাইমেটাইজ করার জন্য ব্যবস্থা। দুধ-সাদা বাড়িগুলির সবুজ ছাদ এখন বরফে সাদা।

গাড়ি চলছে থেগুর উপর দিয়ে। ছাঙ্গু এখনও ৪ কিমি দূরে। হঠাৎ ‘মোনাল’,  ‘মোনাল’, বলে ভূপাল সজোরে গাড়ি ব্রেক কষল। খ্যাসসসস করে আওয়াজ তুলে বরফে ফুট খানেক হড়কে গিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। চেয়ে দেখি সামনে ডান দিকে সিকিমের রাজ্য পাখি মোনাল। হাঁসের মতোই আকার। দেহের গঠন ময়ুরের মতো। সবুজ মাথায় ময়ুরের মতোই একটা ঝুঁটি। সামান্য লম্বা গলায় উজ্জ্বল লাল ও হলুদ রঙ থেকে যেন দ্যুতি বেরোচ্ছে। উজ্জ্বল ঘন নীল রঙের দেহ। পানকৌড়ির লেজের মতো লেজ। লেজের শেষ দিকটা কমলা রঙ। মোনালের সারা শরীরের সমস্ত রঙই মেটালিক। অপুর্ব তার রূপ। যারা মোনাল চেনে না তারা ময়ূর বলে ভুল করতে পারে।

monal
মোনালের ছবি তোলার ব্যর্থ চেষ্টা।

জীবনে প্রথম মোনাল দেখলাম। পাখিটা ব্রেকের শব্দে ও আকস্মিক গাড়ি থামার কারণে ভয় পেয়ে ডান দিকের পাহাড় বেয়ে দ্রুত উঠতে শুরু করেছে। আমি বিহ্বল হয়ে তাকে দেখছি। গলায় ক্যামেরা ঝুলছে কিন্তু ফোটো তোলার কথা ভুলে গিয়েছি।

ক্যামেরা বার করুন – ভূপালের কথায় সংবিৎ ফিরল। ক্যামেরার ব্যাগ থেকে দ্রুত ক্যামেরা বার করে অন করতে করতে সে আরও খানিকটা উপরে। মোটামুটি ক্যামেরার রেঞ্জের বাইরে। তার উপর উজ্জ্বল সাদা আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড। ছবি কালো আসছে, তবুও শট নিলাম। মনের মধ্যে মিশ্র অনুভুতি। এক দিকে মোনাল দেখার আনন্দ অপর দিকে তাকে ঠিকমতো ক্যামেরাবন্দি করতে না পারার দুঃখ।  

মোনাল চোখের আড়ালে যেতেই আবার যাত্রা শুরু। রাস্তার বাম দিকে গভীর খাদ। খাদের অপারে উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণি মাথায় বরফের মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছে। ওই পাহাড়শ্রেণির যে রাস্তা লেপটে আছে সেই রাস্তায় কিছুক্ষণ পরেই চলে এলাম। ছাঙ্গু লেক আর দু’ কিলোমিটার।

way to tsomgo lake
ছাঙ্গু যাওয়ার পথ।

রাস্তায় জওয়ানদের আনাগোনা দেখতে পাচ্ছি। আমরা হাত নাড়লে তাঁরাও হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে। এক সময় অনেক উপর থেকে লম্বালম্বি ভাবে ছাঙ্গু লেককে দেখতে পেলাম। লেকের দু’ দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আমরা যে দিকে এখন আছি সে দিক ধরলে তিন দিক হয়। মনে হল বিশাল দৈত্যাকার সাদা রঙের এক নৌকার খোলে খানিকটা জল জমে আছে। খানিকক্ষণ বাদে বাদে ইউ টার্ন নিয়ে গাড়ি ক্রমশ নীচের দিকে নামতে থাকল। যত এগোচ্ছি লেকের আকার ততোই বড়ো হচ্ছে আমাদের চোখে।  এর আগে ২০১৫-য় গ্যাংটক থেকে ছাঙ্গু লেক পর্যন্ত আসতে পেরেছিলাম। বরফের কারণে রাস্তা বন্ধ থাকায় আমরা আর যেতে পারিনি। এ বারেও যাঁরা নাথুলা বা বাবা মন্দির যাওয়ার জন্য গ্যাংটক থেকে আসছেন তাঁদের ছাঙ্গু লেকের পরে আর যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।  আমরা বিপরীত দিক থেকে আসছি, তাই আমাদের এ পথে যাওয়ার সৌভাগ্য হল। 

tsomgo lake
রাস্তার পাশেই ছাঙ্গু লেক।

লেকের পাশে রাস্তার এক ধারে গাড়ি দাঁড়াল। সবাই নেমে পড়লাম। লেকের জলে পাশের পাহাড়শ্রেণির প্রতিবিম্ব।  ২০১৫ সালে ছাঙ্গু এত ঘিঞ্জি ছিল না। প্রচুর ঘরবাড়ি হয়েছে, রোপওয়ে চালু হয়েছে। সেবার লেকের ধার ধরে হেঁটে হেঁটে ও পারে গেছিলাম। এ বার আর সেই এনার্জি আর নেই। তা ছাড়া চারিদিকে মোটা বরফের স্তর। বরফগলা জলে ইয়াকের বিষ্ঠা মিশে যাচ্ছেতাই নোংরা হয়ে আছে।

রোপওয়ে স্টেশনে যাওয়ার সিঁড়ির কাছেই লেক থেকে একটা জলধারা বেরিয়ে এসেছে। এটাই রোরো নদী। এই নদী তিস্তার সাথে মিশেছে। মেঘলা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় লেকের ধারে আধ ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে ফটোসেশন করে গাড়িতে উঠলাম। 

market area neas tsomgo lake
ছাঙ্গু পেরিয়ে এসে বাজার এলাকা।

কয়েকটা হেয়ারপিন বেন্ড দিয়ে দু’ কিমি রাস্তা পেরিয়ে একটা বাজার এলাকা পেলাম। বাজার বলতে মূলত রেস্টুরেন্ট, শীতবস্ত্রের আর  মেমেন্টোর দোকান। একটা দোকানে মোমোর অর্ডার দিলাম। চা-ও খেতে হবে। ভেজ মোমো আমার ভীষণ পছন্দের খাবার। ভূপাল দেখি থুকপার বাটি নিয়ে বসেছে। খাওয়ার পর গরম চা-এর কাপে চুমুক। কী আরাম যে লাগল। সব ক্লান্তি যেন নিমেষে গায়েব। খাওয়ার পর্ব শেষ, আবার যাত্রা।  

 way to gangtok
গ্যাংটকের পথে ক্রমশই নেমে যাওয়া।

এই রাস্তাটাও বড়ো সুন্দর। চারিদিকে সবুজ ঘাসে মোড়া পাহাড়ের গায়ে পাইন গাছের ছড়াছড়ি। পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে মেঘের লুকোচুরি। চলতে চলতে একটা ঝরনার সামনে থামলাম। এই ঝরনার নাম কংনসলা ওয়াটার ফল্‌স। এই জায়গা বোধহয় সারা বছরই কুয়াশাঢাকা থাকে। গাড়ি থেকে কেউ নামল না। আমি একা নেমে ঝরনার ক’টা ঝাপসা ছবি তুলে আনলাম।

temporary falls
হঠাৎ ঝরনা।

খানিকক্ষণের মধ্যেই শুরু হল ঝিমঝিম বৃষ্টিল। এই আবহাওয়ায় পাহাড়ে চলার মজা হল, রাস্তার ধারে ধারে হঠাৎ তৈরি হওয়া ঝরনা দেখতে পাওয়া যায়। আমরাও পথের ধারে তেমন কিছু ঝরনা পেলাম। ক্রমশ নীচের দিকে নামছি। গাছপালারও পরিবর্তন হচ্ছে। পাইন গাছের পাশাপাশি ঝোপঝাড় ও অন্য বড়ো গাছও চোখে পড়ছে।

ঝিমঝিমে বৃষ্টিতেই ঢুকে পড়লাম গ্যাংটকে। কিছুক্ষণ আগেও যে পরিবেশে ছিলাম তার সঙ্গে কিছুতেই যেন মেলাতে পারছি না। কংক্রিটের জঙ্গল, গাড়ির ভিড়, মানুষের কোলাহল। অসহ্য। এম জি মার্গের নীচের দিকেই আমাদের লজ। পৌঁছে গেলাম সেখানে। (চলবে)

ছবি লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *