দ্য গ্রেট গোয়া ৩ / কালাঙ্গুটে-বাগা দর্শনের পর সানসেট ক্রুজে

স্বপ্ন পাল

গাড়ি চালাতে চালাতে আসিফ জানাল আমরা এখন কালাঙ্গুটে বিচে যাচ্ছি। পার্কিং-এ গাড়ি রাখা থাকবে। হেঁটে চৌরাস্তা পেরিয়ে বিচে যেতে হবে। এক ঘণ্টা বিচে ঘুরে আবার চৌরাস্তায় এসে তাকে ফোন করে ডেকে নিতে হবে।

এক সময় আমরা চৌরাস্তায় পৌঁছেও গেলাম। আসিফ আমাদের নামিয়ে দিয়ে পার্কিং-এ চলে গেল। দু’দিকে মার্কেট, মাঝখানে বিচে যাওয়ার চওড়া রাস্তা।

উরিব্বাস! এত এ যেন মিনি গঙ্গাসাগর মেলা! এত ভিড় আমি গোয়ার একটা বিচেও দেখিনি এ পর্যন্ত। সারা ভারতের সব রাজ্যের মানুষই বোধ হয় এখানে আছে। মানুষের সাথে সাথে ষাঁড়েরাও পদচারণা করছে। তারা অবশ্য সঙ্গীসাথী পছন্দ করে না বলে একা একাই ঘুরছে। সরকারি ভাবে হোক বা না হোক, ধর্মরাজ নিশ্চয়ই এদের ওয়াচম্যান (নাকি ওয়াচবুল) হিসাবে রেখেছে জাতে বিচে কোনো অধর্ম না হয়।

অন্য বিচের মতো এখানেও লাইফগার্ডের কিয়স্ক রয়েছে। সারা বিচ জুড়েই লাইফগার্ডরা ছাতা ও উঁচু চেয়ার নিয়ে বসে আছে। মাইক নিয়ে হাঁকডাকও চলছে কিয়স্ক থেকে। কালাঙ্গুটে বিচে বিক্ষিপ্ত ভাবে অনেক ঝাউ গাছ আছে। তারই একটার তলায় আমরা দেহ রাখলাম, থুড়ি আরাম করে বসলাম।

হাতে এখনও ৪০ মিনিট সময়। বিচে বাথরুমও আছে। ভাবলাম কিছুক্ষণ সমুদ্রে স্নান করলে কেমন হয়? প্রস্তাবে বিশেষ কেউ রাজি হল না। দরকার নেই কাউকে। রূপকে নিয়েই জলে নামব। কিন্তু পোশাক তো নেই সঙ্গে। কাছেই তো বাজার। কিনে আনলেই হয়। রূপ কিছুতেই ছাড়ল না, আমার সঙ্গ নিল। বাজারে শুরু হল বিবিধ বায়নাক্কা। ওর বায়নাক্কা সামলাতে সামলাতেই সময় গেল। আর মাত্র ২০ মিনিট হাতে। আর কিনে কী হবে? ফিরে এলাম। সমুদ্রস্নানের বদলে খানিক ঘর্মস্নান অবশ্য হল। বিরস বদনে সমুদ্রের দিকে জুল জুল করে থেকে বাকি ২০ মিনিটও হজম করে আমরা উঠে পড়লাম।

এ বার গন্তব্য বাগা বিচ।

বাগায় জলক্রীড়া।

নারকেলগাছের বাগান পেরিয়ে তবে বিচে নামতে হবে। ৩টে বেজে গেছে। সুর্যটা গোঁত খেয়ে নারকেলগাছের মাথায় পড়েছে। রোদের ঝাঁঝ কোনো দজ্জাল মহিলার ঝাঁঝের থেকে কোনো অংশে কম নয়। সমুদ্র নীল রং হারিয়ে রুপোলি বর্ণ ধারণ করেছে। যেন তরল রুপোর সমুদ্র।

কালাঙ্গুটে বিচের মতো অত ভিড় না থাকলেও এখানেও বেশ ভিড়। ছাতার নীচে বিছানা এখানেও আছে এবং যেন একটু বেশি মাত্রাতেই। অনেকগুলো খাটেই ভারতীয়রাও শুয়ে আছে দেখলাম। আগে ভেবেছিলাম গোয়া বোধহয় বিদেশিদেরই শুইয়ে দেয়, এখন দেখছি দেশিদেরও বাদ দেয় না।

দেখাদেখি পর্ব শেষ করে সামনে এগোবো বলে মুখটা সবে ঘুরিয়েছি এমন সময় আমার মুখের সামনে দেখি আর এক মুখ। জানতে চাইল বেড ভাড়া নেব কিনা।

– এই মরেছে! আমাকেও শুইয়ে দেওয়ার তাল! হাজার হোক বাঙালি, শোয়ার কথা শুনে পিঠটা সুড়সুড় করে উঠল। জিজ্ঞাসা করলাম, কত করে?

– ঘণ্টায় ১০০ টাকা। পিঠে যেন ছ্যাঁকা লাগল। এই পীঠে পিঠ ঠেকানোর সময় নেই। সামনে এগিয়ে গেলাম। আবার একজন পথ রোধ করে দাঁড়াল। ইনি ওয়াটারস্পোর্টসের আবেদন নিয়ে এসেছেন। এ সব হল মানি এক্সপেন্ডিচার স্পোর্টস। ওয়াটারস্কুটারে একশো মিটার গিয়ে ফিরে আসার জন্য ৫০০ টাকা। বাগা বিচে এসে এঁদের বাগে যাঁরা পড়েছেন তাঁদের অবস্থা অনুমান করতে পারি।

ডান দিকে একটা ছোট্টো নদী এসে সমুদ্রে মিশেছে। সেখানে একেবারেই ভিড় নেই। জায়গাটাও সুন্দর। ওই দিকেই হাঁটা লাগালাম। কিছুটা দূরে একটা ম্যাট পেতে দুই বিদেশিনি বসে আছে। না, এরা বিকিনি পরিহিতা নয়। অনতিদূরে দু’টি কুকুর ঘুরঘুর করছে।  কুকুর দু’টো ঘুরতে ঘুরতে বিদেশিনিদের সঙ্গে আলাপ জমাতে গেল। তারাও একটু আদর করে দিল কুকুরদুটোকে। কুকুরদ্বয় এতেই রোমিও হয়ে পালটা আদর করতে যেতেই বাধল বিপত্তি। জুলিয়েটরা দৌড়াদৌড়ি করে, রোমিওরাও পিছু ছাড়ে না। নেপোয় মারে দই। মাঝখান থেকে আমি দু-একটি ভালো ছবি পেয়ে গেলাম। শেষে এক জুলিয়েটকে তো এক রোমিও নদীর জলে নামিয়ে ছাড়ল।

৪টে বাজে। ৫টায় সানসেট ক্রুজ শুরু হবে। তাই এখনই বাগাকে বাই বাই করা দরকার। সবাইকে ডেকে নিলাম। আসিফ জানাল, ক্রুজে পৌঁছোতে আধ ঘণ্টা লাগবে। গাড়ির ভিতরে গানের আওয়াজ ছাড়া কারও মুখে কোনো কোথা নেই। পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্লান্তি আমারও যে লাগছে না তা নয়। গোয়া জুড়ে দেওয়ালির প্রস্তুতি চলছে দেখতে পাচ্ছি। এক সময় পৌঁছে গেলাম। ৩০০ টাকা করে টিকিটও কেটে ফেললাম।

সময় সূর্যাস্তের, তাই সানসেট ক্রুজ। আমরা মান্ডবী নদীতে নাচ দেখতে দেখতে এক ঘণ্টার জাহাজ ভ্রমণ করব। এই ক্রুজ ছাড়াও আরও অনেক ক্রুজ আছে গোয়াতে। এক ঘণ্টার ক্রুজ থেকে শুরু করে সারা দিনের ক্রুজও হয়।

জাহাজের তিনটে ফ্লোর। একদম উপরে খোলা আকাশের নীচে সারি সারি চেয়ার পাতা। সেই চেয়ারে গিয়ে বসলাম। সামনে একটা স্টেজ। সেখানেই নাচ-গান হবে। সুর্যদেব তাঁর লাল রঙের নাইটগাউন পরে নিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মান্ডবী নদীতে নিদ্রা যাবেন। চার পাশে হালকা ধোঁয়াটে ভাব। স্টেজের সাউন্ড সিস্টেম থেকে নাচের উপযোগী হিন্দি গান বাজছে।

মান্ডবীতে সানসেট ক্রুজ।

জাহাজ ছেড়ে দিল। ঘোষক মঞ্চে উঠে বাচ্চাদের নাচার জন্য ডেকে নিল। কিছুক্ষণ পর বাচ্চাদের চেয়ারে পাঠিয়ে মঞ্চে দু’জন মহিলা ও দু’জন পুরুষশিল্পী মঞ্চে উঠল। শুরু হল গোয়ানিজ ডান্স। গোয়ার আসল সংস্কৃতি। তাঁদের নাচ শেষ হওয়ার পর মঞ্চে ডেকে তোলা হল অনেক দম্পতিকে। সৈকত আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, সব কটাকে নাচিয়ে ছাড়ল!

দম্পতিদের নাচ শেষ হওয়ার পর আবার আগের চার জন শিল্পী পোশাক পালটে মঞ্চে এল। আরও একটি গোয়ানিজ ডান্স পেলাম আমরা। এ দিকে দর্শকদের কাছে চা-সিঙ্গাড়া নিয়ে বিক্রেতারা ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। নাচের পর একটা বিরতি। এই সময় একদম নীচের ফ্লোরে ডিস্কো চালু হয়েছে।

চলুন ডিস্কো থেকে ঘুরে আসি, বলে সুকুমারদাকে টানতে টানতে নীচের দিকে চললাম। নীচে যাওয়ার পথে মাঝের ফ্লোরে একবার উঁকি দিলাম। এই ফ্লোরটা একটা বার। কয়েকটা টেবিল পাতা আছে, সেখানে হাতে গোনা কয়েক জন বসে মদ্যপান করছে।

নীচের ফ্লোরে ডিস্কোতে গানের তালে আলো-আঁধারির ঝলকানিতে সুকুমারদাকে হারিয়ে ফেললাম। দাদা যে ভাবে জড় হয়ে গেছিল …, হারিয়ে ফেলে ভালোই হয়েছে। ফিরে এলাম টপ ফ্লোরে। পরের প্রোগ্রামের প্রস্তুতি চলছে। জাহাজের মুখও ফেরার পথে।

এ বার ওই চার জন শিল্পী পর্তুগিজ পোশাক পরে মঞ্চে উঠল। শুরু হল পর্তুগিজ ডান্স। বেশ ভালো লাগল। নাচ শেষ হওয়ার পর ঘোষক পুরুষদের নাচার জন্য মঞ্চে ডাকল। বেশ কয়েক জন মঞ্চে চলে গেল। ছোটো মঞ্চে বেশি শিল্পী হয়ে যাওয়ায় নাচের থেকে কুদোকুদিই বেশি হল। অনেকেই নাচতে নাচতে মেতে উঠল সেলফি তোলায়। জাহাজ জেটিতে না ভেড়া পর্যন্ত এই ভূতের নৃত্য চলল।

ফেরার পথে রাতের আলোকোজ্জ্বল গোয়াকে দেখলাম। দলের সবার অবশ্য সে সৌভাগ্য হয়নি, কারণ অনেকেই গাড়িতে এক টিপ ঘুম দিতে ব্যস্ত। গাড়ি যখন হোটেলে এল রাত আটটা। গোয়াতে অবশ্য এটা সবে কলির সন্ধে। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *