দ্য গ্রেট গোয়া ৫ / ওল্ড গোয়ার চার্চ দেখে মন্দির দর্শন

স্বপ্ন পাল

ডোনা পাওলা।

সমুদ্রের উপর সেতুর মতো করে চলাচলের চওড়া রাস্তা। রেলিং-এর ধারে অনেকেই সমুদ্রে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। আমরাও ফটোসেশনে মেতে উঠলাম। এটা আদপে একটা ভিউ স্পট। এখান থেকে চারপাশটা ভারী সুন্দর দেখায়। এই ডোনা পাওলাতেই আছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওশিয়ানোগ্রাফি।

এই ডোনা পাওলা নিয়ে একটা বেদনাদায়ক প্রেমের গল্প প্রচলিত। হাঁটতে হাঁটতে আমার সঙ্গীদের সেটাই বলছিলাম – ডোনা পাওলা ছিল পর্তুগিজ গভর্নরের মেয়ে। সে স্থানীয় এক ধীবরপুত্রের প্রেমে পড়ে। কিন্তু ডোনার বাড়ি তা মানে না। শুরু হয় তাঁদের উপর অত্যাচার। এক দিন তারা এখানেই সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।

আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে সব থেকে উঁচু ভিউ স্পটে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ডোনা পাওলার প্রতিকৃতি দেখলাম। সাদা রঙের এই প্রতিকৃতি ১৯৬৯-এ ব্যারোনেস ইয়ার্স ভন লিসনার-এর তৈরি। সমুদ্রের দিকে নিবদ্ধ ডোনার চোখ। এক দুজে কে লিয়ে-র শুটিং-এর পর থেকেই এই জায়গার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

আদতে ডোনা পাওলা হলেন শ্রীলঙ্কার জাফনাপত্তনমের পর্তুগিজ ভাইসরয়ের কন্যা। পুরো নাম পাওলা অ্যামারাল আন্তোনিও দে সউতো মাইওর। ডাকা হত ডোনা পাওলা নামে। ১৬৪৪-এ তাঁরা সপরিবার গোয়ায় চলে আসেন। এর পর ১৬৫৬-তে পাওলার বিয়ে হয় স্পেনের দোম আন্তোনিও সউতো মাইওর-এর সঙ্গে।

ডোনা পাওলা ছিল একজন দয়ালু মহিলা। তিনি ছিলেন স্থানীয় মানুষের নয়নের মণি। ১৬৮২-এর ১৬ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুর পর এখানকার মানুষজন তাঁদের গ্রামের নাম ওড্ডাভেল-এর বদলে রাখেন ডোনা পাওলা। ভিউ পয়েন্ট থেকে ঠিক এক কিমি দূরে জুয়ারি নদী ও মান্ডবী নদীর সঙ্গম। নদী দু’টি আরব সাগরে এক সঙ্গে মিশেছে।

ডোনা পাওলা থেকে চললাম ওল্ড গোয়ায়, সে ক্যাথিড্রাল এবং ব্যাসেলিকা অফ বোম জেসাস দেখতে। মান্ডবীর ধার দিয়ে রাস্তা, অনুভূতিকে একটা নতুন মাত্রা যোগ করে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। রাস্তার দু’দিকে মুখোমুখি দু’টো চার্চ। আসিফের পরামর্শ মেনে ব্যাসেলিকা অফ বোম জেসাস-এর ময়দানে গাছের ছায়ায় বসে লাঞ্চ সেরে নিলাম।

খাওয়া শেষ। এ বার আমাদের দর্শন শুরু। পেয়ে গেলাম এক জন গাইড। তাঁর পিছন পিছন চললাম চার্চ দেখতে। চার্চের ভিতরে দু’টো বেঞ্চে আমাদের বসিয়ে গাইড তার বক্তব্য শুরু করল –

ব্যাসেলিকা অফ বোম জেসাস

ব্যাসেলিকা অফ বোম জেসাস-এর নির্মাণ শুরু ২৪ নভেম্বর আর শেষ ১৫ মে ১৬০৫। এটি তৈরি করান আর্চবিশপ অ্যালেক্সো দে মেনেজেস। নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন ফরাসি স্থপতি জুলিও সিমাও। ১৯৮৬ সালে ইউনেস্কো এই চার্চকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মনুমেন্ট হিসাবে ঘোষণা করে।

গোয়ায় প্রায় ৩৩% মানুষ খ্রিস্টান। এখানে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের মূলে ছিলেন সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার। ফ্রান্সিসের জন্ম তখনকার জেভিয়ার রাজ্যে (অধুনা স্পেন)। রোমান ক্যাথলিক ফ্রান্সিস ১৫৪১-এ গোয়ায় আসেন ধর্মপ্রচারের জন্য। গোয়া তখন পর্তুগিজ ভারতের রাজধানী। পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে যাত্রা করে ১৩ মাস পর ১৫৪২-এর ৬ মে গোয়ায় আসেন ফ্রান্সিস। এখানে মাস ছয়েক থাকার পর অক্টোবরে ফ্রান্সিস যাত্রা করেন কন্যাকুমারিকার উদ্দেশে। দক্ষিণ ভারতের উপকূল অঞ্চলে বছর তিনেক ধরে ধর্মপ্রচারের পর চলে যান পর্তুগিজ মালাক্কায়। বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৫৫২-এর জানুয়ারিতে গোয়ায় ফিরে আসেন। আবার বিদেশযাত্রা। এপ্রিলেই সান্তা ক্রুজ জাহাজে চেপে রওনা হলেন চিনের পথে। সঙ্গী দিয়োগো পেরেরা। কিন্তু ওই বছরেরই ডিসেম্বরে চিনের সাংচুয়ান দ্বীপের তাইশানে সামান্য জ্বরে মারা যেন। তাঁকে ওই দ্বীপেই সমাধিস্থ করা হয়। ১৫৫৩-এর ফেব্রুয়ারিতে তাঁর অবিকৃত দেহ কবর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মালাক্কায়, সেন্ট পল চার্চে সমাধিস্থ করা হয়। পেরেরা গোয়া থেকে এসে ফের ওই দেহ তুলে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান এবং ডিসেম্বরে তা পাঠানো হয় গোয়ায়। সেই থেকে তাঁর দেহ ব্যাসেলিকা অফ বোম জেসাস-এ রাখা আছে। ১৬১৯-এর ২৫ অক্টোবর তাঁকে সেন্ট ঘোষণা করে ভ্যাটিক্যান। কাচের ঢাকাওয়ালা কাঠের বাক্সে শায়িত সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারের দেহ। প্রতি বারো বছর অন্তর তাঁর দেহ কফিন থেকে বার করে জনসাধারণের কাছে প্রদর্শিত করা হয়। আপামর গোয়াবাসীর সে এক উৎসব বলা যায়।

সে ক্যাথিড্রাল।

রাস্তা পার হয়ে এলাম সে ক্যাথিড্রালে। সুন্দর সাজানো গোছানো চার্চ। এখানে কোন গাইড আছে কিনা জানিনা তবে প্রয়োজন অনুভব না করায় আমরা নিইনি। ভীষণ ফাঁকা চার্চ ।

পর্তুগীজ ভাষায় ‘সে’ শব্দের অর্থ দেখা। ১৫১০ সালে আফনসো দে আল্বুকার্কের নেতৃত্বে পর্তুগিজ সেনা এক মুসলিম বাহিনীকে পরাস্ত করে গোয়া দখল করে। সেই ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য এই চার্চ বানানো হয়। পরে ১৫৬২-তে এই চার্চকে আরও বড়ো করে তৈরি করা শুরু করেন রাজা ডোম সেবাস্তিও। সেই কাজ শেষ হয় ১৬১৯ সালে।  চার্চের দু’টি টাওয়ার ছিল। একটি ১৭৭৬ সালে ভেঙে যাওয়ার পর তা আর তৈরি করা হয়নি।

সে ক্যাথিড্রাল দেখা হল। এ বার কোথায়?

গাড়ি চালাতে চালাতে আসিফ জানাল, এখন দেখার জন্য তিনটে স্পট আছে – মঙ্গেশ মন্দির, শান্তাদুর্গা মন্দির আর একটা মিউজিয়াম। হাতে যা সময় আছে তাতে যে কোনো দু’টো স্পটে যাওয়া যাবে। আমরা মঙ্গেশ মন্দির আর শান্তাদুর্গা মন্দির বেছে নিলাম।

সহ্যাদ্রির কোলে পাহাড়ি রাস্তা, চলেছি মঙ্গেশি গ্রামে। পোন্ডা তালুকের প্রিওলে মঙ্গেশি গ্রাম। গ্রামের নামেই মন্দিরের নাম। পানাজি থেকে ২১ কিমি দূরে অবস্থিত এই মন্দিরের ইতিহাস আছে।

মঙ্গেশ মন্দির।

আগে এই মন্দির ছিল আঘানাশিনী নদীর ধারে কুশস্থলি কর্তালিম গ্রামে। আঘানাশিনি নদীর বর্তমান নাম জুয়ারি নদী। পর্তুগিজদের হাত থেকে শিবলিঙ্গকে বাঁচাতে ১৫৬০ সালে বৎস্য গোত্রের পুরোহিতরা সেটি মঙ্গেশি গ্রামে নিয়ে আসেন। তখন সেখানে হিন্দু রাজাদের রাজত্ব ছিল। কিন্তু মজার বিষয় হল ১৭৬৩ সালে এই গ্রামও পর্তুগিজরা দখল করে নিলেও তারা মন্দিরে হাত দেয়নি। আসলে তত দিনে পর্তুগিজদের ২০০ বছরেরও বেশি সময় থাকা হয়ে গিয়েছে ভারতে। তারা ভারতীয় ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেকটাই সহিষ্ণু হয়ে উঠেছে।

মন্দির থেকে ৩০০ মিটার দূরে গাড়ি রেখে আমরা হেঁটে চললাম।  এই মন্দির নিয়ে একটি পৌরাণিক কাহিনিও প্রচলিত আছে। শিব ও পার্বতীর মধ্যে পাশা খেলা হয়। পার্বতীর কাছে হেরে গিয়ে শিব ঘুরতে ঘুরতে গোয়ায় এসে পড়েন। এ দিকে পার্বতী জানতে পারেন শিব কৈলাশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আকুল হয়ে শিবকে খুঁজতে খুঁজতে তিনিও গোয়ায় এসে পৌঁছোন। শিব যোগবলে তা জানতে পারেন। তখন পার্বতীকে ভয় দেখানোর জন্য বাঘের রূপ ধারণ করে তাঁর সামনে আসেন শিব। পার্বতী ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন, “ত্রাহিমাম গিরীশ”। এ বার শিব স্বরূপ ধারণ করে বলে ওঠেন, “মম গিরীশ” অর্থাৎ আমিই গিরীশ।

এই ‘মঙ্গেশ’ শব্দটা এসেছে “মম গিরীশ” থেকেই। ‘মম গিরীশ’ থেকে ‘মঙ্গিরিশা’ এবং সেখান থেকে ‘মঙ্গেশ’।

মন্দিরে সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা উঠে তবে মন্দিরচত্বরে প্রবেশ করতে হয়। সামনেই সুউচ্চ বাতিস্তম্ভ। বাতিস্তম্ভ থেকে মূল মন্দির পর্যন্ত পুরো  রাস্তাটাই কার্পেট পাতা। ভিতরে অলংকরণ দেখে দেবতার বৈভব সহজেই অনুমিত হয়। মূল বিগ্রহটি আসলে একটি শিবলিঙ্গ। শিবলিঙ্গের পিছনে শিবের ছোটো স্বর্ণমূর্তি।

শান্তাদুর্গা মন্দির।

বিগ্রহ দর্শন করে বেরিয়ে এলাম। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। এখনও শান্তাদুর্গা দর্শন বাকি। কিছুক্ষণ পরেই শান্তাদুর্গা মন্দিরে পৌঁছে গেলাম। পানাজি থেকে ৩৩ কিমি দূরে এই মন্দিরটি ১৭১৩ সালে তৈরি শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৭৩৮ সালে। শান্তাদুর্গা আগে ছিলেন কেলোশিতে। ১৫৬৬-তে সেখানকার মন্দির পর্তুগিজদের হাতে ধ্বংস হওয়ার পর বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় এই কাভলেমে।

এই দেবীকে নিয়েও একটি পৌরাণিক কাহিনি আছে। একবার বিষ্ণু ও শিবের মধ্যে কে বড়ো তা নিয়ে বিতণ্ডা বাধে। ক্রমে যুদ্ধ বাঁধার উপক্রম হয়। তখন দুর্গা এসে এর মীমাংসা করেন। শান্তি স্থাপন করার জন্য এই দুর্গার নাম হয় শান্তাদুর্গা।

গোয়ার স্থাপত্যরীতি অনুসারে এই মন্দিরেও একটি সুবিশাল বাতিস্থম্ভ আছে। এখানকার মন্দিরের আর একটা বিশেষত্ব হল, নাটমন্দির ও গর্ভগৃহ একই ছাদের নীচে অবস্থান করে। শান্তাদুর্গা দর্শন করে বেরিয়ে এলাম।

আজকের মত ভ্রমণ শেষ। কালকের প্রোগ্রাম পালোলেম বিচ, কাবোদে রাম ফোর্ট আর স্পাইস গার্ডেন। সকাল সকাল। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *