বৃষ্টিস্নাত মুনথুমের সবুজ-সান্নিধ্যে

শ্রয়ণ সেন

পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে কয়েকটি বাঁশের কটেজ। সব থেকে ওপরের কটেজটি রাস্তা থেকে কিছুটা নেমেই। আর সব থেকে নীচের কটেজে যেতে হলে এই বর্ষায় আপনাকে কিছুটা পরিশ্রম করতে হবে। হাঁটুর জোর অত্যন্ত জরুরি। আর বর্ষাকাল বলে সিঁড়িও কিছুটা পিছল। ফলে সাবধানে পা ফেলতে হবে।

এই ছোটো ছোটো বাঁশের কটেজ, একটি ডাইনিং হল এবং কয়েকটি বাঁশের মণ্ডপ নিয়েই তৈরি মুনথুম ভিলেজ হোমস্টে। ডাইনিং হলে গদির ওপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে টেবিলে খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা।

সবুজকে পুরোপুরি বাঁচিয়ে রেখে অত্যন্ত সৃজনশীল ভাবে গোটা হোমস্টেটা তৈরি করা হয়েছে।

কিছুক্ষণ আগেই যে কষ্টটা হচ্ছিল, মাত্র চারশো মিটার পাহাড়ি পথ ভাঙতে গিয়েও প্রবল গরমের মধ্যে ঘেমেনেয়ে একশা হলাম, সেই কষ্টটা এই হোমস্টে পৌঁছে নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।

হোমস্টেতে পৌঁছোতেই আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন নীতা গুরুং। এখানকার মালকিন। স্বামী বিশালের সঙ্গে এই হোমস্টেটা তৈরি করেছেন। পাহাড়ি মানুষের আতিথেয়তা বরাবরই মনভোলানো। যথারীতি নীতা যে ভাবে অভ্যর্থনা জানালেন, তাতে যাবতীয় কষ্ট দূর হয়ে গেল।

আমি নিয়ে দলে ৭ জন। আমাদের পাঁচ জনের ঠাঁই হল ওপরের একটু বড়ো কটেজে। এই বাঁশের কটেজটা খুব সুন্দর করে তৈরি করা। এখানে দু’টো বেডরুম রয়েছে। রয়েছে একটা বসার জায়গা, একটি চেঞ্জিং রুম এবং একটি বাথরুম। বাকি দু’ জন চলে গেলেন নীচের কটেজে। সেটাও অসাধারণ সুন্দর করে সাজানো। তবে দলের সবাই প্রবীণ হওয়ার ফলে একদম নীচের কটেজটায় যাওয়া বেশ পরিশ্রমের।

নীতা-বিশালের ডেরায় পা রাখতেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। আজ সারাটা দিন কোনো বৃষ্টি পাইনি দেখে বেশ অবাকই হচ্ছিলাম। জুলাইয়ের পাহাড়ে একটা গোটা দিন বৃষ্টিহীন কী ভাবে যেতে পারে। কিন্তু সে নামল অবশেষে।

বৃষ্টির পরিবেশটা এত মায়াবী হয়ে উঠল এই মুনথুমে যা বলে বোঝানো যাবে না। চারিদিকটা নিমেষের মধ্যে আরও সবুজ হয়ে উঠল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনটাকে ভীষণ রকম চাঙ্গা করে দিল।

আমাদের মুনথুমে পৌঁছোতেই দুপুর গড়িয়ে গেছিল। তাই মধ্যাহ্নভোজ সারতে সারতে প্রায় বিকেল। তবে প্রকৃতি আমাদের পেট ভরিয়ে রেখেছে, সে ভাবে খিদেও পায়নি।

খুব ইচ্ছে ছিল ডাইনিং হলে গিয়ে খেতে। কিন্তু বৃষ্টি আর দলে প্রবীণদের থাকার কারণে অতটা নীচে যাওয়ার সাহস হল না। ঘরেই খাবার চলে এল। 

গরম ভাত, গরম ডাল, রাই শাক, ডিমের ঝোলের সঙ্গে শেষ পাতে যে আচারটা দেওয়া হয়েছিল, সেটা এক কথায় অসাধারণ। আচারের মূল সামগ্রী কাঁচা আম। পাহাড়ে আম! এটা কি সমতলের কোথাও থেকে নিয়ে আসা হয়েছে?

নীতাই সেই কৌতূহল দূর করে দিলেন। এই কাঁচা আম তাঁদের চাষের। মুনথুমের উচ্চতা অনেকটা কম হওয়ার ফলে এখানে আমের ফলন ভালোই হয়। তাই নিজেরাই এই আম গাছ লাগিয়েছেন হোমস্টের চত্বরে। 

তবে শুধু আম নয়, এখানে পাহাড়ের ধাপে ধাপে জৈব চাষ করা হয়। মুলো, ধান, সরষে, এলাচ, রাই শাক-সহ অনেক কিছুই। নীতা জানান, তাঁরা চেষ্টা করেন পর্যটকদের নিজস্ব চাষের খাঁটি জিনিস খাওয়াতে।

শিলিগুড়ির যুবক বিশাল গুরুং বিয়ে করেন কালিম্পংয়ের নীতাকে। তাঁদের পুরো প্রেমপর্বটাই হয়েছে কলকাতায়। এখানে একটি সংস্থায় কাজ করতেন দু’ জনে। সেখান থেকে ভালোবাসা, তার পর বিবাহ। শুধু প্রেমপর্বই নয়, আরও একটা কারণে কলকাতা তাঁদের কাছে খুব স্পেশাল।

— “আমার মেয়ে হয়েছে কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে।”

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার মুখে বিশাল আর নীতার সঙ্গে এ ভাবেই জমে উঠল আমাদের আড্ডা। তাঁদের দু’ জনের পারিবারিক গল্প শোনাচ্ছিলেন বিশাল। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন এল, কলকাতার চাকরি ছেড়ে পাহাড়ে চলে এলেন কেন তিনি?

কলকাতা থেকে পাহাড়ে নয়। মাঝে আরও একটি অধ্যায় আছে বিশালের জীবনে। বিশালের ট্রান্সফার হয়ে যায় দুবাইয়ে। স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দেন সেখানে। দুবাইতে এক নতুন জীবন। মোটা মাইনের চাকরি ছিল, জীবনটাও নিশ্চিত ছিল, কিন্তু মনে শান্তি ছিল না তাঁর।

— “আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম কোনটা আমার জন্য ভালো, মোটা মাইনের রোজগারের সঙ্গে প্রবল চাপের জীবন? না কি কম রোজগারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ জীবন এবং ভালো ঘুম?”

শেষে দ্বিতীয় অপশনটাকেই বেছে নেন বিশাল। আমরা যেখানে রয়েছি, এটা নীতার পৈতৃক অর্থাৎ বিশালের শ্বশুরবাড়ির জমি। হোমস্টের শেষ কটেজটা তো রয়েছে কয়েকটা ধাপ নীচে। কিন্তু এই জমিটা আদতে বিশাল এলাকা জুড়ে।

— “৯ একর জমি আছে আমাদের। নীচে একটা নদীর শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। ওটা পালা নদী। ওই নদীর ধার পর্যন্ত নেমে গিয়েছে এই জমি।” বললেন নীতা।

পাহাড়ে হোমস্টে তৈরি করতে হলে একটা অলিখিত নিয়ম আছে। যিনি হোমস্টে তৈরি করছেন, তাঁকে এখানকার ভূমিসন্তান হতে হবে কিংবা বিবাহ সূত্রে ভূমিসন্তান হতে হবে। শিলিগুড়ির বিশাল এখন বিবাহসূত্রে এখানকার ভূমিসন্তান।

বিশাল বললেন, “এটা ঠিক যে দুবাইয়ের মতো রোজগার আমার এখানে হচ্ছে না। কিন্তু এখানে অনেক শান্তিতে রয়েছি আমি। এখানে আমিই আমার বস।”  

এখানে এক বছর হল রয়েছেন বিশাল আর নীতা। গত বছর সেপ্টেম্বরে এটা ভ্রামণিকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

এখানে থাকতে থাকতে শারীরিক ভাবেও ভীষণ লাভবান হয়েছেন বিশাল। তাঁর কথায়, “২০১৯ পর্যন্ত আমার দু’তিন মাস অন্তর সাইনাসের সমস্যা দেখা দিত। কিন্তু গত এক বছরে এক বারের জন্যও এই সমস্যায় পড়িনি আমি।”

সত্যিই তো, চারিদিকে এত সবুজ, এমন দূষণমুক্ত পরিবেশ যে শারীরিক সমস্যা কোনো ভাবেই দেখা দেবে না। গত কয়েক দিনের উত্তরবঙ্গ সফরে এই কথাটাই বার বার মনে হচ্ছে আমাদেরও। শহুরে জীবন থেকে বেরিয়ে ভীষণ চাঙ্গা লাগছে।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামল। হোমস্টের আলো জ্বলে উঠল। এখানে রাতের এই দৃশ্যটাও অসাধারণ। খুব সুন্দর ভাবে আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে গোটা চত্বরটাকে। নানা রকম রঙের খেলা। যেখানে সুইমিং পুল রয়েছে, সেখানে বার বার রঙ বদলে যাওয়া আলো। অন্য দিকে, একটি মণ্ডপের আলোকসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে কলকাতার কালীপুজোর কোনো মণ্ডপ।

আশেপাশের পরিবেশটা কী মায়াবী! চারিদিকে অপার নির্জনতা। সেই নির্জনতা ভেদ করে ভেসে আসছে পালা নদীর গর্জন। সামনের পাহাড়ে কালিম্পং শহর। জোনাকির মতো জ্বল জ্বল করছে শহরটা।

এর পর যখন চাঁদ উঠল, আরও মনোরম হয়ে উঠল চারপাশ। এই পরিবেশে যে কেউ মোহিত হয়ে যেতে পারেন। যেমন মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য।

হ্যাঁ, কিছু দিন আগে এই মুনথুম ভিলেজ হোমস্টেতেই বিশালদের আতিথেয়তা উপভোগ করে গিয়েছেন সস্ত্রীক অনির্বাণ। সেই গল্পটাও আমাদের বললেন বিশাল-নীতা। স্বনামধন্য অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মাটির মানুষ হওয়ার পরিচয়টাও আমাদের দিলেন দু’ জনে।

মাত্র একটা দিনের জন্য বুকিং করেছিলাম মুনথুমে। ভীষণ আপশোশ হচ্ছে সেটার জন্য। নির্জনতাকে ভালোবাসলে এখানে অনায়াসে দু’-তিন দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। গাছগাছালির সান্নিধ্যে থাকা যায়। পাখিদের সঙ্গে গল্প করা যায়। সেই সঙ্গে গ্রামের রাস্তা ধরে ট্রেকিংও করা যায়।

আর একটা কথা, যে কোনো মরশুমেই মুনথুম আসা যায়, কিন্তু একটু কষ্ট করে যদি বর্ষায় আসতে পারেন, তার থেকে দারুণ ব্যাপার কিছু হতে পারে না। বর্ষার মুনথুমের রূপে আপনি মুগ্ধ হবেনই।

পাচেংয়ের বিমল ছেত্রীর মতো, মুনথুমের বিশালের সঙ্গেও নতুন এক সম্পর্ক তৈরি হল। এই সম্পর্কটাও থেকে যাবে। আবার আসব মুনথুমে, একটু বেশি সময় নিয়ে। (চলবে)

***  

নীতা আর বিশাল গুরুংয়ের মুনথুম ভিলেজ হোমস্টেতে রাত্রিবাসের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিতে পারে ট্র্যাভেলিজম (Travelism)। যোগাযোগ করুন: 8276008189 অথবা 9903763296 নম্বরে।

আগের পর্বগুলি পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন

***

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *