বিপর্যয় মাথায় নিয়ে পৌঁছোলাম লুংচুর ঠিকানায়

পাপিয়া মিত্র

একে একে সকলেই মেজাজ হারাচ্ছে। অনেক আগেই লামাকে বলে দেওয়া হয়েছিল ছোটো গাড়ি নীচে নামিয়ে রাখতে। লামা তা করেনি। মুনথুম হোমস্টের মুখের চারশো মিটার পাথর বিছানো চড়াইপথে ছোটো গাড়ি যাবে না বলে আগের দিন সকালে তা মুল সড়ক থেকে একটু উঁচুতে রাখা ছিল। সারা রাত তুমুল বৃষ্টিতে ব‍্যাটারি ডাউন। গাড়ির চাকা অর্ধেক গেরুয়া জলমাটিতে বসে।

বৃষ্টি মাথায় আমরা চার জন লাগেজ তুলে বড়ো গাড়িতে নেমে এসেছি। বাকি তিন পুরুষ পায়দল। গাড়ির চাকা পাক খেতেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় আরও তেড়ে বৃষ্টি নামল। গাড়ির চাল ফুট হওয়ার জোগাড়। পাশ দিয়ে পথের পাথর ডুবিয়ে মোটা জলের স্রোত নেমে যাচ্ছে গড়ানের দিকে। নীচে নেমে দেখি লামার গাড়ি ওঠানোর কাজ চলছে। স্থানীয় ছেলেরা শাবল নিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। ভয়ংকর বৃষ্টির মধ্যে তিন পুরুষ এসে পৌঁছোল। একটি মাত্র দোকান তারই টিনের নীচে একটু দাঁড়ানো গেল। বাকিরা গাড়িতে।

মেঘভাঙা বৃষ্টি নিয়ে রাতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম মুনথুমে। সারা রাত তুমুল বৃষ্টি আর মেঘের ডাক। শহরে থাকলেই ভয় পাই আর এখন তো পাহাড়ে। টিনের চালে টানা ধারাপাতে মনে হচ্ছে এখনই বুঝি হুড়মুড়িয়ে সব পড়বে। পর্দা সরিয়ে দৃষ্টি বেশি দূর গেল না। সাজানো বাগান ধোঁয়া হয়ে গেছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। রাত কেটে কখন ভোর হবে এই দুশ্চিন্তায় চায়ের কাপের টুংটাং শব্দ। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন। কোথাও জল জমেনি। পাহাড়ে ঢালু জমিতে জল নেই। গড়িয়ে পড়া জলে পালাখোলা ভরা যুবতী।

গাছেরা সবুজ থেকে ঘন সবুজ। আর অপেক্ষা নয়। বেগ বেড়েছে বৃষ্টির। ঘন্টাদেড়েক টানা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কাঁপুনি ধরেছে। কোথাও চায়ের দোকানও নেই। লামার গাড়িকে ঠেলে তোলা হলেও স্টার্ট আর নিল না। বিপদ বুঝে বাপী বলল, পেছনে সমস্ত লাগেজ দিয়ে একজন বসুক। বাকিরা তেঁতুলপাতায় ন’ জন হয়ে চললাম লুংচুর দিকে।

লুংচু নেচার স্টে।

আগের দিনের পথ ধরে পালাখোলা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম রেলিখোলা। তার পর আলগাড়া, লাভা হয়ে ঢুকে গেলাম নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে। তার পর কোলাখাম পেরিয়ে, ছাঙ্গে ফলসকে বাঁ দিকে বেশ কিছুটা নীচে রেখে পথ এগিয়ে চলল। সব পথেই পাহাড়ের মাথায়, গাছের মাথায় ঘন মেঘের জটা দেখে মনে হচ্ছিল কে যেন পেনসিল দিয়ে এঁকে পরে রাবার দিয়ে ঘষে মুছে দিয়েছে। পথ যত ঘুরছে ততই যেন জমাট কালো মেঘ নেমে আসছে।

বৃষ্টির ধারা একটু কমলেও ভয় পিছু ছাড়ছে না। বাঁ দিকে গভীর ধোঁয়াময় খাদ আর ডান দিকে ঘন ওক, বার্চ, দেবদারু, রডোড্রেনডন, পাইনের জঙ্গল। গাড়ির চাকার গতি এক এক সময়ে খুবই ধীর। কিন্তু পাহাড়ে একটা নিয়ম মেনে চলতে হয়। দুর্গা নাম নিয়ে চড়াই-উতরাইয়ের পাহাড়ি ঠিকানায় লুংচুর দেখা মিলল। কালিম্পং পাহাড়ের আরও এক অপরূপা লুংচু, ৫৮০০ ফুট। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এক গ্রাম।

লুংচু নেচার স্টে, সবুজঘেরা পাহাড়ি আশ্রয়। প্রকৃতির কোলে বুক ভরে প্রাণবায়ু নেওয়ার ঠিকানা। লাভা থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার আর ছাঙ্গে ফলস্ থেকে ২ কিলোমিটার দূরত্বে, পাহাড় এখানে আকাশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। শহুরে কোলাহল থেকে পাহাড়কোলে লেপচাদের বসতি এই গ্রাম মূলত প্রকৃতিপ্রেমীদের আদরের আস্তানা।

গাড়ি থামতেই আতংকের হাঁফ ছাড়া। ছুটে ছুটে নেমে আসছে আদর্শ আর অনুপ। মাধ‍্যমিক ও ষষ্ঠ শ্রেণির দুই পড়ুয়া। আমাদের লাগেজের ভার তিন খেপে নিয়ে উঠে গেল আশ্রয়ের দরজায়। বেলা গড়িয়েছে মেঘের কোলে। ৩.৪৫-এ আমরা দুপুরের আহারে বসলাম। ছোটো দুই পড়ুয়া কাকার সঙ্গেই কাজে হাত লাগিয়েছে। করোনা-আবহে স্কুল বন্ধ। বই-খাতা সব এই হোমস্টেতে রাখা আছে। দুপুরে সকলের খাওয়ার শেষে ওদের পড়াশোনা। এখান থেকে ওদের হাতখরচা।

নেচার স্টে-র বারান্দা থেকে।

খেয়ে হোমস্টের বারান্দায় গা এলিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা। এখানে মনে হল প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে আড়ি করেছে। ধোঁয়া যেন সরছে না। ফুলের বাগান তার উজ্জ্বলতা হারিয়েছে। পাখপাখালিরও সাড়া নেই। মৌমাছি প্রজাপতির ডানায় আলস‍্য। আর তাপস তো মৌনী। অগত‍্যা চোখ বুজে এল।

হঠাৎ মনে হল কারা যেন চলাফেরা করছে। চোখ মেলতেই নীচের আমাদের তিনটি ঘরের সকলে বাগানে। ওপরের ঘরের অতিথিরা সব বারান্দায় বেরিয়ে পড়েছে। ঘন মেঘ সরিয়ে সূর্যের তির্যক আলোর রেখা এসে পড়েছে ফুলেপাতায় ডালের কোলে কোলে। পাখিরা যেন সমস্ত অলসতা ঝেড়ে ডেকে উঠল। শেষ বিকেলের মেঘের বুকে সিঁদুরের মাখামাখি দেখে মনে পড়ে গেল মা দুগ্গার বোধনের আর বেশি দেরি নেই। রথযাত্রার সময়েই কত জায়গায় খুঁটিপুজো হয়ে গেছে। হোমস্টের বারান্দায় বসে কয়েকটি পাখির সঙ্গে দেখা হল, আলাপ হল না। পাহাড় আকাশ সূর্য মেঘ ঝোরা সব মিলিয়ে লুংচু বড়ো মায়ার ঠিকানা।

পরের দিনের গন্তব্য নিয়ে কিছু আলোচনা চলল সন্ধের চায়ের টেবিলে। এক রাতের বসবাস নেচার স্টেতে। বারান্দায় বসে সান্ধ‍্য চা খেয়ে আড্ডা। আকাশে তারার দেখা মিলল। দূরে সিকিমের পাহাড়। মায়াবী আলো জ্বলে উঠছে পাহাড়ের কোলে গ্রাম‍্য সংসারে। এই দৃশ্য চোখ বরাবর সোজা। একটু ডান দিক ঘেঁষে আরও এক রূপবান পর্বত দৃশ্যমান হয়, কাঞ্চনজঙ্ঘা। সকালের অপেক্ষায় রেখে দিলাম প্রকৃতির উপহারকে।

লুংচুতে থাকা

লুংচু নেচার স্টে, যোগাযোগ: ট্রাভেলিজম, ফোন: 8276008189, 9903763296

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

শ্রাবণ-স্নাত চা বাগিচার সান্নিধ্যে

দ্বাদশীর জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় বিজনবাড়ি, সঙ্গী রঙ্গিত

মেঘভাঙা বৃষ্টি সঙ্গী মুনথুমে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *