রূপসী বাংলার পথে ২/ সাগর থেকে জঙ্গলমহলে

শ্রয়ণ সেন

লজের কর্মী ঘর খুলে দিতেই মনটা অসম্ভব ভালো হয়ে গেল। সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে। বিশাল বড়ো ঘরটা এক্কেবারে ঝকঝকে তকতকে। বাথরুমটা দেখে মনে হচ্ছে যেন ঘরের থেকেও বেশি পরিষ্কার। ফিনাইলের গন্ধে ম ম করছে। যে রকমটা আমরা চেয়েছি, ঠিক সেটাই পেয়ে গিয়েছি।

শুধু ঘর বা বাথরুমের পরিচ্ছন্নতাই নয়, লজকর্মীরাও যে স্বাস্থ্যবিধি দুর্দান্ত ভাবে মেনে চলছেন, সেটা দেখেও খুব ভালো লাগল। এখানে পৌঁছোনো ইস্তক কাউকে এক মুহূর্তের জন্যও মাস্কবিহীন দেখলাম না।

অথচ তাজপুরের অভিজ্ঞতা ঠিক উলটো ছিল। ভিড়ভাট্টা ছিল না, তাই অসুবিধা হয়নি। কিন্তু সব সময়ে মাস্কবিহীন ব্যক্তিদের থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হয়েছে। এখন অবশ্য পরিস্থিতি অন্য রকম।

কোভিডের কল্যাণে এ বার একটু অন্য রকম ভ্রমণের পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার দ্বিতীয় ভাগে ছিল আজকের এই জার্নিটা।

কলকাতা থেকে দিঘা তো সড়কপথে কত বারই গিয়েছি। কিন্তু আজকের সড়ক-সফরটা সত্যিই অন্য রকম। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে উপকূল থেকে চলে এলাম পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ে। ভূপ্রকৃতি পুরোপুরি বদলে গেল।

এখন আমরা রয়েছি ঝিলিমিলিতে। প্রশাসনিক দিক থেকে এই ঝিলিমিলি বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত। কিন্তু এক দিকে ঝাড়গ্রাম এবং অন্য দিকে পুরুলিয়া জেলা ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।

রিমিল ইকো ট্যুরিজম লজ।

ঝিলিমিলির রিমিল ইকো ট্যুরিজম লজটা একটা ছোটো টিলার ওপরে। শাল-পিয়ালের জঙ্গলে ঘেরা বিশাল ঢালু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কটেজ, টেন্ট হাউজ, গাছবাড়ি। তবে আমরা যেখানে রয়েছি, সেটা এক কালে পঞ্চায়েতের গেস্টহাউস ছিল, এখন লজের অন্তর্গত।

এখানে এসেই বুঝলাম যে দু’টো দিন ল্যাদ খেয়ে কাটানোর আদর্শ জায়গা এটা। দুপুরে খাবার খেয়ে পেটকে শান্ত করা গিয়েছে। তাই ফিরে গেলাম আজকের সড়কযাত্রাটার স্মৃতি রোমন্থনে।

আজকের সফরটা মোটামুটি চারটে ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ, তাজপুর থেকে এগরা হয়ে বেলদা। দ্বিতীয় ভাগ বেলদা থেকে খড়গপুর হয়ে লোধাশুলি। তৃতীয় ভাগ লোধাশুলি থেকে ঝাড়গ্রাম হয়ে শিলদা আর চতুর্থ ভাগ শিলদা থেকে বেলপাহাড়ি হয়ে ঝিলিমিলি। 

২২৫ কিলোমিটারের এই জার্নিতে দেখলাম কী ভাবে বদলে গেল ভূপ্রকৃতি। এক একটা ভাগে এক এক রকম বৈশিষ্ট্য হাজির হল আমাদের সামনে।

পশ্চিমাঞ্চলের ছোঁয়া থাকলেও বেলদা পর্যন্ত উপকূলীয় ব্যাপারটা ভালো ভাবেই টের পাওয়া যায়। রাজ্য সড়কের দু’ ধারে ইউকালিপটাস গাছের সারি। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানখেতের মধ্যে দিয়ে পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে আমাদের স্কর্পিও।

বেলদা আসতেই পথ বদল। ঘুরলাম খড়গপুরের দিকে। আট লেনের দুর্দান্ত জাতীয় সড়ক, সোনালি চতুর্ভুজের অংশ। আমার পেছনে চেন্নাই, সামনে খড়গপুর।

চা-বিরতি হল কিছুক্ষণের। কোভিডের আবহে রাস্তার ধারের ধাবা এড়িয়ে চলছি। তাজপুরের হোটেলেই চা বানিয়ে ফ্লাস্কে ঢালা হয়েছিল। সেটার সদ্ব্যবহার হল খড়গপুরের ঠিক উপকণ্ঠে।

একটা চৌমাথা এল। ডান দিকে কলকাতা। আমরা বামপন্থী। এই সেই জাতীয় সড়ক যা আমাদের কাছে বোম্বে রোড হিসেবে পরিচিত। আগে এর নম্বর ৬ হলেও বর্তমানে সেটা বদলে হয়েছে। কলকাতা থেকে খড়গপুরের অংশটা জাতীয় সড়ক ১৬, খড়গপুর থেকে ওড়িশার দেওগড় পর্যন্ত ৫৩। সে যা-ই হোক না কেন আমাদের কাছে এটা জাতীয় সড়ক ৬ থাকবে সব সময়ে।

সোনালি চতুর্ভুজের অংশ হলেও যেটা দেখলাম তা হল, কলকাতা থেকে খড়গপুর পর্যন্ত রাস্তাটা মসৃণ হলেও, খড়গপুরের পর এখনও বিভিন্ন জায়গায় কাজ হচ্ছে।

ধীরে ধীরে ভূপ্রকৃতি বদল হতে শুরু করল। চারিদিকে এখন লাল মাটির রাজত্ব। মালভূমি অঞ্চলে পড়ে গিয়েছি, তাই রাস্তাও কখনও উঁচু, কখনও নিচু।

ঘণ্টাখানেক ছুটে চলার পর এসে পৌঁছোলাম লোধাশুলি। আবার পথ বদল। এ বার ঘুরতে হবে ডান দিকে, অর্থাৎ ঝাড়গ্রামের দিকে।

ঝাড়গ্রাম বার তিনেক এসেছি, কিন্তু সব সময়ে ট্রেনে। অবশ্য সেটা বছর দশেক আগে। তখন শুনতাম গাড়িতে ঝাড়গ্রাম আসার সব থেকে বড়ো সমস্যা হল এই লোধাশুলি-ঝাড়গ্রাম রাস্তাটাই। আইনশৃঙ্খলার অবস্থা বিশেষ সুবিধার ছিল না। আর তখন ঝাড়গ্রাম এবং তার আশেপাশের এই অঞ্চল মানেই মাওবাদীদের দাপট। নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিয়ে বড়ো রকমের প্রশ্নচিহ্ন ছিল।

রিমিল লজে আমরা সবাই।

এখন অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। রাস্তাটা দু’ লেনের হলেও মসৃণ, পিচ ঢালা। দু’ দিকে শাল-পিয়াল-শিমূলের জঙ্গল। এই গাছের ছায়া রাস্তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে এখন জঙ্গল অনেকটাই কেটে সাফ করা হয়েছে, তবুও যা আছে তাতে ঝাড়গ্রামের সৌন্দর্য অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।

ঝাড়গ্রাম একটা অদ্ভুত শহর। শহরে ঢোকার এক কিলোমিটার আগেও শাল-পিয়ালের ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মাঝেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বনোন্নয়ন নিগমের ঝাড়গ্রাম প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র।

জঙ্গল শেষ, ঝাড়গ্রাম শহর শুরু। গাড়ি থেকে ঝাড়গ্রাম শহরটাকে যতটুকু দেখলাম, একটা ব্যাপারে অত্যন্ত ভালো লাগল। গোটা শহর মাস্ক পরে রয়েছে। শহরের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি। ঘাড় ঘুরিয়ে দু’ দিকে তাকিয়ে যাকেই দেখেছি, মুখে মাস্ক। কলকাতা থেকে বেরোনোর পর কোথাওই মাস্কের এমন চল দেখিনি, যেটা ঝাড়গ্রামে এসে দেখছি। খুব ভালো লাগল।

ঝাড়গ্রাম ছেড়ে এ বার এগিয়ে চললাম শিলদার দিকে। পথে পড়ল দহিজুড়ি, বিনপুর। কুখ্যাত সব জায়গা ছিল বছর দশেক আগেও। সংবাদের শিরোনামে প্রায় রোজই এই সব জায়গার নামোল্লেখ থাকত। কেন, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।  

এখন অবশ্য সে সমস্যা নেই। গাড়ি ছুটে চলেছে। দু’ ধারে ধানখেত। ও হ্যাঁ, জঙ্গল কিন্তু এই রাস্তায় উধাও, সেটা ফিরল শিলদা থেকে বেলপাহাড়ির দিকে ঘোরার পর।

এই সড়কযাত্রার শেষ অংশ এটা। নিঃসন্দেহে সব থেকে রোমাঞ্চকর অংশ। জঙ্গল তো এলই, সেই সঙ্গে দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়শ্রেণি। অবশ্য জমিটাও পাহাড়ি পাহাড়ি। কখনও সে নিজের থেকে উঠে যাচ্ছে, আবার নেমে যাচ্ছে।

রাস্তার ধারে কী একটা দেখা যাচ্ছে যেন! জোরে ব্রেক কষল আমাদের সারথি।

ওমা! এ তো ময়ূর! বেলপাহাড়ি ঢোকার আগেই ময়ূরদর্শনে বেশ তৃপ্তি পেলাম। পেখম তোলেনি, কিন্তু সে আমাদের ছবি তোলার আবদার মিটিয়েছে।

পথে দর্শন।

চলে এলাম বেলপাহাড়ি। ঝাড়গ্রাম জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনপদ এই বেলপাহাড়ি। বাংলার পর্যটন মানচিত্রেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।

পাঁচ নম্বর রাজ্য সড়ক দিয়ে ঝিলিমিলির দিকে এগোতে গিয়েই চোখে পড়ল একের পর এক পর্যটনস্থলের দিকনির্দেশ। কোনোটায় ডান দিকে দেখানো রয়েছে ঘাগরা জলপ্রপাত, একটায় বাঁ দিকে দেখানো রয়েছে খান্ডারিনি লেক। চাতন ডোংরি ভিউপয়েন্ট, পবন পাহাড় ভিউ পয়েন্ট, গজপাথর সরোবর, কাঁকরাঝোড়-সহ আরও কত কী যাওয়া যায় বেলপাহাড়ি থেকে। নতুন পর্যটনস্থল ঢাঙিকুসুমও খুব একটা দূরে নয়।

বেলপাহাড়িতেও এখন রাত্রিবাসের ব্যবস্থা রয়েছে। তাই একবার এখান থেকেই এই সমস্ত পর্যটনস্থল দেখতে হবে।

এগিয়ে চললাম রাজ্য সড়ক ধরে। জেলা বদল হয়ে গেল। ঝাড়গ্রাম ছেড়ে ঢুকে পড়লাম বাঁকুড়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঁ দিকের একটি দিক নির্দেশ জানিয়ে দিল ঝিলিমিলি সেই দিকেই। 

ছ’ ঘণ্টার জার্নিতে বেদম খিদে পেয়ে গিয়েছে। এখন প্রাথমিক লক্ষ্য পেটবাবাজিকে ভরিয়ে তাকে শান্ত করা। (চলবে)

আরও পড়ুন: রূপসী বাংলার পথে ১/ ‘অচেনা’ তাজপুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *