শীতের হিমাচলে ৯/ যাত্রা শেষে অমৃতসরে

শ্রয়ণ সেন

গুলির দাগকে পেছনে রেখে সেলফি! সেই কুখ্যাত কুয়োকে পেছনে রেখে সেলফি! সেই অভিশপ্ত গলিকে পেছনে রেখে সেলফি! জালিয়ানওয়ালা বাগে ঢোকা ইস্তক ক্রমশ অবাক হচ্ছি। মানুষ কোথায় এসেছে সেটা কি কোনো ভাবেই অনুভব করতে পারছে না? সেই দিনের ঘটনার সঙ্গে নিজেদের মনকে একাত্ম করতে পারছে না? মোবাইলের যুগে নতুন জায়গা দেখার থেকেও কি সেলফি তোলাই সব থেকে বড়ো ব্যাপারে এখন? এই সব দেখছি, আর নিজের মনকে প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছি, ‘প্রকৃত দেশপ্রেমী’ কি এরাই!

যাই হোক, আমি তো জালিয়ানওয়ালাবাগে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে গিয়েছিলাম ১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিলের সেই দিনটায়, যে দিন কর্নেল ডায়ারের নির্দেশে নিরপরাধ মানুষের ওপরে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি।’ তার পর কী হয়েছিল, সব ঘটনাই ইতিহাস বইয়ের পাতায় আমাদের পড়া।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৮/ যে শহরের প্রেমে পড়েছিলেন নুরজাহান

হিমাচল ভ্রমণের শেষ লগ্নে এসে পৌঁছেছি অমৃতসরে। তবে কী রোমাঞ্চকর পরিস্থিতিতে অমৃতসর এসেছি সেটা একটু বলা যেতেই পারে।

গতকাল মদনলালজি জানিয়ে দিয়েছিলেন, পঞ্জাবে ঢুকলে প্রচণ্ড কুয়াশার মুখে পড়তে হবে। তাই সব রকম প্রস্তুতি নিয়েই সকালে নুরপুরকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম। তখনও জানতাম না, কিছুক্ষণ পরে কী রকম রাস্তা পেতে চলেছি আমরা।

নুরপুরেই পাহাড়ি রাস্তা শেষ, শুরু সমতলভূমি। কিছুক্ষণ পরেই চাক্কি নদীর ব্রিজ পেরিয়ে ঢুকে গেলাম পঞ্জাব। ব্যস, গাঢ় কুয়াশা ঢেকে দিল আমাদের।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৭/ ডালহৌসির প্রবল ঠান্ডায়

এত দিন পর্যন্ত উত্তর ভারতের কুখ্যাত কুয়াশার কথা শুধু শুনেছি, কিন্তু আজ তো নিজের চোখে তা প্রত্যক্ষ করলাম। কুয়াশায় ঢাকা চার দিক, সেই কুয়াশা ভেদ করে চলেছে আমাদের গাড়ি। খুব ইচ্ছে ছিল শস্যশ্যামলা পঞ্জাবকে নিজের চোখে দেখার, কিন্তু সেটা হল না। সামনে কয়েক মিটার ছাড়া আর কিছুই যে দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতেও অসাধারণ দক্ষতায় গাড়ি চালালেন মদনলালজি। বেলা সাড়ে এগারোটায় যখন অমৃতসর ঢুকছি, তখনও চারি দিক কুয়াশার চাদরে মোড়া। গাঢ় কুয়াশার মধ্যেই ১৪৫ কিমি রাস্তা মাত্রা সাড়ে তিন ঘণ্টায় চলে এলাম।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৬/ খাজিয়ারের তুষারচমক

হোটেলে ঢোকার পর থেকেই কিছুটা উঠতে শুরু করল কুয়াশার চাদর। আমরাও বেরিয়ে পড়লাম, শহরের প্রধান দু’টি দ্রষ্টব্য স্থান দেখতে। জালিয়ানওয়ালাবাগ এবং স্বর্ণমন্দিরের জন্য বিখ্যাত অমৃতসর। দু’টোই কাছাকাছি জায়গায়।

amritsar jalianwalabagh
সেই সরু গলি।

প্রথমে ঢুকলাম জালিয়ানওয়ালাবাগে। প্রবেশ করার পর থেকেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল নিজের মধ্যে। ফিরে যাচ্ছিলাম সেই অভিশপ্ত দিনে, যে দিন রাওলাত আইনের বিরুদ্ধে জমায়েত মানুষদের ওপরে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছিল।

ঢোকার মুখেই সেই সরু গলি, যেখান দিয়ে শয়ে শয়ে লোক পালাতে গিয়েও পারেননি, কারণ গেট যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই গলি পেরিয়ে ঢুকলাম বাগানে। দু’শো বর্গফুটের বাগানের চার দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে প্রায় ফুট দশেকের উঁচু পাঁচিল। সেই দিন, অনেকে পাঁচিল টপকে পালাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৫/ মণিমহেশের প্রবেশদ্বারে

যেখান থেকে গুলি চালানো হয়েছিল, সেই জায়গাটায় একটি স্মারক রয়েছে। কাছেই জ্বলে অমর জ্যোতি, সেই দিনের মৃত ব্যক্তিদের স্মৃতির উদ্দেশে।

amritsar jalianwalabagh
জ্বলছে অমর জ্যোতি।

ডায়ারের সেই নৃশংসতার স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে জালিয়ানওয়ালাবাগের দেওয়ালগুলো। এমনই এক দেওয়ালের কাছে এসে দাঁড়ালাম, যেখানে গুলির চিহ্ন রয়েছে। একটা বা দু’টো নয়, ৩৬টা গুলির চিহ্ন রয়েছে সেখানে। সব চিহ্নের চারি দিকে সাদা দাগ করা আছে। অল্প জায়গায় ৩৬টা গুলির চিহ্ন, এটা দেখলেই বোঝা যায় সে দিনের নৃশংসতা ঠিক কী রকম ছিল।

amritsar jalianwalabagh
গুলির চিহ্ন।

পুরো জালিয়ানওয়ালাবাগকে গোল করে ঘুরে এসে দাঁড়ালাম সেই কুয়োর সামনে। দিকে দিকে নজরে পড়ছে সেলফিশিকারিদের ‘অত্যাচার।’ দাঁড়ালাম কুয়োটার সামনে। ডায়ারের নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচার জন্য সাতপাঁচ না ভেবেই এই কুয়োতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন অনেকেই। ছোটো কুয়োতে ঝাঁপ দিলে কী বেঁচে যাওয়া যায়! দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় অসংখ্য মানুষের। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই কুয়ো থেকেই ১২০টা দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।

amritsar jalianwalabagh
অভিশপ্ত সেই কুয়ো।

এ বার এলাম জালিয়ানওয়ালাবাগ মিউজিয়ামে। যেখানে পরিচয় দেওয়া হয়েছে সেই সব বীরপুরুষের, যাঁরা কোনো না কোনো ভাবে এই হত্যালীলার প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। এই সংগ্রহশালায় রয়েছেন রবীন্দ্রনাথও।

ইতিহাসে পাতায় দেখা সেই দিনের ঘটনাকে যেন নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করলাম কিছুক্ষণ।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৪/ জোত পাস, যেখানে হাতছানি দেয় স্বর্গ

জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম স্বর্ণমন্দিরের দিকে। ছবিতে দেখা আর নিজের চোখে দেখা যে এক নয়, বুঝতে পারা যায় স্বর্ণ মন্দির সামনে দাঁড়িয়ে। আমার সামনে এখন বিশাল হ্রদ, অমৃত সরোবর। এই হ্রদের নাম থেকেই নাম হয়েছে অমৃতসরের। এই হ্রদের মাঝেই রয়েছে স্বর্ণমন্দির বা হরমন্দির সাহেব।

১৫৭৭ সালে এই সরোবর আবিষ্কার করেন চতুর্থ শিখ গুরু রাম দাস। এর মাঝখানে মন্দির তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন পঞ্চম শিখ গুরু, গুরু অর্জন। তৈরি হয় হরমন্দির সাহেব।

amritsar golden temple
অমৃত সরোবর এবং হরমন্দির সাহেব।

১৭৬৪ সালে হরমন্দির সাহেবকে আজকের রূপ দেন জস্‌সা সিংহ আহলুওয়ালিয়া। উনিশ শতকের গোড়ায় মন্দিরকে সোনায় মুড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন মহারাজা রঞ্জিত সিংহ। প্রায় সাড়ে সাতশো কিলোগ্রাম সোনা ব্যবহার করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৩/ কাংড়া ফোর্ট দেখে দলাই-ভূমে

স্বর্ণমন্দিরের ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। বিশাল লাইন পড়েছে। সেই লাইনে দাঁড়ালে কখন মন্দির থেকে বেরোব তার কোনো ঠিক নেই। তাই মন্দিরের ভেতরে না ঢুকে হ্রদকে পরিক্রমা করলাম। হ্রদের এক এক দিক থেকে এক এক রকম লাগছিল স্বর্ণমন্দিরকে। চত্বরে ঘুরতে ঘুরতেই শিখদের পবিত্র হালুয়া প্রসাদের স্বাদ নিলাম। অমৃতসরে আরও কিছু দ্রষ্টব্য স্থান রয়েছে, যেমন গোবিন্দগড় কেল্লা, দুর্গিয়ানা মন্দির। কিন্তু আমাদের হাতে সময় অল্প বলে সেই সব দেখা বাকি থেকে গেল। দিন পড়ে এল, ফিরে চললাম হোটেলে।

amritsar golden temple
স্বর্ণ মন্দির যাওয়ার রাস্তা।

শেষ হল আমাদের সফর। কাল সক্কালেই রওনা হব দিল্লির উদ্দেশে। কত চিন্তা ছিল শীতে হিমাচল যাচ্ছি, রিস্ক নেওয়াটা ঠিক হয়েছে তো! ভাগ্যিস মদনলালজি অভয় দিয়েছিলেন, নইলে এই সুন্দর একটা সফর করতেই পারতাম না। দেখতে পেতাম না জোত পাসের বরফকে, খাজিয়ারের তুষারচমক দিয়ে এত সুন্দর শুরু হত না বছরটার। কনকনে ঠান্ডায় ভারমৌর শুধু স্বপ্নেই থেকে যেত।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ২/ ধৌলাধারের পাদদেশে পালমপুরে

সন্ধ্যায় সব হিসেব মিটিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের ঘরে এলেন মদনলালজি। আজ রাতেই শিমলার রাস্তা ধরবেন তিনি। ছ’বছর আগের মুখটার সঙ্গে আজকের মুখটার কী অদ্ভুত মিল। সে বারও চণ্ডীগড়ে আমাদের ছাড়ার সময়ে তাঁর চোখের কোণে জল দেখেছিলাম, এখনও বুঝতে পারছি তাঁর চোখটা ছলছল করে উঠছে। দরজা থেকে বেরোনোর মুহূর্তে একটা কথাই বলে গেলেন, “আগলে সাল জরুর আনা। লাহুল-স্পিতি চলেঙ্গে।” (শেষ)

কী ভাবে যাবেন

সরাসরি কলকাতা থেকে অমৃতসর যাওয়ার জন্য একগাদা ট্রেন রয়েছে। হাওড়া-অমৃতসর মেল এবং হাওড়া-এক্সপ্রেসের পাশাপাশি রয়েছে কলকাতা-অমৃতসর দ্বি সাপ্তাহিক অকাল তখৎ এক্সপ্রেস, কলকাতা-অমৃতসর দ্বি সাপ্তাহিক দুর্গিয়ানা এক্সপ্রেস এবং শিয়ালদল-অমৃতসর সাপ্তাহিক জালিয়ানওয়ালাবাগ এক্সপ্রেস। দেশের সঙ্গেও অমৃতসর ট্রেনপথে যুক্ত।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ১ / যাত্রা শুরু বিলাসপুরে

কোথায় থাকবেন

অমৃতসরে থাকার জায়গার কোনো অভাব নেই। স্টেশনের কাছে হোক বা স্বর্ণমন্দিরের কাছে, হোটেল রয়েছে সব জায়গাতেই। হোটেল বুকিং-এর বিভিন্ন ওয়েবসসাইট থেকে তাদের সন্ধান পেয়ে যাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *