শীতের হিমাচলে ৬/ খাজিয়ারের তুষারচমক

শ্রয়ণ সেন

নতুন বছরটা এর থেকে বেশি ভালো হতে পারত না। ঘরের দরজা খুলতেই পুরো চমকে দেওয়া দৃশ্য। সামনের মাঠ পুরো সাদা হয়ে রয়েছে। দূরের হোটেলের চাল, দূরের রেস্তোরাঁর টেবিলও সাদা। সব কিছুতেই বরফের একটা আস্তরণ।

অথচ সারারাত বৃষ্টি বা তুষারপাত কিছুই যে হয়নি বুঝতে পারলাম আকাশটা দেখে। কারণ তুষারপাত হলে আকাশ বেশ মেঘলা থাকত, কিন্তু সে যে পুরোপুরি পরিষ্কার। তা হলে ব্যাপারটা কী? কিছুক্ষণ পরেই মাথায় এসে গেল প্রাকৃতিক সেই প্রক্রিয়ার কথা, যাকে বলা হয় গ্রাউন্ড ফ্রস্ট।

তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি বা হিমাঙ্কের নীচে থাকার ফলে রাতে পড়া শিশির সব জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। হোক না নকল বরফ, বছরের প্রথম দিন এ রকম একটা সকাল দেখব ভাবতেই পারিনি।

খাজিয়ারের পথে, দর্শন দিল তুষারশুভ্র পর্বতশ্রেণি।

গতকাল অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর, চম্বা থেকে এসে পৌঁছোলাম খাজিয়ারে। খাজিয়ারে সাধারণত পর্যটক থাকেন না। বেশির ভাগই ডালহৌসি থেকে এক দিনের সফরে ঘুরে যান। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা ছিল অন্য, বছরের শেষ দিনটা খাজিয়ারের ঠান্ডায় রাত কাটানো এবং ভাগ্য ভালো থাকলে বরফ দেখা ছিল উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই।

চম্বা থেকে খাজিয়ারের দূরত্ব মাত্র ২৭ কিমি। কিন্তু এই পথের, বিশেষ করে শেষ সাত কিমি পথের সৌন্দর্যের কোনো তুলনা নেই। রাস্তা ক্রমশ পাহাড়ে উঠছে। দূরে দেখা যাচ্ছে কাশ্মীর এবং মণিমহেশের পর্বতশ্রেণি।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৫/ মণিমহেশের প্রবেশদ্বারে

খাজিয়ার পৌঁছোনোর কিলোমিটার খানেক আগে শুরু হয়ে গেল কালাটপ অভয়ারণ্য। দেবদারু গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললাম। হঠাৎ করে দূরে সরে গেল সব গাছ, আমাদের চোখের সামনে হাজির হল এক বিরাট মাঠ। এসে পৌঁছোলাম খাজিয়ারে।

পর্যটকময় খাজিয়ার।

খাজিয়ারে আসা আমার কাছে একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হয়ে গেল। হিমাচল পর্যটনের হোটেলে চেকইন হল। ঘরের সামনে বারান্দায় বসে সুবিশাল মাঠের ওপরে নজর রাখছি। বছরের শেষ দিন হওয়ার ফলে পর্যটকের ভিড় চোখে পড়ার মতো।

মধ্যাহ্নভোজনের পরে ঠিক করলাম পুরো মাঠটা ঘুরব। মাঠের এক কোণে কিছু হোটেল এবং রেস্তোরাঁ রয়েছে। রয়েছে খাজ্জিনাগের মন্দির। এই মন্দির থেকেই নাম হয়েছে খাজিয়ারের।

সমুদ্রতল থেকে সাড়ে ছ’হাজার ফুট উচ্চতায় এই বিশাল মাঠের জন্য খাজিয়ারকে ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’ আখ্যা দেওয়া হয়। সেটা শুধু কথার কথা নয়, এক্কেবারে সুইস সরকার স্বীকৃত। ১৯৯২ সালে ৭ জুলাই খাজিয়ারকে ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’ আখ্যা দিয়েছিলেন ভারতে তৎকালীন সুইস চ্যান্সেরির প্রধান উইলি টি ব্লেজার। স্বীকৃতিস্বরূপ মাঠের এক কোণে একটি ফলকও লাগানো হয়েছে। সেখানে সুইৎজারল্যান্ডের দূরত্বও লেখা রয়েছে।

সুইটজারল্যান্ডের স্বীকৃতি

এই ফলকটা দেখে নেমে গেলাম আরও নীচে, লেকটার কাছে। এটা খাজিয়ার লেক হিসেবেই পরিচিত। বৃষ্টির অভাব বলে এখন বিশেষ জল নেই এখানে। তবে লেক ভর্তি রয়েছে মাছ। লেকের ধারেই রয়েছে সুন্দর একটা কাঠের সাঁকো। সেখানে একটু ফোটো সেশন করে আবার হাঁটা শুরু।

রোদ ঝলমলে আকাশে বেশ মনোরম শীতের দুপুর। শীতের রোদ পিঠে লাগিয়ে গোটা মাঠ চক্কর লাগাচ্ছি। মাঠের শেষ প্রান্তের একটা কোণে একটা বাংলো। এটা হিমাচল পর্যটনেরই হোটেল, খাজি কটেজ। এখানে মানুষের কোনো ভিড় নেই, নেই কোলাহল। শুধু পর্যটন, প্রকৃতি এবং পশু। মানে, শুনলাম যে মাঝেমধ্যে এখানে নাকি ভাল্লুক হানা দেয়।

মাঠের এক ধারে দেবদারুর জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে বন বিভাগের একটা বিশ্রামাবাসও। তার পাশে রয়েছে একটি প্রাথমিক স্কুল। সারা দুপুর নিজেদের মতো করে উপভোগ করলাম খাজিয়ার। কখনও ঝলমলে রোদে বসে পড়লাম মাঠের মধ্যে ঘাসের চাদরে, কখনও আবার একটু হেঁটে এলাম।

খাজিয়ার লেক

সারা দুপুর মাঠে চক্কর কেটে, সন্ধে হওয়ার আগেই ঢুকে পড়লাম ঘরে। কিন্তু ঘরের জানলা থেকেই লক্ষ করলাম কী ভাবে দিনের আলো কাটিয়ে নেমে এল অন্ধকার। কিছুক্ষণ আগের ভিড়ে ঠাসা মাঠ, ক্রমশ ফাঁকা হয়ে গেল। পাখির ডাকের জায়গায় শুরু হয়েছে কুকুরের ডাক, শিয়ালও থাকতে পারে। ভাল্লুক আছে কি? বুঝতে পারলাম না।

বছর শেষ হবে কিছুক্ষণ পরেই। রাত যত গভীর হল, ততই কাছের কয়েকটি হোটেলে শুরু হল মানুষের মত্ত উল্লাস। আমরা সেই উল্লাসে না মেতে বিছানা নেওয়াই শ্রেয় মনে করলাম।

ভাগ্যিস আগের দিন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। তাই তো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে এই অসাধারণ গ্রাউন্ড ফ্রস্টের মুহূর্ত উপভোগ করতে পারলাম।

রাতের পড়া শিশির জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। সেই বরফের টুকরো হাতে জমানোর পালাও চলল কিছুক্ষণ। অনেকে ইচ্ছে করেই বরফে আছাড় খাওয়ার জন্য পিছল মাঠেই নেমে পড়ল। আর ফোটো সেশন তো বলার কথা নয়!

তবে এই বরফের স্থায়িত্ব বেশিক্ষণের নয়। রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ধীরে ধীরে সাদা আস্তরণ সরিয়ে সবুজ রূপে ফিরে এল খাজিয়ারের মাঠ।

সকালের গ্রাউন্ড ফ্রস্ট মাখা খাজিয়ার।

খাজিয়ারে আমাদের থাকার সময় শেষ হয়ে এল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডালহৌসির উদ্দেশে রওনা হব। তবে রওনা হওয়ার আগে খাজিয়ারে এক রাত কাটানোর সিদ্ধান্তকে কুর্নিশ করলাম। রাতটা এখানে না থাকলে বছরের শুরুটা যে এতো সুন্দর হতই না। (চলবে)

কী ভাবে যাবেন

খাজিয়ার সাধারণত ডালহৌসির লোকাল সাইটসিয়িং-এর মধ্যে পড়ে। বেশির ভাগ পর্যটকই ডালহৌসি থেকে খাজিয়ার ঘুরে যান। হাওড়া বা দিল্লি থেকে ট্রেনে পাঠানকোট পৌঁছোন। সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে ডালহৌসি। ডালহৌসি থেকে খাজিয়ারের দূরত্ব ২২ কিমি।

কোথায় থাকবেন

খাজিয়ারে থাকার সব থেকে ভালো জায়গাটি হল হিমাচল পর্যটনের হোটেল দেওদার। অনলাইনে বুক করার জন্য লগইন করুন www.hptdc.in। এ ছাড়াও খাজিয়ারের মাঠের এক কোণে এবং আশেপাশে কিছু বেসরকারি হোটেল রয়েছে। হোটেল বুকিং-এর বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে তাদের সন্ধান পেয়ে যাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *