ফের ডাকল দারিংবাড়ি ৫/ ‘তিব্বত’ হয়ে গোপালপুরে

Harabhangi Dam

শ্রয়ণ সেন

জলপ্রপাতটার প্রকৃত নাম ‘এমডিউবন্ডা।’ তবে স্থানীয় উচ্চারণে সেটি ‘মিডুবান্ডা’ হয়ে গিয়েছে। আরও একটা নাম আছে এর, ‘রেনবো ওয়াটারফলস্‌’।

প্রবল বেগে নেমে আসা প্রপাতের জলধারার ওপরে সূর্যের আলো পড়ায় রামধনুর সৃষ্টি হয়েছে। মনে পড়ছে, সে বার এই মিডুবান্ডায় তিরতির করে নেমে আসা সরু একটা জলধারার দেখা পেয়েছিলাম। এ বারের দর্শনে অবশ্য মন ভরে গেল।

কিছুক্ষণ আগেই একটা আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল রিসর্টে। আজ ব্রহ্মপুর ফেরার দিন। রাতে কলকাতার ট্রেন। তবে ঘুরপথে অনেক কিছু দেখে ফিরব বলে একদম সক্কালে রওনা হতে হয়েছে।

রওনা হওয়ার মুহূর্তে আমাদের বিদায় জানানোর জন্য সপরিবার উপস্থিত ছিলেন পিন্টুজি। তাঁর স্ত্রী তরুস্মিতা, শিশুকন্যা, বৃদ্ধ বাবা সবাই হাজির। কুক প্রকাশজির চোখে জল বুঝিয়ে দিল গত তিন দিন ধরে আমাদের সঙ্গে কতটা আত্মিক ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন এই রিসর্টের সবাই।

দারিংবাড়ি চৌমাথায় পৌঁছে ডান দিকে ঘুরলাম। দু’ দিন আগে দেখা যাওয়া কফি বাগানকে ডান দিকে এবং পাইন ফরেস্টকে বাঁ দিকে রেখে এগিয়ে চললাম।

পথের সৌন্দর্য তো বলার নয়। ফের কয়েকটা হেয়ারপিন বেন্ড হাজির। টেড়িয়ে বেঁকিয়ে উঠে গেলাম আরও কিছুটা ওপরে। দারিংবাড়ি এখন আমাদের বেশ কিছুটা নীচে। এটাই হল পাঙ্গালি ঘাট ভিউ পয়েন্ট।

পাঙ্গালি পেরোতেই আবার একটু নামা। তার পর আরও কিছুটা এগোতেই ডান দিকে মিডুবান্ডার পথ নির্দেশিকা নজরে পড়ল। দারিংবাড়ি থেকে মোটামুটি ১৬ কিলোমিটার।

আসলে এমডিউবান্ডা, লোকে বলে মিডুবান্ডা।

ডান দিকের মোরামের রাস্তাটা শালের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কিছুটা গিয়ে শেষ হল। এ বার পদব্রজে এগিয়ে চলা। ধাপে ধাপে সিঁড়ি। ক্রমশ নেমেছে নীচে। মহা আনন্দে গড়গড়িয়ে নেমে চলেছি আমরা।

খেয়াল নেই, ফেরার পথে কিন্তু এই পথই ভাঙতে হাঁফ ধরবে। সে যা-ই হোক, ফেরার কথা ফেরার সময় ভাবব।

যত নামছি, একটা জলধারার আওয়াজ কানে আসছে মনে হচ্ছে। পৌঁছে গেলাম। শ’খানেক ফুট উঁচু খাড়া পাথরের গা দিয়ে প্রবল বেগে গড়িয়ে পড়ছে জল। সেই জল জমা হচ্ছে সামনে একটা ছোট্টো জলাশয়ে, তার পর জঙ্গল ভেদ করে বয়ে যাচ্ছে।

সেই জলেই পড়ছে সূর্যের আলো। তৈরি হচ্ছে রামধনু। সেই রামধনুকে নিজেদের ক্যামেরায় তুলে রাখতে কত ব্যস্ত সবাই।

মিডুবান্ডার পালা শেষ, গাড়ি স্টার্ট দেয় সারথি পিন্টু। এ বার আমাদের গন্তব্য হরভঙ্গি জলাধার। অনেক দিন থেকেই এর নাম শুনছি। এ বার চাক্ষুষ করব।

বছর দশেক আগেও ওড়িশা বললে সাধারণ পর্যটক বুঝত শুধুমাত্র সমুদ্র। এর পর দারিংবাড়ির পরিচিতি বাড়তে সেই ধারণা কিছুটা বদলাল। তবে হলফ করে বলা যেতে পারে এখনও অধিকাংশ মানুষই ওড়িশার প্রকৃত সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্যের সঙ্গে অবগতই নন। কী নেই ওড়িশায়! মরুভূমি আর তুষারপাতের জায়গা বাদ দিলে এ রাজ্যে সব কিছুই আছে।

এই যে রাস্তাটা দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, তার সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা যায় না। সব সময়ই আমাদের ঘিরে রেখেছে পাহাড়, এবং তা সুউচ্চ। পাহাড় যখন দূরে চলে যাচ্ছে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সমতল রাস্তা দিয়ে। আবার সে হঠাৎ কাছে আসতেই হেয়ারপিন বেন্ড শুরু। মাঝেমধ্যেই গহন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা।

পদ্মসম্ভব মহাবিহার।

এ ভাবেই প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছোলাম হরভঙ্গিতে। এ রাজ্যের আরও একটা পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু তার পরিচিতি বিশেষ নেই বোঝাই যায়। নীল কতটা গাঢ় হতে পারে, তার একটা আন্দাজ কিন্তু এই হরভঙ্গিতেই পাওয়া যায়।

জলাধারের স্থির নীল জলকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে পাহাড়। সেই সঙ্গে রয়েছে মেঘহীন ঘন নীল আকাশ। এক কথায় অপূর্ব। পাহাড় থেকে নেমে আসা হরভঙ্গি নদীর ওপরে বাঁধ দিয়েই এই জলাধারটি তৈরি করেছে ওড়িশার সেচ দফতর।

সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে জায়গাটিকে। রয়েছে পার্ক, নজরমিনার, সেচ দফতরের অতিথিশালা। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের অসাধারণ দৃশ্য এখান থেকে দেখা যায়। তবে এই অতিথিশালায় একটা রাত কাটাতে পারলে হরভঙ্গিকে চেটেপুটে উপভোগ করা যাবে। নিস্তব্ধতার শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে।

যাত্রা শুরু হল হরভঙ্গি থেকে। এ বার গন্তব্য ওড়িশার তিব্বত। সেখানে যাওয়ার পথেই বরং একটা গল্প বলা যাক।

সালটা ১৯৫৯। চিনের তিব্বত দখলের সময় অগুনতি ভক্তকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে চলে আসেন দলাই লামা। এই সব মানুষজনের জন্য ভারত সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসের শিবিরের ব্যবস্থা করে দেয়।

এই ওড়িশার জিরাং হল এমনই এক তিব্বতি শরণার্থী শিবির। ১৯৬৩ সালে এর পত্তন। এখানকার মূল আকর্ষণ জিরাং মনাস্ট্রি, যা পরিচিত পদ্মসম্ভব মহাবিহার নামে। ২০১০-এ এর উদ্বোধন করেন দলাই লামা স্বয়ং।

গোপালপুর সৈকত।

পাহাড়ি গঞ্জ চন্দ্রগিরি পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জিরাং। নামলাম শান্তি স্তূপের সামনে। এ যেন হিমালয়ের বুকে এক টুকরো তিব্বতি গ্রাম। স্থানীয় মানুষজন সব তিব্বতি। আশেপাশে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ। সব ক’টাই তিব্বতি খাবারের। 

বর্তমানে এখানে ৪০০০ মানুষের বসবাস যারা সবাই বৌদ্ধ এবং সেই দেশ ছেড়ে চলে আসা তিব্বতিদের বংশধর। এখানকার একতলা-দু’তলা বাড়িগুলো দেখলেই তিব্বতের ছোঁয়া পাওয়া যাবে। তিব্বতিদের পবিত্র পতাকা প্রত্যেক বাড়িতেই।

প্রথমে দেখলাম শান্তিস্তূপ। তার পর মোমো-থুকপা দিয়ে দুপুরের খাবার। সব শেষে দর্শন করলাম মনাস্ট্রি। কোথা থেকে ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেল বুঝতেও পারলাম না।

প্রকৃতির কোলে সুসজ্জিত, বাগান ঘেরা পদ্মসম্ভব মহাবিহার মনাস্ট্রি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। মনাস্ট্রির ভেতরে সুন্দর কারুকাজ, রংবেরঙের ফ্রেস্কো। অবশ্যই রয়েছে গৌতম বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। এই মঠে ২০০ জন লামা ভিক্ষু আছে যারা এখানে থেকেই পড়াশোনা করে।

জিরাংয়ের সুসজ্জিত মনাস্ট্রি দেখে মনটা বেশ উৎফুল্ল। এত পরিষ্কার পরিবেশে সব কিছু গড়ে তোলা হয়েছে, যা দেখে আপসেই মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু সেই ভালো মনটাই ক্ষুব্ধ হল তপ্তপানিতে এসে। 

সমুদ্রতল থেকে ১৭০০ ফুট উচ্চতায় এই তপ্তপানি বিখ্যাত তার উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য। এখানে ঢুকে রীতিমতো হতাশ হতে হল। অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। একটা কুণ্ড আছে, সেখান থেকে গরম জল বেরোচ্ছে। কিন্তু মানুষের ধর্মবিশ্বাসের ঠেলায় তার অবস্থা বেশ কাহিল।

ব্যাপারটা পশ্চিমবঙ্গের বক্রেশ্বরের মতো। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে বক্রেশ্বর অনেক বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

অথচ কত সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা যেত এই তপ্তপানিকে। জিরাং থেকে এ দিকে এলে, তপ্তপানির কিছু আগেই শুরু হয়ে যায় ঘাটপথ। আবার ঘিরে ধরে পাহাড়। যথেষ্ট উঁচু পাহাড়। সেই সঙ্গে ঘন জঙ্গল। আর সেই জঙ্গল, পাহাড় ভেদ করে এঁকে বেঁকে পথ চলে গিয়েছে।

তপ্তপানিতে ওড়িশা সরকারের পান্থনিবাসটাও বেশ সুন্দর পরিবেশে গড়ে উঠেছে। কিন্তু তপ্তপানির মূল আকর্ষণের বস্তুটিকেই আর ঠিকঠাক রাখা যায়নি।

ঘড়িতে বিকেল চারটে। সাত ঘণ্টা হয়ে গেল রাস্তায় রয়েছি। কিন্তু এখনও সব শেষ হয়নি। বরং এমন একটা জায়গা অপেক্ষা করছে, যেখানে দিনের আলো থাকতে থাকতে ঢুকতেই হবে আমাদের। সেটাই চ্যালেঞ্জ। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই তাই স্পিড তুলল পিন্টু।

গোটা পাঁচেক হেয়ারপিন বেন্ড পেরিয়ে এসে শেষ হয়ে গেল পাহাড়ি পথ। এ বার পুরোটাই সমতল। আমরা এগিয়ে চলেছি জাতীয় সড়ক ৩২৬ ধরে। একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে ডেনগাউস্টা, দিগাপাহান্ডির মতো বড়ো বড়ো গঞ্জ।

সন্ধ্যা সমাগত, গোপালপুর।

ব্রহ্মপুর শহরে পৌঁছে জ্যামে পড়তেই সবার মুখে চিন্তার ছাপ। ঠিকঠাক সময় পৌঁছোতে পারব তো! সেই জ্যামকে কোনো রকম পেরিয়ে আবার গাড়ি ছুটল।

পশ্চিম দিকে সূর্য ডোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর তখনই আমরা এসে পৌঁছোলাম গোপালপুরে। দিনের আলো থাকতে থাকতেই গোপালপুরের সমুদ্র দর্শন হল।

দারিংবাড়ি ভ্রমণের শেষ চমক হিসেবে রেখেছিলাম এই গোপালপুরকে। ফেরার ট্রেন ধরার আগে কয়েক ঘণ্টা সমুদ্রের সঙ্গে খেলাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।   

রবিবারের বিকেল, তাই মানুষের ঢল নেমেছে সৈকতে। চলছে সমুদ্রের সঙ্গে পা ভিজিয়ে নেওয়ার খেলা। মাঝেমধ্যেই মানুষজনকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে যাচ্ছে উট। তার ওপরে বসে সৈকতের মজা নিচ্ছে কচিকাঁচারা।

ভরপুর আনন্দ, হইহুল্লোড় আর মজার মধ্যে দিয়ে কী ভাবে তিন-চারটে দিন কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। কলকাতায় ফিরে আবার দৈনন্দিন কাজে মন দিতে হবে ভেবেই মনটা হুহু করে উঠল।

আবার বেরোব আমরা সবাই, একই ভাবে সদলে। এই স্লোগান তুলে ব্রহ্মপুর স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দিলাম। (শেষ)

ছবি: লেখক

আরও পড়তে পারেন

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ১/ বদলে গিয়েছে কত!

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ২/ তুষারপাতের ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করলাম

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ৩/ দুলুরির তীরে মজলাম পিকনিকে

ফের ডাকল দারিংবাড়ি ৪/ চিনলাম অন্য ভাবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *