গাড়োয়ালের অলিগলিতে / চতুর্থ পর্ব : বারসুতে রাত কাটিয়ে বারকোটের পথে

view from barsu
tanmoy bhattacharya
তন্ময় ভট্টাচার্য

ইচ্ছা ছিল বা বলা যায় প্রায় নিশ্চিত ছিলাম বরফ পড়বে, কিন্তু বিধি বাম। গঙ্গোত্রীতেও তুষারপাত হল না। তবে সুগতদা চিন্তিত ছিলেন যে বরফ পড়লে ঠান্ডায় আমাদের আরও কষ্ট হবে। সঙ্গে প্রাকৃতিক যে দৃশ্য আমরা দু’ চোখ ভরে গিলছি, কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল অন্তত তুষারপাতের অভিজ্ঞতাটা হয়ে যাক। কিন্তু হল না। ব্যাজার মুখে গাড়িতে চড়লাম। একই রাস্তায় নেমে আসতে হবে ভাটোয়ারি পেরিয়ে গাংনানি অবধি। গানানির একটু আগে ডান দিকে রাস্তা উঠে যাবে। সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার মতো গেলেই বারসু গ্রাম। বারসু গ্রাম হল দায়রা বা দরিয়া বুগিয়ালের বেস ক্যাম্প। এখানে সবাই ট্রেক করতেই আসে। কিন্তু আমাদের দলে সেই লোক হাতে গোনা চার-পাঁচ। তাই ট্রেক নয়, আমরা যাচ্ছি সৌন্দর্য আস্বাদন করতে।

আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / প্রথম পর্ব : ধনৌলটি ছুঁয়ে নিউ টিহরী

গাংনানির পর বারসুর রাস্তা ধরতেই চোখের সামনে হই হই করে চলে এল একের পর এক সাদা শৃঙ্গ। কেউ কেউ নাম করা যেমন কেদার, কেউ বা অনামী। সদ্য গতকাল রাতে বরফ পড়ে সাদা হয়ে সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। আমাদের গাড়ির গতিও তাই রুদ্ধ হয়ে গেল। আজ মোট যাওয়ার ছিল ৪০ কিমি মতো। তার শেষ ১০ কিমি পথে চলল আমাদের ছবি তোলার ধুম। তাই সেই পথ পাড়ি দিতে সময় লেগে গেল প্রায় এক ঘণ্টা। লাগবেই না কেন। এক এক বাঁকে এক এক শুভ্র হিমশীতল চূড়া আমাদের অভ্যর্থনা করছে যে। না নেমে উপায় কী? আমাদের গাড়ি হিমাচল থেকে আনানো হয়েছিল। স্থানীয় নন। তবে চালক আমাদের খুবই পরিচিত – যোগরাজ ভাই। গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তোলাতে তিনি তো অখুশি ননই, বরং যেখানে যেমন খুশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে আমাদের সাহায্য করেছেন। হয়তো দ্রষ্টব্য স্থান আমাদের খুঁজে নিতে হয়েছে, কিন্তু কোনও সময় তাড়াহুড়ো করেননি। ফলে ক্যামেরা ভরে ভরে ছবি এসেছে বাড়িতে।

barsu
বারসু।

আমরা পৌঁছোলাম জিএমভিএন-এর টুরিস্ট বাংলোয়। এই প্রথম গাড়ি একদম বাংলোর সামনে আমাদের পৌঁছে দিতে পারল। অন্যগুলির মতো এরও ঘর থেকে কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য সে ভাবে নেই। তবে ঘর পরিষ্কার যতই পুরোনো হোক। রান্নাও ভালো। বিপদ হতে পারত। অন্য সব টুরিস্ট বাংলোর মতো এখানে আমাদের আগমনের অগ্রিম খবর কর্তৃপক্ষ এঁদের পাঠায়নি। ফলে আমাদের আগে কোনো ট্রেকার দল এসে গেলে আমাদের ঘর তাদের হয়ে যেত। এখানে মূল আবাসে ৭টি ঘর ও সুন্দর তাঁবুসদৃশ দু’টি ঘর নেওয়া হয়েছে। তাঁবুগুলি থেকে সরাসরি বরফচূড়া দেখা যায়।

আসার পথে ভাটোয়ারির আগে পেটভরে প্রাতরাশ সেরে নিয়েছিলাম। আমাদের লক্ষ্য দু’টো – যেখানে যা খাবার পাওয়া যাবে, পেট ভরে খেয়ে নাও, আর যেখানে প্রথম তুষারশৃঙ্গ দেখা যাবে, ছবি তুলে চোখ ভরে দেখে নাও। দু’ ক্ষেত্রেই পরে আর নাও পেতে পারো। আজ সেই মন্ত্র কাজে দিল। এদের দুপুরের খাবার পরিবেশনে একটু দেরি হল। ১৯ জনের দল যে এখানে আসবে তার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। তবে মানুষজন খুব ভালো। যথাসাধ্য সাহায্য করা এদের ধর্ম। সুন্দর প্রকৃতির মানুষ সুন্দর।

আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / দ্বিতীয় পর্ব : টিহরী থেকে উত্তরকাশী হয়ে হরসিল

আশেপাশে জঙ্গল আছে। একটু দূরে উঁচুতে ভোলানাথের মন্দির। দলের কয়েক জন সেখান থেকে ঘুরেও এলেন। আমরা দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড় দেখতে লাগলাম আর রোদ গায়ে লাগাতে লাগলাম। এখানে তাপমাত্রা দশের আশেপাশে থাকলেও গঙ্গোত্রী হরসিলের পরে এখানে সে ভাবে আর ঠান্ডা লাগছিল না। ফলে লেপের তলায় ঢুকতে সবার আপত্তি। বিকেলে চায়ের আসরে শুনলাম এখানে অনেক ছায়াছবির শুটিং হয়েছে। তবে বেশির ভাগ নেপালি ছবি। নেপালি ছবিতে জায়গাটা নেপাল বলে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্যান্টিনের ইনচার্জ আমাদের এ সব গল্প শোনাচ্ছিলেন। এখন অবধি যেখানে যেখানে গিয়েছি, মনে হয় সর্বত্রই শুটিং করা যায়। কেন এখনও হলিউড এখানে পদার্পণ করেনি সেটাই বিস্ময়ের।

বিকেলে আকাশ মেঘাছন্ন হয়ে পড়ল। ঠান্ডাও শূন্যের দিকে যেতে লাগল রাত বাড়তেই। তবে কি বরফ পরবে? এর মধ্যে শুনতে পেলাম সব থেকে দুঃখের খবর। আমাদের দলের এক সদস্যের পরিচিত কয়েক জন আজ গঙ্গোত্রী গিয়েছেন। গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু থাকতে পারেননি। কারণ? তুষারপাত। আমরা গঙ্গোত্রী থেকে বেরোনোর কয়েক ঘণ্টা পরেই শুরু হয়েছে তুষারপাত। সেনাবাহিনী সব গাড়ি কম করে দশ কিমি নীচে নামিয়ে দিয়েছেন। হায় কপাল। কয়েক ঘণ্টার তফাতে আমি জীবনের প্রথম তুষারপাত মিস করলাম। ভাগ্যে ছিল না, বা অন্য ভাবে ভাগ্য ভালো ছিল। কারণ বরফে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের নামা মুশকিল হয়ে যেত, থাকা মুশকিল হত। এর পর দুঃখী মন নিয়েই রাতের নিদ্রা।

another view frombarsu
বারসু থেকে আরও।

সকালে মন ভালো হয়ে গেল। কালকের বরফঢাকা পাহাড়গুলোর মাথায় চেপেছে আরও বরফ, আর ন্যাড়া পাহাড়গুলো রাতের বরফপাতে একদম সাদা। যেন আইসক্রিম। খুশির শেষ নেই। ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে তুলতে বুঝতে পারলাম এদের দূরত্ব খুব বেশি নয়। এমনকি বরফ শেষ যেখানে পড়েছে তার থেকে এই বাড়ির দূরত্ব সামান্যই। অর্থাৎ সেই হরসিলের মতো আবার কাছে এসেও এল না।

আরও পড়ুন গাড়োয়ালের অলিগলিতে / তৃতীয় পর্ব : গঙ্গোত্রীতে এক রাত

আমরা বেড়িয়ে পড়লাম সকাল সকাল। আজ উত্তরকাশী হয়ে বারকোট যাব। উত্তরকাশীতে খানিকক্ষণ কাটাব, তা ছাড়া আজকের রাস্তাও অনেকটা। তাই ৭টায় বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। তখন সবে পাহাড়ের মাথায় ধীরে ধীরে সূর্যের আলো এসে পৌঁছেছে। বরফঢাকা পাহাড়গুলি যেন ঝলসে উঠছে। ঘোড়ায় চড়ে দিনের কাজে বেরিয়ে পড়েছেন গ্রামবাসীরা। কালকে রাতে পরিচিত হওয়া এক বাঙালি ভদ্রলোক তাঁর গাইড নিয়ে দরিয়া বুগিয়াল চলে গেলেন। আমরা গাংনানি হয়ে উত্তরকাশী নেমে আসতে লাগলাম।

উত্তরকাশীতে আবার

একই রাস্তায় ফিরতে হবে বলে উত্তরকাশীর বিশ্বনাথ দর্শন আমরা ফেরার পথে করব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। সেইমতো ৯টা নাগাদ এখানে পৌঁছে মন্দির দর্শনে গেলাম। মন্দিরে শিব ও শক্তি। আগে শক্তির পূজা করে চলে গেলাম শিবের মন্দিরে, পাশাপাশি। বলা হয় গঙ্গার ধারা যেখানে উত্তরবাহিনী, অর্থাৎ সাধারণ নদীর তুলনায় একটু অন্যমুখী, সেই সব পীঠস্থান কাশী নামে পরিচিত। যেমন বারাণসী, উত্তরকাশী, গুপ্তকাশী প্রভৃতি। প্রচুর সন্ন্যাসী এই উত্তরকাশীতে তপশ্চর্যা করেন। এখানে ভাগীরথী তেজি কিন্তু জলের ধারা এখন সরু। মন্দিরে আমাদের পূজা ভালো ভাবেই সম্পন্ন হল। মনে শান্তি এল। শিবের দর্শন না পাওয়া পর্যন্ত আমার মন খুঁতখুঁত করছিল। এখানে এসে যেন প্রায় সম্পূর্ণ। এর পর বাকি শুধু যমুনোত্রী। এখানে প্রাতরাশ সেরে শহর ঘুরে দেখতে লাগলাম। সব রকম আধুনিক সুবিধাযুক্ত এই পাহাড়ি শহর।গাড়ি এক প্রস্থ সারাই হয়ে এল। আমরা উঠে বসলাম, ধারাসু বেন্ড হয়ে চললাম বারকোটের পথে। (চলবে)

ছবি লেখক

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *