কোভিডের আবহেই সপরিবার ঘুরে এলাম ঝাড়গ্রাম, আপনারাও বেরিয়ে পড়ুন

মৌমিতা মুখোপাধ্যায়

মন আর মস্তিষ্কের সংঘাত লাগলে আমার মতন বোকারা সাধারণত মনকেই জিতিয়ে দেয়। আমরা মনফকিরের দলের। এখনও তাই। কিন্তু মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন।

যাব, না যাব না? পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যাব কি না? রাত্রিবাসের পরিকল্পনা করব, না করব না? এই রকম অনেক চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে এক্কেবারে রাস্তায় নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। হ্যাঁ, আমরা বেরোচ্ছি ও রাত্রিবাসও করছি।

তিন মাসের ওপর গৃহবন্দি। মন, মেজাজ সব বিদ্রোহী হয় উঠছিল মাঝেমাঝেই। তাই বেশ কয়েক দিন ধরেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম হারিয়ে যাওয়ার নিরাপদ ঠিকানা। কিন্তু হারিয়ে যাব বললেই তো আর পাড়ি দেওয়ার জো নেই এখন। চারিদিকে তাণ্ডব তার, এ দিকে আমার সঙ্গে যাবে আমার স্কুলপড়ুয়া ছেলে ও ৬৩-এর মা। তাই আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।

সব রকম খোঁজ নিয়ে দেখলাম ঝাড়গ্রাম একটি নিশ্চিন্ত ঠিকানা হতে পার। কেন, সে কথায় পরে আসছি। খোঁজ নেওয়া চলল।

যে যে বিষয়ে প্রথমেই খোঁজখবর নিলাম, তা হল-

১. সর্ব প্রথম যে জায়গা বেছেছি সেখানে এই রোগের অস্তিত্ব বা পরিধি আছে কিনা।

২. স্থানীয় মানুষজন বাইরের পর্যটককে গ্রহণ করছে কিনা।

৩. কোথায় থাকব।

৪. যে জায়গায় থাকব সেই জায়গাটি কতটা পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্তির (Sanitisation) নিয়মকানুন মানছে। হোটেলকর্মীরা পরিচ্ছন্নতা (Hygiene) সম্পর্কে সচেতন কি না।

৫. সরকারি নিয়মাবলির সব ক’টি দিক মানা হচ্ছে কিনা। 

৬. জায়গাটি নিরিবিলি কি না, যদিও এখন সব জায়গায় তা-ই।

৭. কীসে যাওয়া হবে সেই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এখন। তাই আমার প্রথম ইচ্ছে ছিল নিজের গাড়ি।  আপনারা গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারেন।

 ৮. শেষের  পয়েন্টটা আমার মতো পাগলের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল জায়গাটির আবেদন। আপনার কাছে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা নিবার্চন করতে পারলেই কেল্লা ফতে।। 

মনে হল, এই সব ক’টি চাহিদা যে জায়গা আপাতত পূর্ণ করতে পারবে তা হল ঝাড়গ্রামে। থাকার ব্যবস্থা হল রাজ্য বন উন্নয়ন নিগমের প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রের বনবাংলোয়। অসাধারণ অবস্থান। ছ’টি কটেজ শাল গাছের ঘেরাটোপের মধ্যে। জঙ্গলে থাকার একটা মৃদু স্বাদ মিলবে।

ঝাড়গ্রাম রাজ প্যালেস।

এমনিতেই জঙ্গল বর্ষাকালে সুন্দরী, তার ওপর তারই কোলের কাছে হল আমার আস্তানা।

প্রবেশ মাত্রই শরীরের তাপমাত্রার স্ক্রিনিং হোক, ঘরের পরিচ্ছন্নতা হোক, খাবার পরিবেশন করার পদ্ধতি হোক, সব ক্ষেত্রেই স্যানিটাইজেশনের নিয়মকানুন পালন করছেন ওঁরা।   

স্থানীয়রাও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেছেন আমাদের। আমরা নিজেদের গাড়িতেই ঘুরেছি, কোনো রকম বাধার সম্মুখীন হইনি। তবে অযৌক্তিক বা অনধিকার প্রবেশ করার কথা ভাবিনি, করিওনি।

এই সময় নিজের পরিধিটা বুঝে ঘুরতে বেরোনো উচিত। যতটা সম্ভব সাবধানতা নিতে হবে। পোর্টেবল রুম স্যানিটাইজার থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, নিজেদের বিছানার চাঁদর, সাবান, খাবার জল সব সঙ্গে ছিল। তবে ওখানে কেন্টের ওয়াটার ফিল্টার বসানো হয়েছে।

এ বার আসি আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথায়।

কিছু কিছু চাহিদা সময়ের চাহিদায় হয়ে ওঠে অমূল্য। সময় দাবি করেছিল একটা ব্রেক থ্রুর। গণ্ডি পেরিয়ে বল্গাহীন সফর। সেই দাবিতেই আবার পথেই হল পথ চেনা।

চেনা চার পাশ হয় উঠল অচেনার সার দেওয়া ছবি কথা। সকাল হয়ে উঠল সবুজ মসৃণ গালিচাময়….গায়ে তার পিচ ঢালা রাস্তা মসৃণ ফিতের মতো।  চোখে খালি সবুজের উদযাপন, সব নোনাধরা দিন আরও এক বার সতেজ, সবুজ, যৌবনমুখর। 

এই অনুভূতিটা ঠিক বলে বোঝানো যায় না, তবে বোঝাতে অবশ্যই সাহায্য করতে পারি।

ধরুন, খুব ঠান্ডা কোনো পাহাড়ি গ্রামে সন্ধ্যাবেলা আগুনের পাশে বসে গা সেঁকার তৃপ্তি বা গরম দুপুরে কাঠফাটা রোদকে ঢেকে দিয়ে হঠাৎ বিশাল এক মেঘের অবাধ্য প্রবেশ হলে যে রকম তৃপ্তি আসে, ঠিক সেই রকম।

পশ্চিমবঙ্গ বনোন্নয়নের নিগমের বনবাংলো, ঝাড়গ্রাম।

কোনো প্রিয়জনকে অনেকদিন বাদে নিজের মতন করে পেলে যে রকম তৃপ্তি আসে, ঠিক সে রকম। 

বোঝাতে পারলাম? আমি তৃপ্ত। জল  ছা পা ছা পি… ডুদুলুং নদীর মতোই ভাটা পড়া মন প্লাবিত।।

এই ট্রিপ করার আরেকটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। কর্মসূত্রে আমি ট্রিপ প্রফেশনাল আর নেশাসূত্রে ভ্রামণিক। তাই সরেজমিন পর্যবেক্ষণটা খুব জরুরি। আমি নিজে জায়গার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া  না বুঝে কখনোই অন্যের ট্রিপের কথা ভাবিনি, আর এখন তো আরওই নয়।

আসলে ঘুরতে যাওয়া মানে জমাট স্বপ্নকে একে একে মুক্ত করা – সেই স্বপ্নগুলোতে ঠিকঠাক পাখা লাগানোর কাজটাই আমার উদ্দেশ্য। 

আবার পাড়ি দেব …. খানিক বিরতির পর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *