সপ্তাহান্তে চলুন: কাঁচড়াপাড়ার কৃষ্ণরায় মন্দির

শুভদীপ রায় চৌধুরী

বঙ্গে বহু কৃষ্ণমন্দির রয়েছে যার গৌরব এবং ঐতিহ্য বহু দিনের। কলকাতা-সহ শান্তিপুর, খড়দহ ইত্যাদি স্থানে বহু বছর ধরে সেবা পাচ্ছেন শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। সেই সমস্ত মন্দিরের মধ্যে অন্যতম এবং প্রাচীনত্বে অনেক এগিয়ে  কাঁচড়াপাড়ার কৃষ্ণরায় মন্দির।

কাঁচড়াপাড়া বহু প্রাচীন স্থান, এই অঞ্চলের আগে নাম ছিল ‘কাঞ্চনপল্লি’। এই স্থানে ১৭৮৫ সালে মল্লিক বংশের নয়নচাঁদ মল্লিকের দুই পুত্র গৌরচরণ (জ্যেষ্ঠপুত্র) এবং নিমাইচরণ (মধ্যমপুত্র) শ্রীশ্রীকৃষ্ণরায় বিগ্রহ-সহ এক বিরাট মন্দির নির্মাণ করান। বলা যায় বঙ্গপ্রদেশের অন্যতম বৃহৎ কৃষ্ণমন্দির তথা গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের প্রাণের মন্দির।

কাঁচড়াপাড়ার ইতিহাস

ইতিহাসবিদ কুমুদনাথ মল্লিক তাঁর ‘নদীয়া কাহিনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “কাঞ্চনপল্লী বা বর্ত্তমান কাঁচড়াপাড়া নদীয়া জেলার একটি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ গ্রাম। বহু পূর্ব্বকালে ইহার নাম ছিল নবহট্টগ্রাম।… বর্ত্তমান কাঞ্চনপল্লী গ্রামটি গঙ্গাযমুনার সঙ্গম স্থানের  চরভূমির উপর স্থাপিত। পূর্ব্ব খ্যাত কাঞ্চনপল্লী কালের কুটীল গতিতে এখন গঙ্গাবক্ষে বিরাজ করিতেছে। বৈষ্ণবদিগের প্রসিদ্ধ পাঠমালা গ্রন্থে দেখা যায় যে কাঞ্চনপল্লী গ্রামটি সেন শিবানন্দের পাট বলিয়া উক্ত আছে। শ্রীমহাপ্রভু চৈতন্যদেব এই শিবানন্দের বাটীতে আগমন করিয়াছিলেন ও এখান হইতে শান্তিপুর অদ্বৈত মন্দিরে, পরে তথা হইতে নবদ্বীপে জননী দর্শনে গমন করিয়াছিলেন।”

কৃষ্ণরায় বিগ্রহের ইতিকথা ও পুরোনো মন্দির

কুমুদনাথ মল্লিকের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ সেন শিবানন্দ নিজের গুরু শ্রীনাথ আচার্যের নামে ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণরায়’ বিগ্রহের সেবা করতেন। সেই সময় সেই বিগ্রহ থাকত শ্রীনাথ আচার্যের দৌহিত্র শ্রীমহেশের বাড়িতে।  

কথিত আছে, বঙ্গের শেষ বীর মহারাজ প্রতাপাদিত্যের খুড়তুতো ভাই যশোহরজিৎ কচুরায় দাদার বিরুদ্ধে নালিশ করতে দিল্লি দরবারে যাওয়ার সময় কাঞ্চনপল্লি দিয়ে গিয়েছিলেন। দিল্লি যাওয়ার পথে শ্রীশ্রীকৃষ্ণরায় বিগ্রহ দর্শন করে বলেছিলেন, যদি তিনি এই যাত্রায় সফল হন তা হলে তিনি ঠাকুরের একটি মন্দির তৈরি করে দেবেন। দিল্লি দরবারে গিয়ে কাজ হওয়ায় ফেরার পথে তিনি আবার সেই কৃষ্ণরায়কে দর্শন করেন এবং বহু অর্থ ব্যয় করে ঠাকুরের শ্রীমন্দির, ভোগমন্দির, দোলমঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণ করে দেন। ঠাকুরের নিত্যসেবার জন্য ‘কৃষ্ণবাটি’ নামে একখানি তালুক জায়গির দেন। পুরোনো কাঞ্চনপল্লি যখন গঙ্গার ভাঙনে তলিয়ে যায় তখন যশোহরজিতের নির্মিত শ্রীমন্দিরও গঙ্গায় চলে যায়।

বর্তমান মন্দির

কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গিয়ে প্রায় কল্যাণীর সীমানায় পৌঁছে গেলে রথতলা মোড়। সেখান থেকে বাঁ দিকে অল্প গেলেই ডান দিকে চোখে পড়ে বিশাল মন্দির প্রাঙ্গণ। মন্দিরের গেটে লেখা শিবানন্দ সেনের শ্রীপাট ও কৃষ্ণরায় মন্দির। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রথম গেট দিয়ে ঢুকে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। এখানে রয়েছে শ্রী চৈতন্যের একটি বড়ো মূর্তি। এই প্রাঙ্গণ পেরিয়ে আরেকটি গেট। দেখলেই বোঝা যায় নবনির্মিত। এই গেট পার হলে দ্বিতীয় বিশাল প্রাঙ্গণ। নানা ফুলগাছের মধ্যে কৃষ্ণরায় মন্দির।       

এখনকার শ্রীশ্রীকৃষ্ণরায় মন্দির নির্মাণ করান কলিকাতার পাথুরিয়াঘাটার জমিদার নয়নচাঁদ মল্লিকের পুত্রদ্বয় নিমাইচরণ মল্লিক ও গৌরচরণ মল্লিক। এ কথা সমর্থিত হয় কুমুদনাথ মল্লিক ও রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের লেখায়। 

পুরোনো মন্দির গঙ্গাগর্ভে চলে যাওয়ার পর ১৭৮৫ সালে কলকাতার নিমাইচরণ মল্লিক ও গৌরচরণ মল্লিক এক লক্ষ টাকা খরচ করে বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরে রথযাত্রার সময় বিশেষ সমারোহ হয়। মন্দিরগাত্রে একখানি পাথরের ফলকে গৌরচরণ, নিমাইচরণ ও রাধাচরণের নাম এবং মন্দির নির্মাণের কাল খোদিত আছে। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। তিন বিঘা জায়গার উপর ইহা প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ৬০ ফুট, প্রস্থে ৪০ ফুট এবং উচ্চতা ৭০ ফুট।

বাংলা আটচালা মন্দিরের অন্যতম নিদর্শন কাঁচড়াপাড়ার কৃষ্ণরায় মন্দির। প্রায় ৬ ফুট উঁচু ভিত্তিবেদির মন্দিরটি নির্মিত। মন্দিরের প্রবেশমুখে কাঠের দরজায় দশাবতার মূর্তি এবং লতাপাতার নানা শিল্পকর্ম খোদিত আছে। মন্দিরের সামনের দেওয়ালের গায়ে এক সময়ে যে পোড়ামাটির বহু পদ্মফুল উৎকীর্ণ করা হয়েছিল তা এখনও বোঝা যায়। এই মন্দিরের গঠনকাজে কোথাও খিলানের ব্যবহার করা হয়নি। মন্দিরের শীর্ষে পাঁচটি ছোটো ছোটো কারুকার্যময় দণ্ড রয়েছে। মাঝেরটিতে একটি চক্র এবং বাকি চারটিতে পতাকা রয়েছে। মন্দিরের অভ্যন্তরে শ্বেতপাথরের বেদির ওপর কষ্টিপাথরে নির্মিত শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ এবং বাঁ দিকে অষ্টধাতুর শ্রীরাধা বিগ্রহ।

মন্দিরের অনতিদূরে ১০ ফুট উঁচু বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত দোলমঞ্চ এবং পিছন দিকে ভোগ রান্না করার ঘর আছে। সিংহদরজার ডান দিকে টিনের চালাঘর। এখানে উৎসবের সময় যাত্রা ও থিয়েটার হয়ে থাকে।

ঠাকুরের নিত্যভোগে পাঁচ সের চালের অন্ন হয় এবং বিভিন্ন পদ সহ ঠাকুরের নিত্যভোগরাগ হয়। ঠাকুরের সেবার খরচ মেটাতে নিমাইচাঁদ মল্লিকের ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ২০০ টাকা ও রামমোহন মল্লিকের ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ২০০ টাকা করে দেওয়া হত। মল্লিক পরিবারের পক্ষ থেকে বর্তমানে আরও বেশি অর্থ দেওয়া হয় বলে জানালেন জানালেন নিমাইচরণ মল্লিকের ট্রাস্টের সম্পাদক তথা পরিবারের সদস্য ইন্দ্রপ্রসাদ মল্লিক।

রথের সময় ন’ দিন এখানে বিশেষ উৎসব হয়ে থাকে। শোনা যায়, ঠাকুরের রথ আগে ছিল বেশ বড়ো এবং কাঠের। কেউটিয়া গ্রামের (অধুনা কল্যাণীর অন্তর্ভুক্ত) জমিদার বীরেশ্বর নন্দী সেই রথ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আগুনে পুড়ে গেলে ওই নন্দী জমিদারেরাই বর্তমানের লোহার রথটি তৈরি করে দেন।

সারস্বত মঠ।

কাঁচরাপাড়ার আশেপাশে

উত্তর ২৪ পরগনার হালিশহর ও কাঁচরাপাড়া এবং নদিয়ার কল্যাণী পাশাপাশি জনপদ। সুতরাং কাঁচরাপাড়া মন্দির দেখতে গেলে আশেপাশের দ্রষ্টব্যগুলোও দেখে নিতে পারেন।

(১) সতীমায়ের মন্দির – কল্যাণী ঘোষপাড়ায়, কৃষ্ণরায় মন্দির থেকে ৪ কিমি। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক সহজিয়া আউলচাঁদের প্রধান শিষ্য রামশরণ পালের স্ত্রী সতীমা। তাঁর সমাধিস্থানের উপরেই মন্দির। রয়েছে আউলচাঁদের ব্যবহৃত দ্রব্য-সংবলিত কক্ষ, রাসমঞ্চ, হিমসাগর দিঘি ইত্যাদি।

(২) চৈতন্যডোবা – হালিশহরে, কৃষ্ণরায় মন্দির থেকে কলকাতার পথে ২.৫ কিমি, কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতীমায়ের মন্দির কলকাতার পথে থেকে সাড়ে ৬ কিমি। শ্রীচৈতন্যের ঈশ্বরপুরীর জন্মস্থান, রয়েছে রাধাগোবিন্দ জিউয়ের পঞ্চরত্ন মন্দির। এটি এখন ‘ঈশ্বরপুরীর পাট’ বা ‘শ্রীবাস অঙ্গন’ নামেও পরিচিত।

(৩) সারস্বত মঠ – চৈতন্যডোবার অদূরেই ভাগীরথী তীরে মনোরম পরিবেশে স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত সারস্বত মঠ। রয়েছে নিগমানন্দের মন্দির, নিগমানন্দ শিবমন্দির।

(৪) জোড়ামন্দির – সারস্বত মঠ থেকে ৩ কিমি দূরে বৈদ্যপাড়ায় পঞ্চচূড়াবিশিষ্ট জোড়ামন্দির, হালিশহরের সব চেয়ে পুরোনো দেবালয়।

(৫) রামপ্রসাদের কালীমন্দির – সারস্বত মঠ থেকে ১ কিমি। রামপ্রসাদের ভিটে আজ নিশ্চিহ্ন হলেও রয়েছে তাঁর সাধনস্থলী, পঞ্চমুণ্ডী আসন-সহ পঞ্চবটী। ভিটের মাটিতে তৈরি হয়েছে রামপ্রসাদ স্মৃতিমন্দির জগদীশ্বরী মন্দির তথা কালীমন্দির।                     

রামপ্রসাদের কালীমন্দির।

কী ভাবে যাবেন

শিয়ালদহ থেকে লোকাল ট্রেনে কাঁচরাপাড়া, সময় লাগে ঘণ্টা খানেকের কিছু বেশি। স্টেশন থেকে ৬ কিমি রথতলায় কৃষ্ণরায় মন্দির। স্টেশন থেকে রিকশা, অটো বা টোটো ধরে চলে যান।

আপাতত করোনাজনিত পরিস্থিতিতে ট্রেন বন্ধ, তাই চলুন সড়কপথে। ভিআইপি রোড ধরে বিরাটির মধ্য দিয়ে গিয়ে কিংবা মধ্যমগ্রাম চৌমাথা থেকে সোদপুরের পথে গিয়ে ধরে নিন কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে। জায়গাটা কাঁচরাপাড়া-কল্যাণী সীমানায়। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ওপর রথতলা মোড়। সেখান থেকে বাঁ দিকে অল্প গেলেই ডান দিকে বিশাল কৃষ্ণরায় মন্দির প্রাঙ্গণ। কলকাতা থেকে দূরত্ব ৫৫ কিমি। কলকাতা থেকে বিটি রোড ধরে গিয়ে বেলঘরিয়া, সোদপুর বা ব্যারাকপুর হয়েও কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *