ঠাকুর দেখা: দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ শহরতলি আবার দক্ষিণে

পূর্ব ও উত্তর  কলকাতায় পুজো পরিক্রমা সেরে ভ্রমণ অনলাইন বেরিয়ে পড়েছে দক্ষিণ কলকাতায় পরিক্রমা সারতে। শহরতলি-সহ দক্ষিণ কলকাতা এক বিশাল এলাকা। পুজো পরিক্রমা শুরু হয়েছে ভবানীপুর থেকে। তার পর কালীঘাট, ম্যাডক্স স্কোয়ার দেখে মুদিয়ালি অঞ্চল। সেখান থেকে বাদামতলা হয়ে চেতলা। এর পর নিউ আলিপুর হয়ে বেহালা। তার পর হরিদেবপুর ঘুরে নাকতলা দেখে গড়িয়া-পাটুলি ছুঁয়ে যোধপুর- ঢাকুরিয়া অঞ্চল। তার পর কসবা হয়ে বালিগঞ্জ। এই বিস্তীর্ণ এলাকা দু’ ভাগ করে দেখতে পারেন। আমাদের তালিকার বাইরেও অসংখ্য ভালো ভালো পূজা আছে যা পথেই পড়ে।

ভবানীপুর ৭৫ পল্লি

৫৫তম বর্ষে এদের থিম ‘নাগরদোলা’।পাড়ার বাসিন্দাদের জীবনের নানা অঙ্গ নিয়ে মণ্ডপের পরিকল্পনা। থিম-নির্ভর মাটির প্রতিমার সাজসজ্জায় রয়েছে লোহার অলংকার। নেতাজি ভবন মেট্রো স্টেশন থেকে অল্প হেঁটে গলির ভেতরে মণ্ডপ।

আরও পড়ুন ঠাকুর দেখা: পূর্ব কলকাতা ও সল্ট লেক

চক্রবেড়িয়া সর্বজনীন

এই পুজো এ বার ৭৪ বছরে পা দিল। এ বারের থিম ‘লেভেলস অব রিয়্যালিটি’। যদুবাবুর বাজার বাসস্টপ বা নেতাজি ভবন মেট্রো স্টেশন নেমে হাঁটা পথে মণ্ডপ।

ভবানীপুর মুক্তদল

৭১তম বর্ষে ভবানীপুর মুক্তদল আবার সাবেকমুখী। মণ্ডপ ও আলোকেও সেই সাবেকিয়ানার ছাপ। দেবীপ্রতিমা বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা। প্রতিমার পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি। চুল এলো। নেই গহনার জৌলুস। মাথায় মুকুট নেই। একদম সিধাসাদা সাধারণ শিবজায়া। লক্ষ্মী সরস্বতী গণেশ কার্তিকের পরনেও সেই সাধারণের ছোঁয়া। থিমের মাঝে চোখ জোড়ানো শান্তি এনে দেবে ভবানীপুর মুক্তদলের এই বছরের ঠাকুর। সম্পূর্ণ সনাতন চেহারায় দেখা যাচ্ছে দেবী মাকে। হরিশ মুখার্জি রোডের ওপর, নেতাজি ভবন বা যতীন দাস পার্ক মেট্রো স্টেশন থেকে হাঁটা পথে মণ্ডপ।

আরও পড়ুন ঠাকুর দেখা: উত্তর ও মধ্য কলকাতা

বকুলবাগান সর্বজনীন

৯২তম বছরে পুজোর অন্যতম চালচিত্রকে থিম হিসাবে বাছা হয়েছে। কালীঘাটের পটচিত্রের অনুকরণে আঁকা কাঠের চালচিত্রে সেজেছে মণ্ডপ। মণ্ডপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বর্তমান সমাজের নানা ছবি। একচালা সাবেক ঠাকুরের গায়ে থাকছে সোনালি গয়না ও বেনারসি শাড়ি। যতীন দাস পার্ক মেট্রো স্টেশন থেকে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের ফুটপাথ ধরে এগিয়ে গেলে ডান দিকের রাস্তায়।

ম্যাডক্স স্কোয়ার

ম্যাডক্স স্কোয়ারের পুজো মানেই জমজমাট ব্যাপার। ঠাকুর দেখা আর খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে বিরাট মাঠে বসে জমিয়ে আড্ডা। মন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে, পাট, কাপড়, বাঁশ সহ আরও বেশ কিছু জিনিস দিয়ে। মণ্ডপের ভিতরেও রয়েছে দারুণ কারুকার্য। প্রতিমা দর্শনে ভিতরে ঢুকলে দেখা যাবে এক বিশাল ঝাড়লণ্ঠন, যা শোভা বাড়াচ্ছে মণ্ডপের। প্রতিমা সাবেক। রিচি রোডে মণ্ডপ। সেন্ট লরেন্স স্কুলের কাছে।

মুদিয়ালি ক্লাব 

৮৫তম বছরের থিম ‘সাজিয়ে পূজার ডালি, রঙের হাতে মুদিয়ালি’। মণ্ডপ সেজে উঠেছে রঙের খেলায়। সঙ্গে অভিনব আলোকসজ্জা, বিভিন্ন কাল্পনিক ও বিমূর্ত মোটিফ। প্রতিমা সাবেক। কালীঘাট মেট্রো স্টেশন থেকে দক্ষিণ বরাবর বেশ খানিকটা গিয়ে বা মুদিয়ালি বাসস্টপে নেমে একটু এগিয়ে বাঁ দিকের রাস্তায় মণ্ডপ।

মুদিয়ালি শিবমন্দির

সংসারের নানা বন্ধনে মানুষ আবদ্ধ – পারিবারিক মায়া-মমতা, বন্ধুত্বের বন্ধন, কাজের জায়গার সম্পর্ক, ভালোবাসার বন্ধন – আরও কত কী! তবে এই বাঁধনের টান আলগা হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয় নিয়েই এ বারের থিম বন্ধনী। শিবমন্দিরের পুজোর এ বার ৮৩ বছর।  

বাদামতলা আষাঢ় সংঘ

৮২তম বছরে এদের থিম ‘বিন্দু’। পৃথিবীর সব শুরু বিন্দু থেকে। আবার সব কিছু বিলীনও বিন্দুতে। থিমের সঙ্গে মানানসই প্রতিমা। সাবেক প্রতিমার তৃতীয় নয়নকেই সৃষ্টি ও বিনাশের উৎস হিসাবে দেখানো হয়েছে। কালীঘাট মেট্রো স্টেশন বা রাসবিহারী মোড় থেকে একটু হেঁটেই মণ্ডপ।

৬৬ পল্লি

দুর্গাপূজা কারও জন্য পাঁচ দিনের হাসি, কারও কাছে বা সারা বছরের জন্য হাসির জোগান দেয়। যাঁরা এই হাসি ফোটানোর উৎস এত হইচই আনন্দের মাঝে তাঁরাই থেকে যান অন্ধকারে। তাঁদের কেউ কোনো দিন পুরস্কৃত করে না। কেউ নামটুকুও হয়ত জানতে পারে না। এঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন পুরোহিত, তেমনই রয়েছেন পটুয়া, কিংবা রয়েছেন ঢাকি অথবা কারিগররা। ৬৯তম বর্ষে সেই সব আড়ালে থাকা মানুষদের কুর্নিশ জানাচ্ছে কালীঘাটের ৬৬পল্লী। বাদামতলা আষাঢ় সংঘের পাশেই।

চেতলা অগ্রণী 

২৭তম বছরে চেতলা অগ্রণীর থিম ‘কলিকাতা চলিছে নড়িতে নড়িতে’। মণ্ডপের বাইরে রয়েছে কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামঠিকানা লেখা নানা ধরনের লেটার বক্স। এই বক্সগুলি থেকে অনেক কম্পিউটার-মাউস বেরিয়ে আসছে। মণ্ডপে রয়েছে এক বেহালাবাদক। তার বেহালার সুরে এই মাউস বেরিয়ে আসছে। মণ্ডপের প্রবেশপথে টাইম জোন। সেখানে পেন্ডুলাম দুলছে। সেই পথ ধরে ভেতরে গেলেই পৌঁছে যাচ্ছেন এক পুরোনো কলকাতায়। মহালয়ার দিন চেতলা অগ্রণীর প্রতিমার চক্ষুদান করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাসস্টপ চেতলা অগ্রণী।

সুরুচি সংঘ 

এ বারের বিষয় ‘উৎসব’। ২০০ ফুট উঁচু মেঘের তলায় রয়েছে নানা ধরনের ঘর। লোহার জালি দিয়ে তৈরি হয়েছে মেঘ। যেন মা-ই এটা তৈরি করে দিয়েছেন। নীচে আশ্রয় সব শ্রেণির মানুষদের।

এ বার চলুন বেহালায় 

থিমপুজোর জন্মভূমি বেহালা। এক সময়ে কলকাতার অন্দর থেকে লোকে বেহালা ছুটে যেত থিমের ঠাকুর দেখতে। এখনও থিমপুজোর প্রতিযোগিতায় একেবারে সামনের সারিতে বেহালা। সুরচি সংঘ দেখে তারাতলা হয়ে চলুন বেহালায়।

বেহালা ক্লাব

বেহালা থানার বিপরীতে হরিসভা ময়দানে মণ্ডপ। এ বছর পুজো ৭৫-এ পা দিল। পুজোর বিষয়বস্তু ‘প্রাণের পরব কথা’। দুর্গাপূজা ছাড়াও টুসু, ভাদু, চড়ক, গাজন ইত্যাদি নানা উৎসব রয়েছে আমাদের জীবনে। সেই সবা হারিয়ে যেতে বসা উৎসবের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছে বেহালা ক্লাব।  

বেহালা ফ্রেন্ডস

বেহালা ১৪ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে রায়বাহাদুর রোড ধরে ইলোরা সিনেমার নিকটেই পেয়ে যাবেন মণ্ডপ, অফিসপাড়ার থামযুক্ত বাড়ি। একটা বিরাট টাইপরাইটারের মধ্য দিয়ে মণ্ডপে প্রবেশ। দেখানো হয়েছে অফিসপাড়ার টাইপিস্টদের চিঠির বিষয়বস্তু। গোলঘরের ভিতরে প্রতিমার অধিষ্ঠান।

বেহালা দেবদারু ফটক

বেহালার ১৪ নং বাসস্ট্যান্ডের বিপরীতে শিশু উদ্যান পার্কে। উৎসবপ্রিয় বাঙালির বাঙালিয়ানার খণ্ডচিত্র দেখানো হচ্ছে দেবদারু ফটকে। খেলা, সাহিত্য, সংগীত, প্রেম – সবেতেই বাঙালির উন্মাদনা। তাই এ বারের পুজোর শিরোনাম ‘গ্ল্যাডলি বাঙালি’। বাঙালিয়ানাকে মনে করাতে মায়ের সাবেক রূপ। 

বড়িশা ক্লাব

সখের বাজার মোড় থেকে বাঁ দিকে, জেমস লং সরণি ক্রসিং-এর কাছে। এদের এ বছরের পুজোর থিম ‘তোমাদের বাড়ছে গতি, আমাদের দুর্গতি’। দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে সভ্যতা, যার জেরে ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। মোবাইল টাওয়ারের জেরে পাখির বংশ লোপ। প্রতিমা কাঠের। তাঁর কোলেই আশ্রয় নিয়েছে পাখিরা।

বড়িশা সর্বজনীন

এ বার এদের ৭১তম বর্ষ। এদের নিবেদন ‘কৃষি নির্ভরতা’। পুজোর শিরোনাম ‘পালক’। প্রতিমা থিমের সঙ্গে মানানসই। সখেরবাজার মোড় থেকে কেকে রায়চৌধুরী রোড ধরে দ্বাদশ মন্দিরের কাছেই পাওয়া যাবে বড়িশা সর্বজনীনকে। 

বড়িশা ইউথ ক্লাব

সখেরবাজার মোড় থেকে ডান দিকে গেলে দত্তের মাঠ ছাড়িয়ে দক্ষিণ বেহালা রোডে ইউথ ক্লাবের মণ্ডপ। উত্তরবঙ্গ, অসম আর মণিপুর থেকে বাঁশ এনে ফুল, লতাপাতা ও নানা কারুকাজ তৈরি করেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা ও বাংলাদেশের শিল্পীরা। ৪০ বছরের পুজোর এটাই এ বারের বিশেষত্ব।  

হরিদেবপুর

বেহালা-বড়িশা অঞ্চলের ঠাকুর দেখে সন্তোষ রায় রোড ধরে ধারাপাড়া হয়ে চলে আসুন মহাত্মা গান্ধী রোডে। ডান দিকে ঘুরে চলুন হরিদেবপুর।

হরিদেবপুর অজেয় সংহতি

এ বার এদের পুজার ৫৯তম বর্ষ। হাজারিবাগের এক আদিবাসী গ্রামের চিত্রকলা দিয়ে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ। গ্রামেরই বাসিন্দাদের আঁকা চিত্র। মা দুর্গাকে পরানো হয়েছে খড়ের গয়না। সঙ্গে মানানসই আলোকসজ্জা।  

হরিদেবপুর ৪১ পল্লি

অজেয় সংহতি দেখে করুণাময়ী মোড়ের দিকে আসুন। ডান দিকে ৪১ পল্লির মণ্ডপ। ৬২তম বর্ষে এদের থিম ‘আগন্তুক’। সংবাদপত্রের কাজকর্মের উপর ভিত্তি করে এই ভাবনা। মণ্ডপসজ্জার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হয়েছে প্রতিমা। আলোকসজ্জাতেও রয়েছে চমক।

গড়িয়ার পথে

পশ্চিম পুটিয়ারি পল্লি উন্নয়ন সমিতি

করুণাময়ী সেতুর আগে ডান দিকের রাস্তা ধরে চলে আসুন এদের মণ্ডপে। বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা মাঠের ধুলো হাতের মুঠোয় পায় না, হাতের মুঠোয় মাঠের ভার্চুয়াল আনন্দ উপভোগ করে। ভিডিও গেমের মাধ্যমে। আজকালের অনেক শিশুই জানে না রণপা, জোকার এই সমস্ত বিষয়ে। বিশেষ করে রণপা। কী সেই জিনিস? খায় না মাথায় দেয়? সেই হারিয়ে যাওয়া রণপা, সেই অবলুপ্তির পথে হাঁটা জোকারদের আবার শিশুমনের কাছে চিনিয়ে দিতে ও অভিজ্ঞ মনের পরতে পরতে জমে যাওয়া স্মৃতির ধুলো সরিয়ে আবার মনের কোণে এক ঝলক আনন্দের খোরাক দিতে ৬৫তম বর্ষে রণপা আর জোকার  নিয়ে পুজোমণ্ডপ সাজিয়েছে পশ্চিম পুঁটিয়ারি পল্লী উন্নয়ণ সমিতি। 

নাকতলা উদয়ন সংঘ

মুর অ্যাভেনিউ, নেতাজি সুভাষ রোড ধরে চলে আসুন নাকতলায়। এ বারের পুজো ৩৩ বছরে পড়ল। এ বারের থিম ‘জন্ম’। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে ভেঙেচুরে আবার গড়ে তোলার মধ্যেই মনুষ্যজন্মের সার্থকতা। দশ হাজার মাটির কলস দিয়ে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ।

গড়িয়া-পাটুলি

চলে আসুন গড়িয়া মোড়ের দিকে। গড়িয়া অঞ্চলে কানুনগো পার্ক, শ্রীরামপুর ক্লাব, মিলন পার্ক, যাত্রা শুরু সংঘ ইত্যাদি দেখে চলে আসুন পাটুলি কানেক্টরে।

কেন্দুয়া শান্তি সংঘ

এ বছরে এদের থিম ‘স্মৃতিটুকু থাক’। ছেলেবেলার স্মৃতি সকলের কাছেই প্রিয়। আর দুর্গাপূজার স্মৃতি? সে তো ভোলা যায় না। মণ্ডপেই ছোটাছুটি, বাড়ি ফেরার কথা মনেই থাকে না। এ সব নিয়েই এ বারের ভাবনা ফুটে উঠেছে মণ্ডপে। মণ্ডপের কাজে অভিনবত্ব আছে।

বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলি সর্বজনীন

বাইপাস মোড়ের দিকে আরও এগিয়ে চলুন। ডান দিকে পাটুলির মাঠে এদের পুজো। এই পুজোর থিম যা-ই হোক, পুজোর পরিবেশই এর ইউএসপি। খোলা মাঠে মেলা, আড্ডা, গানের আসর, এ সব নিয়ে জমজমাট এই পুজো।

বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলি উপনগরী স্পোর্টিং ক্লাব

বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলি সর্বজনীন মাঠের ঠিক উলটো দিকের গলিতে পুজো। থিম ‘আমার পাড়া আমার পুজো’। গ্রামবাংলার আবহে উৎসবের আমেজ। সারা মাঠ জুড়ে কৃত্রিম কাশবনের জঙ্গল, কাশবনের মধ্যেই যে মায়ের আবির্ভাব। রয়েছে হাওয়া-কল। মণ্ডপের অন্দরসজ্জায় রয়েছে হাতপাখা, জরি আর কদমফুল। প্রতিমা সাবেক।  

পাটুলি থেকে সেলিমপুর

সেলিমপুর পল্লি

জীবিত আর মৃত মানুষের মধ্যে পার্থক্য আত্মার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি। এই আত্মা হল অবিনশ্বর। তাই শরীরের মৃত্যু হলেও তার মৃত্যু নেই। এক দেহ থেকে স্থানান্তরিত হয় অন্য দেহে। গীতার মতে ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম এই পঞ্চভূতের দ্বারা গঠিত হয় আত্মা। এর সঙ্গে দেবীর দুর্গা আরাধনাকে একাত্ম করে দেখছে সেলিমপুর পল্লি। সেই রকমই তাদের থিমভাবনা। থিমের নাম ‘অন্তঃস্থ শক্তি’। সেলিমপুর বাসস্টপে নেমে গলির ভেতর মণ্ডপ।

যোধপুর পার্ক

ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা শিব। আবার ধ্বংসের দেবতাও তিনি। আর পৃথিবীর যে কোনো কিছুর শেষ ধরে নেওয়া যায় ছাই। সৃষ্টিকর্তার গায়েও ছাই লেপা। প্রাণের সমাপ্তি মানেই হিন্দু ধর্মমতে তা পরিণত হয় ছাইয়ে। আবার স্থাপত্যের ধ্বংস মানেই তার লয় ক্ষুদ্র ধূলিকণায়। তাই দিয়ে তৈরি হয় নতুন সৃষ্টি। সেই ছাই দিয়েই সৃষ্টির শুরু। আজকাল আবার ছাই দিয়ে বানানো হচ্ছে ইট। অর্থাৎ ফ্ল্যাইঅ্যাশ। সেই ইট কাজে লাগছে বাড়িঘর বানানোয়। ঘর মানেই আবার সৃষ্টির আশ্বাস। সব কিছুই যেন কোথায় মিলেমিশে এক হয়ে যায় যোধপুর পার্কের মণ্ডপে। ৬৭তম বর্ষে তাই তাদের থিম ‘স্থাপত্যের শেষ থেকে শুরু’। ঢাকুরিয়ার দিকে থেকে গেলে সেলিমপুর বাসস্টপে নেমে ডান দিকে গলির ভেতর পার্কের ওপর পুজো।

৯৫ পল্লি

৭০তম বর্ষে ‘জাগরণ’। দুর্গাপুজো এখন আলাদা মাত্রা পেয়েছে। এই পুজো আর একটি মাত্র জাতির ধর্মবিশ্বাস হিসাবেই আবদ্ধ নয়। এখন দুর্গাপুজো হল শিল্পের উৎসব। তাই বিভিন্ন ধর্ম, ভাষার মানুষ এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে তা সাংস্কৃতিক চেতনার জন্ম দিয়েছে। সে বিষয়টিকেই  সাংস্কৃতিক জাগরণ আখ্যা দেওয়া হয়েছে ৯৫ পল্লিতে। প্রতিমারও বিশেষত্ব রয়েছে। একই প্রতিমায় কেবল দুর্গা নয়, কালী এবং কৃষ্ণকেও উপলব্ধি করছেন দর্শকরা। ঢাকুরিয়া বাসস্টপে নেমে খানিকটা ডান দিকে যোধপুর পার্কের রাস্তায় কিছুটা ভেতরে মণ্ডপ।

বাবুবাগান

এ বার রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ছেড়ে চলা যাক ঢাকুরিয়ায়। ঢাকুরিয়া বাসস্টপে নেমে বাঁ দিকে রেষারেষি কলহের আবহে বাবুবাগানের এই বছরের থিম ‘শান্তি রূপেণ সংস্থিতা’। দেবী দুর্গাও এখানে শান্তির বার্তা বহন করে এনেছেন। ৫৮তম বর্ষে প্রতি বারের মতো এই বছরও বাঙলার একটি বিশেষ শিল্পকে তুলে ধরা হয়েছে মণ্ডপসজ্জায়। এই বারের শিল্পকর্ম বাঙলার পটের উপর। পটচিত্রের নানান কাজে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ। 

বোসপুকুর শীতলামন্দির

ঢাকুরিয়া থেকে ভিতরে ভিতরে চলে আসুন  রাসবিহারী কানেক্টরের ওপর বোসপুকুর মোড়ে, সেখানেই  শীতলামন্দির। এক সময় ভাঁড়ের মণ্ডপ করে যারা তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, তারা এ বার ৭০ বছরে পড়ল। এ বারের থিম ‘খুঁজে দেখো আপন আলো’। সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য অভিভাবকদের কাছে আবেদন, সন্তানের মৌলিক ভাবনাগুলি বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিন। প্রতিমা ধ্যান্রতা।

বোসপুকুর তালবাগান

বিভিন্ন পাতার কাজ রয়েছে এদের মণ্ডপে।  বোসপুকুর শীতলামন্দিরের কাছেই তালবাগানের মণ্ডপ।

গড়িয়াহাট অঞ্চলে

একডালিয়া এভারগ্রিন

একডালিয়া এভারগ্রিন এ বারে ৭৭-এ। তবে সাবেক প্রতিমার মণ্ডপসজ্জায় থিমের ছোঁয়া না থাকলেও থাকে অভিনবত্ব। সেই অভিনবত্বের রেশ এই বছরেও। হিমাচল প্রদেশের সোলানের নতুন স্থাপত্য জাটোলি শিবমন্দিরকে মণ্ডপের আদলে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। প্রতিমার পরনে আসল বেনারসি শাড়ি। সঙ্গে সোনার গয়না। গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে একডালিয়া রোডে মণ্ডপ।

সিংহী পার্ক

বাঙলার সুপ্রাচীন শিল্প পটশিল্প। মেদিনীপুর-বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার পটশিল্প খুবই সুপরিচিত। আগেকার দিনে কাপড়ের ওপর প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করে এই পটচিত্র আঁকা হত। এখন অবশ্য মাটির বিভিন্ন পট বা পাত্রের ওপরও এই পট আঁকা হচ্ছে। ৭৮তম বর্ষে সিংহী পার্কে সেই পটশিল্পকেই মণ্ডপসজ্জার কাজে লাগিয়েছে। আর বিশেষ আকর্ষণ মণ্ডপের ঝাড়বাতিটি। গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে ডোভার লেনে মণ্ডপ।

হিন্দুস্থান পার্ক

চলে আসুন গড়িয়াহাট মোড়ের দিকে। চলুন রাসবিহারী অ্যাভিনিউ বরাবর। কিছুটা গেলেই মণ্ডপ। এদের থিম ‘রসে-বশে’। ‘নবরস’ নিয়ে কাজ হয়েছে। রয়েছে নয় রকমের রস অর্থাৎ অনুভূতির প্রকাশ। ভরতমুনি নাট্যশাস্ত্রে আট রকমের অনুভূতির কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে রয়েছে শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, অদ্ভুত, ভয়ানক ও বীভৎস। পরে এর সঙ্গে যোগ হয় শান্ত রসও। তখন থেকেই এর নাম হয় নব রস। এই থিম ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নয় রকমের শাস্ত্রীয় নৃত্য, হাতের নয় রকমের মুদ্রার সাহায্যে। 

ত্রিধারা সম্মিলনী

৭৩ বছরে এদের থিম ‘দৃষ্টিকোণ’। মণ্ডপে ঢুকেই দেখা যাবে নানা ধরনের নারীমূর্তি। সেই সব মুখ ক্রমশই মা দুর্গার মুখে পরিণত হবে। শান্তির প্রতীক প্রতিমা ফুলের উপর আসীন। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ট্রাঙ্গুলার পার্কের উলটো দিকে ত্রিধারা।

বালিগঞ্জ কালচারাল

৬৯তম বর্ষে বালিগঞ্জ কালচারালের পুজোর থিম ‘যুগলবন্দি’। ‘যুগলবন্দি’ বলতে আমাদের চার পাশের এমন অনেক কিছুর কথাই মনে পড়ে, যেগুলোকে একে অপরকে ছাড়া ভাবা যায় না। এই পুজোতেও তেমনই বেশ কিছু বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে থিমের মাধ্যমে। গোটা মণ্ডপসজ্জা করা হয়েছে বাঁশের মাধ্যমে। আটটি ভিন্ন প্রজাতির বাঁশ দিয়ে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ।দেশপ্রিয় পার্কের দিকে যেতে ডান দিকে লেক ভিউ রোডে মণ্ডপ।

বালিগঞ্জ সমাজসেবী সংঘ

৭৪ বছরে বালিগঞ্জ সমাজসেবী সংঘ তুলে এনেছে শ্রমজীবী মানুষের কোথা। ওঁদের কুর্নিশ জানানোর পাশাপাশি মায়ের কাছে একটাই প্রার্থনা ওঁদের জীবনে আলো আসুক। মণ্ডপে ফোটো কোলাজের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের জীবনকথা। প্রতিমা সাবেক। লেক ভিউ রোডে মণ্ডপ।

দেশপ্রিয় পার্ক

কলকাতার যে কয়েকটি দুর্গাপুজোয় না গেলে পুজো সফর অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার মধ্যে অন্যতম দেশপ্রিয় পার্কের দুর্গাপুজো। এদের এ বারের থিম ‘চালচিত্র’। মণ্ডপ চালচিত্রের রূপেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।  একচালার প্রতিমা দর্শকের মনেই ভক্তিভাব জাগিয়ে তুলছে। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে  দেশপ্রিয় পার্কে মণ্ডপ।

এ বারের মতো পুজো পরিক্রমা শেষ। ছবি তুলেছেন রাজীব বসু। 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *