নির্জনবিলাসী ঘাটশিলায় ২ / ‘অপুর পথ’ ধরে সুবর্ণরেখা-তীরে

papiya mitra
পাপিয়া মিত্র

ছায়ামাখা পথ টিলা ঘিরে উঠে গিয়েছে। আকাশছোঁয়া বনবীথিকা ইঙ্গিত জানায় কাছে আসার। টিলার মাথায় বুনো গাছের জঙ্গল, বসন্তের হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হতে শুরু হয়। সাঁওতাল উৎসবের পূর্ব সূচনা, বাহা পরবের প্রস্তুতি। ঘাটশিলার ফুলডুংরি তখন মাদলের ছন্দে আর মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে ওঠে। টিলা থেকে দেখা যায় নীচের পথ সরু হয়ে মিশে গিয়েছে বনের মধ্যে। বাহা শব্দের অর্থ ফুল। তাই বাহা উৎসবকে ফুল উৎসব বা বসন্ত উৎসব বলে। ফাগুন মাসের পূর্ণিমা তিথির পর থেকে চৈত্রমাস জুড়ে এই উৎসব চলতে থাকে। সাঁওতাল আদিবাসীরা নিজস্ব ঐতিহ্যকে বরণ করে নেয় বাহা উৎসবের মধ্যে দিয়ে। শাল-মহুয়া-পলাশ ফুলে আদিবাসী রমণীরা সাজিয়ে তোলে নিজেদের।

আরও পড়ুন: নির্জনবিলাসী ঘাটশিলায় ১ / বড়ো মন ছুঁয়ে যাওয়া নাম, ফুলডুংরি

ফুলডুংরি থেকে আমরা চলে এলাম সুবর্ণরেখার ধারে। পথে পড়ল ‘বিভূতি বিহার’ রিসর্ট। পথ তিন কিলোমিটার। সূর্যদেব নিজ অহং জারি রেখেছে সুবর্ণরেখার নীলচে-সবুজ জলে। তটেও তার ব্যাপ্তি। জল-কিনারে পরিচয় হয় সুবর্ণরেখার বড়ো বড়ো শিলার সঙ্গে, চাঁদের আলোয় দূর থেকে মনে হয় যেন হাতি শুয়ে আছে। দূরে পাহাড়প্রাচীর ঘিরে রেখেছে জলকে। কুমারমঙ্গলম সেতুর গা ঘেঁষে হিন্দুস্থান কপারের চিমনির ধোঁয়া বাতাসে ভাসে।

subarnarekha
সুবর্ণরেখা তীরে।

প্রকৃতিকে দু’চোখ ভরে দেখার স্বাদ যেন মিটছে না। প্রকৃতিপথিকের ভিটে দেখার টান আরণ্যকের পাতা ওলটাতে ওলটাতেই। সময় ডাকেনি এত দিন, তাই আসাও হয়নি। রেলপথের সমান্তরাল সুবর্ণরেখা, মাঝে রাজপথ। হঠাৎ পথ নেমেছে ঢাল বেয়ে, ‘অপুর পথ’, লালমাটির। অটো গিয়ে থামল ‘গৌরীকুঞ্জ’-এ। হারুণভাই গেটের ভিতরে যেতে বলল। গৌরীকুঞ্জে অপেক্ষায় ছিলেন ‘গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি’র সভাপতি তাপস চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্যপিপাসু মানুষের ভিড় দেখা গেল। দেখলাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবহৃত নানা জিনিস। জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এখানে। প্রথম স্ত্রী গৌরীর নামে এই বাড়ি। নানা কথা বলছিলেন তাপসবাবু।

half bust of bibhutibhushan
বিভূতি-স্মরণ, গৌরীকুঞ্জে।

শীতের সূর্য, তাড়াতাড়ি অন্ধকার নামে। ডোহিজোড়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ আশ্রম দেখে নিতে হবে। দু’কিমি পথ দ্রুত চলে এলাম। বাকি আছে রনকনী মন্দির। লালচে মন্দির, বিস্তৃত চত্বর। চত্বরের বেশ খানিক জায়গা জুড়ে হাড়িকাঠ। মন্দিরের গর্ভগৃহে তখন সন্ধ্যারতির আয়োজন সম্পূর্ণ। দেবী এখানে অষ্টভূজা কালীমা। দুর্গাঅষ্টমীর আগে জিতাষ্টমীতে বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টমী ও নবমীতে মোষবলি হয়।

সূর্য ডূব দিয়েছে সুবর্ণরেখার জলে। চা পানের জন্য পথের গুমটিতে হানা দেওয়া। পথের ধারে তেলেভাজা। কড়াইয়ের বেগুনির লোভ সামলানো গেল না। ততক্ষণে শীতল বায়ুর পরশ হালুম ডাক ছেড়ে দিয়েছে। রাতে মাংস, রুটি আর অসাধারণ একটি সবজি খেয়ে আমাদের গানের আসর বসল। তিন জনে, সেই স্কুলবেলার সঙ্গী। অনেক পুরোনো কথায় ভেসে যাওয়া। অতিথিদের দেখভালের জন্য শিবানী বড় ভালো ও শান্ত স্বভাবের। পরের দিনের যাত্রাকথা জেনে গেল।

সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে বাগানময়। স্নান সারা, ধোঁয়া ওঠা প্রাতরাশে বসতেই ম্যানেজার অমরেন্দ্রবাবু জানিয়ে দিলেন গাড়ি এসে গিয়েছে। এরটিগা, তিন জনের পক্ষে বিলাসিতার গাড়ি। চালক অবিবাহিত তুফান। বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গেই থাকে। আট কিলোমিটার দূরত্বে গালুডি ড্যাম। মনোরম এই প্রকৃতির মাঝে বহু মানুষ এই শীতসকালে এসে পড়েছে। এক দিকে পাহাড় আর অন্য দিকে শাল-পিয়ালের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা সুবর্ণরেখা। ২১টি স্লুইস গেটের এই বাঁধের নাম গালুডি ড্যাম। রাজ্য সড়ক দিয়ে পৌঁছোলাম জাদুগোড়ায়। এখানেও রনকিনী দেবীর মন্দির তবে বিগ্রহহীন।

dimna lake
ডিমনা লেক।

জামশেদপুর, টাটার নগরীতে ঢোকার মুখে চা-পান। জুবিলি পার্কে ঢোকার আগে টাটা স্পোর্টস কমপ্লেক্স ও কিনান স্টেডিয়াম চোখে পড়ল। জুবিলি পার্কের বিস্তৃতি ও গোলাপবাগিচা মন ভুলিয়ে দিল। শহর থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে, ১১৬টি সিঁড়ি বেয়ে ডিমনা লেক। লেক ঘিরে দলমা পাহাড়। পাহাড় কোলে লেকের জল, প্রতিচ্ছবি ভাসে নীলচে জলে। পড়ুয়ার ভিড় লেকের ধারে। নীচে গাছের ছায়ায় চড়ুইভাতির আয়োজন। ফিরতি পথে ঘাটশিলার রাজবাড়ি দর্শন। দেখভালের দায়িত্বে থাকা সন্তোষ সিং জানান এখন বাড়ির মালিক এক অবাঙালি। বাড়ির পরতে পরতে অবক্ষয়ের চিহ্ন। বাড়ির পিছনে বিশাল আমবাগানের ফাঁকে বিদায়ী সুজ্জি মনে করিয়ে দিল আরও একবার সুবর্ণরেখাকে দেখার জন্য।

গাড়ি খানিক এগিয়ে চলল। ঢাল বেয়ে নেমেছে তট। নির্জন, নিরালায় একাকী সুবর্ণরেখা উপন্যাসের জাল বুনতে ব্যস্ত। তুফানের হাত স্টিয়ারিঙ-এ। বিদায়ী সূর্যের আলোয় আবার আসব সুবর্ণরেখা তোমায় দেখতে অপুর পথ ধরে। (শেষ)

the sun sets at ghatshila কী ভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে ট্রেনে ঘাটশিলা খুব বেশি হলে ঘণ্টা চারেকের পথ। সারা দিনে বেশ কিছু ট্রেন আছে। তবে সব চেয়ে ভালো সকাল ৬.২০-এর হাওড়া-বরবিল জনশতাব্দী বা সকাল ৬.৫৫-এর ইস্পাত এক্সপ্রেস। জনশতাব্দী ঘাটশিলা পৌঁছে দেয় ৯.১২ মিনিটে, ইস্পাত ৯.৫১ মিনিটে। সকাল ১০টায় হাওড়া-ঘাটশিলা মেমু পৌঁছোয় দুপুর ১.৫০ মিনিটে। হাওড়া-মুম্বই রেলপথে টাটানগর স্টেশন থেকে ঘাটশিলা ৩৬ কিমি। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে টাটানগর এসে ট্রেনে, বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে ঘাটশিলা আসা যায়।

৬ নং জাতীয় সড়ক তথা বোম্বে রোড বরাবর কলকাতা থেকে ঘাটশিলার দূরত্ব গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন

ঘাটশিলায় থাকার জন্য অনেক বেসরকারি হোটেল, রিসর্ট আছে। triviago.in, make my trip, goibibo, yatra.com ইত্যাদির মতো ওয়েবসাইটগুলিতে বেসরকারি হোটেলের সন্ধান পাবেন।

স্টেশনের কাছেই রয়েছে সুহাসিতা রিসর্ট। যোগাযোগ ৯৭৭১৮৩১৮৭৭, ০৩৩-২২২৩৪৬৫১। ম্যানেজার অমরেন্দ্র মিত্র। ই-মেল ecbose@vsnl.com ।

রয়েছে ঝাড়খণ্ড পর্যটনের টুরিস্ট কমপ্লেক্স। বুকিং: jharkhandtourism.gov.in ।

ছবি: লেখক

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *