চেনা পথের অচিনপুর: দ্বিতীয় পর্ব/রোদ পোহাচ্ছে কালিপোখরি

Kanchenjungha from Tumling
shounak gupta
শৌনক গুপ্ত

একটা ম্যাগপাইয়ের ডাকে পরদিন ঘুম ভাঙল। জানলার পর্দা সরিয়ে দেখি রাত তখনও শেষ হয়নি। তবে দিগন্তে ক্ষীণ রক্তিমাভাস। আকাশের ট্রেকাররা প্রায় কেউই আর নেই। শুধু কাস্তে চাঁদ আর কয়েকটা তারা যেন পিছিয়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্রমে ওরাও একে একে মিলিয়ে গেল। বাইরে এসে প্রথম দেখলাম কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। তার গায়ে ভোরের আলোর খেলা। যে সিনেমা দেখতে আমরা সান্দাকফুর পথে, টুমলিং-এ রইল তারই ট্রেলার।

আরও পড়ুন চেনা পথের অচিনপুর: প্রথম পর্ব/ মেঘাচ্ছন্ন টুমলিং-এ

আজকের চলার শুরুতেই সিঙ্গলিলা জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ। সিঙ্গলিলা বিলুপ্তপ্রায় রেড পান্ডার বাড়ি। যদিও নিজের বাড়িতেই তার দেখা পাওয়া দায়। তবে তার ঘাটতি পূরণ করে দিল হিমালয়ান মার্টেনের দৌড়ে রাস্তা পার হওয়া আর গাছের ডালে ডালে পাখিদের কর্মব্যস্ততা। টানা উতরাই পথে আলোছায়ার খেলা, কাঞ্চনজঙ্ঘার ইতিউতি উঁকি আর পায়ের তলায় শুকনো পাতার শব্দ আমাদের চলার অক্সিজেন জোগাতে থাকে। পাতা ঝরার সময় এখনও আসেনি, তবে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তাই বনে তখন রঙের বাহার। সিঙ্গলিলা উদ্যানে সেই রঙিন কার্নিভাল দেখতে দেখতে আমরা নেমে এলাম গৈরিবাস।

গৈরিবাস থেকে টুমলিং-এর দিকে তাকালে গাড়ির রাস্তা ছাড়া আরও একটা রাস্তা চোখে পড়ে। অনেক ট্রেকার সে দিক দিয়েও নেমে আসছেন। সেই কাঁচা পথ টুমলিং থেকে নেপালের জাউবাড়ি হয়ে গৈরিবাসে এসে মূল রাস্তায় মিশেছে। এখানে অবশ্য কেউই বেশিক্ষণ কালক্ষেপ করছে না। কারণ এর পরের পথ পার হতে সময় বেশি লাগবে। এখান থেকেই প্রথম বড়ো চড়াইয়ের শুরু। উচ্চতার বদলের সঙ্গে আবহাওয়ার বদলও তাই স্পষ্ট বোঝা যায়। মিঠে রোদের মনোরম গৈরিবাস থেকে শুরু করে আমরা যখন দু’ কিলোমাটার উঠে কায়াকাট্টা পৌঁছোলাম, মনে হল যেন বেলা পড়ে এসেছে। আধো অন্ধকার, চঞ্চল মেঘলা বাতাসে শীতের কঠিন কামড়। অথচ ঘড়ির কাঁটায় মাত্র দুপুর একটা।

বৃষ্টির আশঙ্কায় দ্রুত দুপুরের খাবার খেয়ে আজকের শেষ ল্যাপের পথে এগোলাম। এই পথ সমতল, তাই চলার কষ্ট কম। তবে দৃশ্যমানতা প্রায় শূন্য। পরের পর মেঘের পর্দা সরিয়ে এগোতে থাকি। জনহীন পথে তখন সঙ্গী শুধুই নিজের চলার শব্দ। মাঝে মাঝে এক গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে আসছে। মন বলছে গন্তব্য হয়তো বেশি দূর নয়। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ চলেও যখন পথ শেষ হয় না তখন সেই মন্ত্রকে যেন আরও রহস্যময় লাগে। চার কিলোমিটার পথ যে কত দীর্ঘ তা বোধহয় এই রাস্তাই শেখায়। এই ভাবে পথ শেষ হওয়ার শেষ আশাটুকু যখন ট্রেকার হারিয়ে ফেলে, তখনই সিমবীজের মতো আকৃতির কালো এক পুকুর হঠাৎ দেখা দিয়ে যাত্রার ইতি ঘোষণা করে। প্রেয়ার ফ্ল্যাগে ঘেরা এই পবিত্র পুকুরই কালিপোখরি।

কালিপোখরিকে ঘিরে ধোঁয়ার মতো মেঘ। মণি-দেওয়ালের পাশের অস্থায়ী প্রার্থনাস্থল থেকে মন্ত্রের স্পষ্ট শব্দ ভেসে আসতেই রহস্যভেদ হল। এই শব্দই আমরা শুনেছি উলটো দিকের পাহাড় থেকে। পাহাড়ে আকাশপথের দূরত্ব আর চলার পথের দূরত্বে যে জমিন-আসমান ফারাক, তা ভুলেই গিয়েছিলাম। ট্রেকার্স হাটের জানলার পাশে একটা চেয়ার টেনে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিই। অন্ধকার বিকেল ক্রমে আরও অন্ধকার হয়। প্রায় সন্ধ্যার মুখ পর্যন্ত সেই অন্ধকার ফুঁড়ে একে একে শ্রান্ত ট্রেকাররা কালিপোখরি পৌঁছোতে থাকে। সবাই ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর রাতের দিকে মেঘ কাটল। ডিনার শেষে ঘরের আলো নিভিয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি গত রাতের সেই অগুণতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ট্রেকারেরা নিকষ কালো আকাশে আবারও অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছে।

অভ্যাসমতো ভোর ভোর ঘুম ভাঙলেও একটু দেরি করে লেপ ছাড়লাম। তার কারণ দু’টো। প্রথমত গত দু’দিন যতটা করে হেঁটেছি, আজ হাঁটা তার অর্ধেক। তা ছাড়া কালিপোখরি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাই সূর্যোদয়ের কোনো তাড়া ছিল না। বাইরে এসে দেখি ঝকঝকে নীল আকাশ আনন্দে রোদ পোহাচ্ছে। পোহাবে না-ই বা কেন, এমন আবহাওয়া কালিপোখরির ভাগ্যে আর ক’দিন জোটে। কাল দুপুরে যখন এখানে পৌঁছেছি, কত কী যে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এখন বুঝতে পারছি। দিগন্ত জুড়ে পাঁচিলের মতো দাঁড়িয়ে হিমালয়। বাঁ দিকে দেখা যাচ্ছে নেপালের নতুন ট্রেকিং-স্পট চিন্তাফু। বাঁ থেকে ডানে হিমালয় কখন নেপাল থেকে ভারতে ঢুকে গেছে সাধারণ ভাবে তা বোঝার জো নেই। তবে মানুষেরই তৈরি এক ট্রেকার্স হাট সেই সীমা চিনিয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ের সব চেয়ে উঁচু অংশটার একেবারে মাথায় দাঁড়িয়ে সে, এখান থেকে অবশ্য তাকে খুব ছোটো দেখাচ্ছে। তার নীচে পাহাড়ের গায়ে আঁকাবাঁকা পথের আভাস। শুনেছিলাম আবহাওয়া ভালো থাকলে কালিপোখরি থেকেই সান্দাকফু আর সেই পথের অনেকটা অংশ দেখা যায়। দেখলাম, যা শুনেছি তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।                        

হাঁটা শুরু করতে শরীর গরম হয়ে এল ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতি সর্বক্ষণ শীতের মাত্রা জানান দিচ্ছিল। পথের দু’ধার সাদা হয়ে রয়েছে। সহযাত্রীরা অনেকেই বলছিলেন বটে যে রাতে হয়তো তুষারপাত হয়েছে, কিন্তু এগুলি আসলে ভোরের শিশির হিম হয়ে গিয়ে তৈরি। এখানে পাহাড়ের গায়ে লাইকেনের ওপরেও এমন তুষারকণা জড়ো হয়েছে। রাস্তায় একটা গর্তে জল এমন ভাবে জমে রয়েছে হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন ভাঙা কাচ। এক ঘণ্টা চলে কয়েক ঘর ছোটো দোকান দেখতে পেয়েই ভেবেছিলাম বিকেভঞ্জন পৌঁছে গেছি। পরে জানলাম জায়গাটার নাম চৌরিচক।

বিকেভঞ্জনের দেখা মিলল আরও আধ কিলোমিটার চলার পর। একটা ওয়াচ টাওয়ার আর গুম্ফার লম্বা সিঁড়ি বিকেভঞ্জনকে চিনিয়ে দেয়। এই গোটা ট্রেকরুটে বিকেভঞ্জনের একটা আশ্চর্য উত্তেজনা রয়েছে। এখানে পৌঁছে একজন ট্রেকার যুগপৎ দু’টি অনুভূতির শিকার হয়। সান্দাকফুর ট্রেকার্স হাট এখন যেন আরও স্পষ্ট। কিন্তু সেখানে পৌঁছোতে এ বার পেরোতে হবে এই গোটা পথের সব চেয়ে কঠিন চড়াই। ক্লান্ত শরীরে আবার যেন একটু ভয় চেপে বসে। কিন্তু সেই ভয় অচিরেই কেটে যায় যখন গাইড জানায় আবহাওয়া পরিষ্কার থাকায় আর কিছুক্ষণের মধ্যে চলার সঙ্গী হবে স্বয়ং কাঞ্চনজঙ্ঘা। চায়ের গ্লাসে দ্রুত চুমুক দিতে থাকি। (চলবে)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *