সাহস করে শিকল ভেঙে — দারোন্দার আঙিনায়

Birbhum Daronda
শ্যামলী মল্লিক


পৃথিবীর অসুখ। মনেরও। চারিদিকে শুধু নেতিবাচক সতর্কতা। সদর দরজায় ঝুলছে বড়ো তালা। চরণযুগল সুদীর্ঘ বিশ্রামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার জন্য মুখিয়ে আছে। চড়া বাজারেও তবু যা হোক পেটে জুটছে দু’মুঠো কিন্তু দীর্ঘ অনশনে মনের মৃতপ্রায় অবস্থা।

এমন সময়ে মৌমিতার ডাক, “দারোন্দা যাবে?” শান্তিনিকেতন থেকে আট কিলোমিটার আগে ইলামবাজারে।

মৌমিতা- যার হাত ধরে সত্তর বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কার্তিকস্বামী দর্শন করে, সুউচ্চ লাদাখ পরিভ্রমণ করে, লাক্ষাদ্বীপে ফিনিক্স পাখির মতো এ-দ্বীপ ও-দ্বীপ ঘুরে বেড়ায়। সেই ভরসা আর নির্ভরতার মৌমিতার সঙ্গে, সব রকম সতর্কতা অবলম্বন করে আমরা ১৭ জন একটা এসি ট্রাভেলারে করে বেরিয়ে পড়লাম এক শনিবারের সাতসকালে।

কিছু দূর গিয়ে দুর্গাপুর হাইওয়েতে একটা বড়ো দুর্ঘটনার জন্য বিশাল জ্যাম। অতএব ঘুরপথ। গাড়ি নেমে পড়ল গ্রামের অলিগলি মেঠো পথে। মৌমিতার কপালে চিন্তার ভাঁজ। আমাদের কিন্তু কোনো চিন্তা নেই।

আমরা তো দিব্যি তাজা সবজির বাজার, সরু পথের দু’ধারে চেনা ফুলের সমারোহ আর সবুজ বনানীর ছায়ায় ছায়ায় বেশ আমেজেই ছিলাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট ঘুরপাক খেয়ে আবার গাড়ি উঠল হাইওয়েতে। এর পর শুধুই নির্দিষ্ট গন্তব্য।

ক্রমশ শহুরে ইমারত অদৃশ্য হয়ে শুরু হল কংক্রিট শাড়ির শুভ্র কাশপাড়। যত দূর চোখ যায় কাশের ঢেউ আর কাশের ঢেউ। চোখের আয়নায় উড়ন্ত কাশের শিফন আঁচল, মনের কুঠরিতে অন্ধকার দূর করে আলোর লন্ঠন। শরতের চিঠি এসে গেছে।

কাশঘোর কাটিয়ে উঠে পৌঁছে গেলাম উপাসনা রির্সটে । চিত্রশিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মতো গ্রাম — ছবির মতো রির্সট।

গাড়িতেই প্রাতরাশের পর্ব মিটে গিয়েছিল। তাই স্নান সেরে, ডাল-ভাত-মাছের ঝোল দিয়ে মধ্যাহ্নভোজনের পর কিছুক্ষণের বিশ্রাম। বিকেল চারটের সময় আমরা পৌঁছোলাম অজয় নদের তীরে।

তখন সূর্যাস্তের বিষণ্ণ আলো কাশের বুকে দিনান্তের ক্লান্তিটুকু জুড়িয়ে নিচ্ছে। নদীর জলে কাশ আর রক্তিম কিরণের ছায়া । আমরা বাকরুদ্ধ, মন্ত্রমুগ্ধ। প্রকৃতি দরাজ হাতে তার অতিথিদের আনন্দ বিলোতে ব্যস্ত। আমরাও নিঃসঙ্কোচে তার কাছে সঁপে দিলাম মনের যত অবসাদ।

মনে হল সাহস করে শিকল কাটতেই হয়, তবেই তো মেলে অপার মুক্তি। অদূরে গাছের তলায় চা-ওলার ছাউনি। লিকার চা খেয়ে ফিরে এলাম রিসর্টে। সান্ধ্যআড্ডা জমে উঠল মুড়ি তেলেভাজা আর গরম চায়ের সাথে। একেবারে খাঁটি বাঙালিয়ানা।

গানের সুরে, গল্পের তোড়ে, নাচের ছন্দে বয়স পালাল হার-না-মানার দেশে আর কোভিড নিখোঁজ হল নিরুদ্দেশের পাতায়। সাহস করে শিকল না ভাঙলে কী যে ভুল হত, তা মনে মনে স্বীকার করে নিলাম।

রাত নটায় দিশি চিকেনের ঝোল, নরম রুটি আর লোভনীয় স্বাদের রসগোল্লা সহযোগে ডিনার সেরে যখন ঘরের দিকে পা বাড়ালাম তখন মাথার ওপর তারাদের সাথে অসংখ্য জোনাকি আলো জ্বালাতে ব্যস্ত — জীবনের আলো!

রির্সটের তত্ত্বাবধান করেন মাালিক ও তাঁর স্ত্রী। তাই কোথাও নেই কোনো কৃত্রিমতার ছোঁয়া। তাঁদের নিজস্ব ভাবনায় অনন্যতার মাত্রা পেয়েছে রির্সটটি। পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে কর্মীদের নিবিড় আন্তরিকতা কোনো অতিথিকেই কোনো অভিযোগ জানানোর সুযোগ দেয় না। কোভিডের মোকাবিলা করার জন্য সব রকম সতর্কতাই এখানে অবলম্বন করতে দেখেছি। এ বিষয়ে রিসর্টের কোনো খামতি নেই ।

পর দিন কাকভোরে ছাদে উঠে দেখলাম দিনশুরুর রঙমশাল আলোর হোলি। মেঘের জন্য সূর্যোদয় অধরা থেকে গেল। দিনের আলো পরিষ্কার হতেই আমরা ছুটলাম কামারপাড়ায় লক্ষ্মীসায়র দেখতে।

দারোন্দায় এখন ছোটো বড়ো সব দীঘিই শাপলা শালুক পদ্মে ভরপুর। মহামায়াকে বরণ করতে তারা সম্পূর্ণ তৈরি। এখানে তালগাছে এখনও অনেক তাল মজুত। কত তাল মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। প্রচুর তাল কুড়োনো হল।

লক্ষ্মীসায়র নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আয়নার মতো স্বচ্ছ ও পবিত্র। মাছ আছে বলে এই দীঘির পুষ্পবাহার নেই। ছবি তোলা হল। বটের ঝুড়ি ধরে দোল খেয়ে ফিরে গেলাম আমাদের যৌবনে। বিজ্ঞান প্রয়োজন, প্রকৃতি অপরিহার্য।

পাতাঝরা মাটির পথ পেরিয়ে মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা হয়েই গেল “আবার আসিব ফিরে।”

ফেরার সময় রিসর্টকর্মী পল্লব গ্রুপ ছবি তুলে সকলকে একটা করে ছোটো ছোটো গাছের চারা উপহার দিলেন, মধুর স্মৃতির ফুল ফুটিয়ে যা আজীবন পল্লবিত হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *