দ্য গ্রেট গোয়া ৭ / দুর্গ দেখে মশলার খামারে

স্বপ্ন পাল

পালোলেম সৈকত একদম সমান। কোনো ঢাল না থাকায় সমুদ্রে অনেকটা এগিয়ে গিয়েও কোমরের উপরে জল ওঠে না। বেশি জলের সন্ধানে একটু বেশি দূরে যাওয়ার চেষ্টা করলে লাইফগার্ড বাধা দেয়।  দূরে যাওয়ার উপায় নেই, কাছে থেকে স্নানের মজা নেই। এমন অবস্থায় আমরা পাড়ের দিকেই ভাঙা ঢেউ খেতে লাগলাম।

ঘণ্টাখানেক সমুদ্রস্নান করে উঠে এলাম। এ বার চললাম কাবো দে রাম দুর্গের উদ্দেশে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই আসিফ গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল – সামনেই আগোন্ডা বিচ। ঘুরে আসুন। দেরি করবেন না। আমাদের অনেক বেড়ানো বাকি আছে।

আগোন্ডা সৈকত।

আমি আর সুকুমারদা ছাড়া এই দুপুরের ঠাঠা রোদে কেউ আর গাড়ি থেকে নামতে চাইল না। আমরাই বেরিয়ে পড়লাম। বিচটা কন্ডোলিম আর পালোলেমের সংমিশ্রণ। কন্ডোলিমের মতো এখানে শুধুই বিদেশি, সংখ্যায় যদিও বেশ কম। আর পালোলেমের মতো সাদা বালির বিচ এবং দুই প্রান্তে দু’টো পাহাড়। কয়েক মিনিট এ-দিক ও-দিক ঘুরে কিছু ফটো তুলে আবার গাড়িতে ফিরে এলাম।

কাবো দে রাম দুর্গে যাওয়ার রাস্তাটাও কিছুটা পাহাড়ের উপর দিয়ে। অসাধারণ দৃশ্যপট। কখনও জঙ্গল, কখনও নারকেল গাছের সারি। এসে গেলাম কাবো দে রাম দুর্গের গেটে।

নামে দুর্গ হলেও এটি আসলে দুর্গের কঙ্কাল। কঙ্কাল বললেও অনেক কিছু বলা হয়। বলা ভালো কিছু হাড়গোড় মাত্র। তবুও এই দুর্গ অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার একটাই কারণ। এখান থেকে পাহাড়, সমুদ্র ও নারকেল গাছের এক অসাধারণ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। আর সেটা দেখতেই ট্যুরিস্টরা টাকা খরচ করে এখানে আসে। দুর্গটি ডিরেক্টরেট অফ আর্কাইভ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ গোয়ার অধীনে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, দুর্গের সর্বত্র অযত্নের ছাপ প্রকট। বড়ো বড়ো ঘাস, আগাছায় ভর্তি। আগাছা সরিয়ে সরিয়ে যেতে হয়। দুর্গের প্রাচীরে উঠতে হলে রীতিমতো ঝুঁকি নিয়ে উঠতে হবে। রূপকে কোলে নিয়ে কতটা ঝুঁকি নিয়ে রেলিংবিহীন ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে প্রায় ২০ ফুট উপরে উঠেছি, সেটা ওখানে না গেলে কেউ ভাবতে পারবে না। তবে ঝুঁকির পুরস্কার হিসাবে এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকলাম আমরা।

দুর্গের কঙ্কাল।

Cape Rama থেকে এসেছে Cabo de Rama কথাটা। বলা হয় রামচন্দ্র বনবাসে থাকাকালীন এখানে সীতাকে নিয়ে কিছু দিন ছিলেন। দুর্গটি ছিল হিন্দু রাজাদের। পরবর্তীকালে পর্তুগিজরা এই দুর্গ অধিকার করে নেয়। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এখানে সরকারি কাজকর্ম হত। তার পর এই দুর্গ পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এখনও এর ভিতরে একটা দিকে একটি চার্চ ভালো অবস্থায় আছে।

আমাদের শেষ গন্তব্য স্পাইস গার্ডেন। দেশের বিখ্যাত স্পাইস গার্ডেনগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৯/৮০ সালে প্রায় ৬০ একর জায়গা নিয়ে এই গার্ডেন তৈরি হয়। এই বাগানের আদত নাম ‘সহকারি স্পাইস ফার্ম’। এখানে যে শুধু রান্নার মশলার চাষ হয় তা-ই নয়, বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক গাছের চাষও হয়। আয়ুর্বেদিক ওষুধও তৈরি হয়। সমস্ত বিভাগ মিলে এখানে ২১২০ জন কাজ করেন।

মাথাপিছু ৪০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে বাগানে ঢুকলাম। ভিতরে ঢোকার পর আমাদের ছোটো ছোটো গ্লাসে লিকার চা-এর মতো পানীয় দেওয়া হল। এটি পান করলে নাকি শরীরে এনার্জি আসে। পানীয়ের পর খাবার। পাশেই খাওয়ার জায়গা। বুফে সিস্টেমে খাওয়া চলছে। আমিষ, নিরামিষ, সব রকম পদই আছে। গোয়াতে এসে এই প্রথম স্থানীয় খাবার খেলাম। আমিষ খাবার নিলাম কিন্তু অত্যাধিক মশলা ও মশলার গন্ধে ঠিক তৃপ্তি হল না, তবে পেটটা ভরল।

কলার আস্ত কাঁদি রাখা আছে। ইচ্ছামতো কলা ছেঁড়ো আর খাও। আমরাও খেলাম। এখানে প্রচুর বিদেশি এসেছে। একজনের সঙ্গে আলাপ হল। সে আমেরিকা থেকে এসেছে। আইটি সেক্টরে চাকরি করে। বছরে দু’বার কর্মসুত্রে ভারতে আসে এবং সুযোগ পেলেই সে ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। এটা কয়েক বছর ধরেই তার রুটিন। ভারত তার খুব ভালো লাগে। এখানকার মানুষের আন্তরিকতা তাকে ভীষণ টানে। গোয়া ছাড়াও সে দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু ঘুরেছেন। কলকাতায় আসার খুব ইচ্ছা।

খাওয়াদাওয়ার পর একজন মহিলা গাইড আমাদের বাগান দেখাতে নিয়ে চললেন। কফি গাছ, তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ, জায়ফল, ভ্যানিলা, গোলমরিচ প্রভৃতি গাছ দেখাল এবং তাদের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করলেন। ট্যুরিস্টদের প্রবেশাধিকার মাত্র সাড়ে চার একর জায়গায়। এক জায়গায় গোয়ার বিখ্যাত মদ ‘ক্যাশু ফেনি’ কী ভাবে তৈরি হয় তার ডেমো দিয়ে দেখালেন। কাজু থেকে তৈরি এই পানীয় শুধু মদই নয় ওষুধ হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। বাগান ঘোরা শেষ হয়ে গেলে আবার আগের স্থানে ফিরে এলাম। একটা জালায় খানিকটা ঠান্ডা আয়ুর্বেদিক জল রাখা আছে। ওদের পরম্পরা অনুযায়ী গাইড সামান্য একটু জল হাতায় করে তুলে ঘাড়ের কাছ থেকে শিরদাঁড়া বরাবর পিঠে ঢেলে দিল। সারা শরীর শিরশির করে উঠল। এই জল ক্লান্তি নাশ করে।

মশলার বাগানে।

স্পাইস গার্ডেন ভ্রমণ শেষে গাড়িতে ফিরে এলাম। আজ সুর্যের আলো থাকতে থাকতেই ফেরার পথ ধরেছি। আক্ষরিক অর্থে গোয়া ভ্রমণ শেষ। কালকের দিনটা শুধু হৈ-হুল্লোড় করে কাটাব।

হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বেরোলাম। পায়ে পায়ে মূল সড়কের ধারে চলে এলাম। এখান থেকেই বিচে যাওয়ার রাস্তা। ওই রাস্তার গায়ে আইসক্রিম ও খাবারের স্টল রোজই বসে। একটা স্টলে নতুন ধরনের খাবার প্রস্তুত হতে দেখলাম। প্রচুর মুরগির মাংস একটা সিকে গাঁথা, পাশ থেকে আগুনের হলকা এসে মাংসগুলোকে গ্রিল করছে। সেই গ্রিল করা মাংস ছুরি দিয়ে চেঁছে নেওয়া হচ্ছে। এর পর ওই টুকরো মাংসের সঙ্গে মশলা ও অল্প সবজি মিশিয়ে রুটি বা পাউরুটির মধ্যে ভরে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা আমাদের রোলের মতো কিছুটা। দোকানদারের কাছে নাম জিজ্ঞাসা করে জানলাম এর নাম চিকেন শর্মা, পর্তুগিজ খাবার। ৫০ টাকা করে দাম।

খাবারটা চেখে দেখার উদ্দেশ্যে একটা চিকেন শর্মার অর্ডার দিলাম। খেতে বেশ ভালোই। একটা শর্মা খেলেই পেট পুরো ভর্তি হয়ে যাবে।

আরও কয়েক মিনিট এ-দিক ও-দিক ঘুরে হোটেলে ফিরে চায়ের টেবিলে বসলাম। কিছু ক্ষণের মধ্যেই বাকিরা চলে এল। এ-দিকে আজও ডিজে-র প্রস্তুতি চলছে অর্থাৎ আজ রাতেও কান ফাটানো আওয়াজের মধ্যে খেতে হবে।

রাতে খেতে বসে একটা ঘটনা ঘটল। যে ট্যুর পার্টি ডিজে-র ব্যবস্থা করেছিল তারা পুরো টাকা না মেটানোয় কিছু ক্ষণের মধ্যেই ডিজে বন্ধ হয়ে গেল। তাই নিয়ে শুরু হল তর্ক-বিবাদ। মনে মনে বললাম- যা খুশি হোক গে, বন্ধ হয়েছে এটাই ঢের।  আমরা তো এ বার একটু শান্তিতে খাওয়াদাওয়া করি…। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *