শীতের হিমাচলে ৫/ মণিমহেশের প্রবেশদ্বারে

শ্রয়ণ সেন

কনকনে ঠান্ডা হাওয়া সহ্য করেই এগিয়ে যাচ্ছি মন্দিরের দিকে। রাস্তার ধারে উঁকি মারছে ইতিউতি বরফ। মোবাইলে তাপমাত্রা দেখতে গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ! এই ভরদুপুর বারোটায় তাপমাত্রা বলছে কি না ২ ডিগ্রি! অবশ্য হবে নাই বা কেন। অন্য বার হলে এখন এখানে আসাই যেত না। আবহাওয়া সহায় ছিল বলেই তো আসতে পারলাম।

এই অসাধ্য যে সাধন করতে পেরেছি, তাতে নিজেদের মধ্যে একটা গর্ব ভাব জেগেছে। ৩০ ডিসেম্বর এখানে আসার কথা ভাবাই যায় না বলে জানালেন মদনলালজি। ও, কোথায় এসেছি সেটা তো বলাই হয়নি।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ১ / যাত্রা শুরু বিলাসপুরে

আমরা এখন রয়েছি ভারমৌরে। সমুদ্রতল থেকে ৭,০০০ ফুট উচ্চতার ভারমৌরে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পরে আসা খুব কষ্টকর হয়ে যায়। কিন্তু এ বার সে ভাবে বরফ পড়েনি বলে আমরা আসতে পারলাম।

গতকাল জোত দেখে চম্বা পৌঁছোতে দুপুর হয়ে গেল। সমুদ্রতল থেকে মাত্র তিন হাজার ফুট উচ্চতায় ইরাবতী নদীর তীরে অবস্থিত শহর চম্বা ছিল স্থানীয় রাজপুত রাজা সাহিল বর্মার রাজধানী। ৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারমৌর থেকেই নিজের রাজধানী এখানে সরিয়ে আনেন। চম্বা নামটি এসেছে রাজার মেয়ে চম্পাবতীর নাম থেকে। মন্দির স্থাপত্যের এক অদ্ভুত নিদর্শন পাওয়া যায় চম্বা এবং ভারমৌরে।

চম্বায় আমাদের হোটেল, অর্থাৎ হিমাচল পর্যটনের হোটেল ইরাবতীর অবস্থান একদম শহরের প্রাণকেন্দ্রে। এখান থেকে চম্বার সমস্ত দ্রষ্টব্য স্থানই হেঁটে ঘুরে নেওয়া যায়। হোটেলের ব্যালকনি থেকেই দেখা যাচ্ছে সুবিশাল চৌগান।

চৌগান এবং চম্বা শহর

চৌগান, অর্থাৎ এক বিরাট মাঠ, যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে চম্বা। এই চৌগানই চম্বার পরিচিতি। আমাদের যেমন ময়দান, চম্বার তেমনই চৌগান। এপ্রিল থেকে দশেরা পর্যন্ত এই চৌগানে ভেঙে পড়ে চম্বা। একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। সেই সঙ্গে চলে ক্রিকেট, ফুটবল খেলা, মানুষের মধ্যে আড্ডা ইত্যাদি। বার্ষিক মিঞ্জর মেলাও সাড়ম্বর পালিত হয় এই মাঠে। তবে আমাদের ঢোকার কোনো উপায় নেই। কারণ দশেরার পর থেকে এই মাঠ এখন বন্ধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। আবার খুলবে এপ্রিলে।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ২/ ধৌলাধারের পাদদেশে পালমপুরে

হাঁটাহাঁটি করার পক্ষে আদর্শ শহর চম্বা। ইরাবতী উপত্যকার শহর হওয়ার ফলে মূলত সমতল। চৌগানকে চার দিক দিয়ে ঘুরলে ভালো হাঁটাও হয়ে যায়।

চৌগানের পাশ দিয়ে কিছুটা গিয়ে, ডান দিকের একটা সরু রাস্তা দিয়ে উঠে চলে এলাম চম্পাবতী মন্দিরে। চম্পাবতী মন্দির থেকেই শহরের নাম হয়েছে চম্বা। শিখরধর্মী এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে এক কাহিনি।

চম্পাবতী মন্দির

সাহিল বর্মার ভক্তিমতী কন্যা চম্পাবতী শাস্ত্র পাঠের জন্য গভীর রাতে যেতেন গুরুগৃহে। কন্যার চালচলনে সন্দেহ হওয়ায় রাজা অসি হাতে অনুসরণ করেন। কিন্তু গুরুর আশ্রমে পৌঁছোতেই খেয়াল করেন সেখানে কেউ নেই। শূন্যগৃহে দৈববাণীতে রাজার ভুল ভাঙে, কন্যা ও গুরু দুই লীন। কালে কালে মন্দির হয়েছে সেই গুরুগৃহে। দেবী সিংহপৃষ্ঠে কালো পাথরে ষড়ভুজ মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গারূপী চম্পা বা চম্বা।

চম্পাবতী মন্দিরের পরিচিতি স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও বেশ কম দেখলাম। চম্বার মন্দির বললে সবাই এক ডাকে যেখানে আপনাকে পৌঁছে দেবে সেটা হল লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিররাজি। চম্বার সব থেকে পুরোনো মন্দির। শিখরধর্মী এই মন্দিরগুলি দশম শতকে তৈরি করেন রাজা সাহিল বর্মা। মোট ছ’টা মন্দির বিশিষ্ট এই মন্দির চত্বরে তিনটে মন্দির শিবের এবং বাকি তিনটেয় অধিষ্ঠিত বিষ্ণু।

লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরগুচ্ছ।

লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের পরের গন্তব্য রাজা ভুরি সিংহ সংগ্রহশালা। ১৯০৮ সালে তৈরি হওয়া এই সংগ্রহশালায় মূলত চম্বার শিল্প, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৩/ কাংড়া ফোর্ট দেখে দলাই-ভূমে

একেই চম্বা বেশ বড়ো শহর, তার ওপর ঠান্ডাও বেশ কম। তাই সন্ধ্যা হচ্ছে দেখেও হোটেলমুখী হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। চলল দোকানপাটে ঘোরাঘুরি, টুকটাক খাওয়াদাওয়া। সেই সঙ্গে চোখে পড়ল আরও একটি মন্দির। চৌগানের এক কোনায়, গান্ধী গেট লাগোয়া হরি রাই মন্দির। পর্যটকদের কাছে এই মন্দিরের বিশেষ পরিচিতি নেই বলে এখানে স্থানীয় মানুষেরই পা পড়ে বেশি। এক কথায় চম্বাকে মন্দিরের শহর বললে একটুও ভুল কথা বলা হবে না। তবে এই সাম্রাজ্যের আরও মন্দিরের নিদর্শন পেতে হলে ভারমৌর যাওয়া প্রয়োজন।

পাহাড়ি রাস্তার ছোট্টো বাঁকটা নিতেই চোখের সামনে চলে এল সুবিশাল কৈলাস শৃঙ্গ। এটা মানস সরোবরের কৈলাস অবশ্য নয়, মণিমহেশ কৈলাস। কৈলাস শৃঙ্গের কড়া পাহারাতেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ভারমৌরের দিকে।

সক্কালে চম্বা থেকে রওনা হয়েছি ভারমৌরের উদ্দেশে। ইরাবতীর ধার দিয়ে চলেছে পথ। এই সফরে সব থেকে খারাপ রাস্তা। জায়গায় জায়গায় ধস। তবে বর্ষার কারণে এ ধস যে নয় বোঝা গেল, কারণ বর্ষায় এ বার সে ভাবে বৃষ্টিই হয়নি এখানে। এই ধসের মূল কারণ রাস্তা চওড়া করার যজ্ঞ।

রুক্ষ, ধসাক্রান্ত এই রাস্তার সৌন্দর্য অনেক বেড়ে গেল চোখের সামনে কৈলাস শৃঙ্গ চলে আসতে। ভারমৌর যত কাছে আসছে, তত যেন আরও প্রকট হচ্ছে কৈলাস।

রাস্তা থেকে কৈলাস দর্শন

ভারমৌরের প্রবল ঠান্ডা উপেক্ষা করে এসে পৌঁছোলাম মূল দর্শনীয় স্থানে। চৌরাশি মন্দিরে। এই চৌরাশি মন্দিরকে ঘিরেই ভারমৌর। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে চুরাশি মন্দির নিয়ে তৈরি এই মন্দির চত্বর।

চম্বার আগে ভারমৌর বা ব্রহ্মপুর ছিল সাহিল বর্মাদের রাজধানী। রাজধানী থাকাকালীন সপ্তম শতকের আশেপাশে গড়ে ওঠে এই মন্দিরগুলি। চোদ্দোশো বছর আগে ৮৪টা মন্দির থাকলেও কালক্রমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ্য করে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে ১৫টার মতো মন্দির।

এখানকার মূল মন্দিরটি মণিমহেশ মন্দির। অধিষ্ঠিত শিব। এ ছাড়াও রয়েছে ভদ্রকালী মন্দির, নরসিংহ মন্দির, নন্দী মন্দির, ধর্মরাজ মন্দির এবং গণেশ মন্দির। মন্দির চত্বর থেকে দেখা যাচ্ছে কৈলাসকে। ওই দিকেই তো মণিমহেশ।

চৌরাশি মন্দিরগুচ্ছের প্রধান মন্দির, মণিমহেশ

মণিমহেশের যাত্রা শুরু হয় হাডসার থেকে। ভারমৌর থেকে আরও ১৬ কিমি হাডসার, সেখান থেকে হাঁটা শুরু মণিমহেশের উদ্দেশে। একবার মাথায় এল হাডসার যাওয়া যায় কি না। কিন্তু বাধা সৃষ্টি করল রাস্তা। ভারমৌর ঢোকার মুখেই একটা নির্দেশ দেখলাম যে হাডসারের রাস্তা অত্যন্ত খারাপ। ভারমৌরে রাত কাটানোর পরিকল্পনা থাকলে হাডসার যাওয়া যেত, কিন্তু আমাদের এখন চম্বা ফিরতে হবে যে।

আরও পড়ুন: শীতের হিমাচলে ৪/ জোত পাস, যেখানে হাতছানি দেয় স্বর্গ

মণিমহেশের প্রবেশপথটি দেখার ইচ্ছে কিছুটা অপূর্ণ রেখেই ফিরে চললাম।

কী ভাবে যাবেন

হাওড়া বা দিল্লি থেকে ট্রেনে উঠে নামুন পাঠানকোটে। এখান থেকে চম্বার দূরত্ব ১১৮ কিমি। বাস যাচ্ছে নিয়মিত। দিল্লি থেকেও চম্বার সরাসরি বাস পরিষেবা আছে হিমাচল পরিবহণের। চম্বা থেকে ভারমৌরের দূরত্ব ৫৮ কিমি। বাস পরিষেবা অত্যন্ত ভালো। কিন্তু রাস্তার অবস্থার কথা মাথায় রেখে এই পথটি গাড়িতে পাড়ি দেওয়াই ভালো।

কোথায় থাকবেন

হিমাচল পর্যটনের দু’টি হোটেল রয়েছে চম্বায়। ইরাবতী এবং চম্পক। দু’টোর মধ্যে ইরাবতীই বেশি ভালো। ভারমৌরেও হিমাচল পর্যটনের হোটেল রয়েছে, নাম গৌরীকুণ্ড। এই হোটেলগুলোয় ঘর সংরক্ষণ করতে হলে লগইন করুন হিমাচল পর্যটনের ওয়েবসাইটে (www.hptdc.in)। এ ছাড়াও চম্বা এবং ভারমৌরে অসংখ্য বেসরকারি হোটেলও রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *