শীতের হিমাচলে ৭/ ডালহৌসির প্রবল ঠান্ডায়

শ্রয়ণ সেন

সুভাষ বাউলি দেখে চামেরা লেকের পথ ধরতেই বুঝতে পারলাম, ডালহৌসিতে দু’দিন থাকার পরিকল্পনা বাতিল করে মন্দ কিছু করিনি। সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যেই ডালহৌসির সাইটসিয়িং শেষ। দু’দিন থাকলে একটা দিন নষ্টই হত বলা যায়।

গতকাল রাতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ডালহৌসিতে দু’দিন থাকা নৈব নৈব চ। এই সফরের মধ্যে সব থেকে বেশি ঠান্ডা এখানেই লাগছে। ঠান্ডা বেশি লাগার পেছনে হোটেলের ঘরটাও একটা কারণ।

ডালহৌসিতে আমরা উঠেছি হিমাচল পর্যটনের হোটেল গীতাঞ্জলীতে। ব্রিটিশ আমলের বাড়ি, তাই বিশাল বড়ো বড়ো ঘর। সেই ঘরের ওপরে রয়েছে কাচের জানলা, সেই জানলা দিয়ে ঠান্ডা ঢুকছে ঘরে। সেই ঠান্ডাকে মোকাবিলা করার জন্য যে রুমহিটার দেওয়া হয়েছে সেটা নিতান্তই ছোটো। মূল কথা হল, এই সফরে প্রথমবার মনে হল ঠান্ডা জিতে গেছে আর আমরা হেরেছি। তাই ঠান্ডার বিরুদ্ধে বেশি বিপ্লবী না হয়ে শহর ছাড়াই শ্রেয় মনে হল।

গতকাল খাজিয়ার থেকে  ডালহৌসি, এই ২২ কিমি পথ আমাদের অতিক্রম করতে লাগল দু’ঘণ্টা। সৌজন্য দিন কুড়ি আগের পড়া বরফ। খাজিয়ার থেকে ডালহৌসি রাস্তা গিয়েছে লক্করমান্ডি হয়ে, যেটা সমুদ্রতল থেকে সাড়ে সাত হাজার ফুট উচ্চতায়। কুড়ি দিন আগের তুষারপাতের প্রভাব এখনও রয়ে গিয়েছে ওই রাস্তায়। সেই প্রভাব এতটাই, যে জায়গায় জায়গায় রাস্তা সরু হয়ে গিয়েছে। রাস্তার অল্প পিচ ছাড়া আশেপাশে সব কিছুই বরফে ঢাকা। সেই বরফের জন্য তৈরি হচ্ছে ব্যাপক যানজট।

বরফে বন্ধ যান চলাচল, ডালহৌসির পথে।

যাই হোক, সেই যানজটমুক্ত হয়েই ডালহৌসি পৌঁছোলাম দুপুরের একটু আগে।

ডালহৌসির দু’টো প্রধান কেন্দ্র, সুভাষ চক এবং গান্ধী চক। আমাদের হোটেল সুভাষ চকের কাছে। ট্যুর শেষ হয়ে এলেই, অনেকের মনে হয় কিছু কেনাকাটা করলে ভালো হয়। আমাদের দলেও সেই রকম মানুষ রয়েছে। তাঁদের আবদারে ঠিক করা হল মধ্যাহ্নভোজনের পর গান্ধী চকের কাছে মার্কেটে যাওয়া হবে।

আরও পড়ুন শীতের হিমাচলে ৬/ খাজিয়ারের তুষারচমক

ভাগ্যিস, কেনাকাটার জন্য গান্ধী চকে এলাম, না হলে একজন বিখ্যাত লোকের উত্তরসূরির সঙ্গেই দেখা হত না। কেনাকাটা করার জন্য ঢুকেছিলাম মল মার্কেটের নভেল্টি স্টোর্সে। ছেলে তরুণপ্রীতকে নিয়ে এই দোকান চালান ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ় ইন্দরবীর সিং। ওই দোকানে কেনাকাটার ফাঁকেই নজর গেল দোকানে টাঙানো একটা ছবিতে। ছবিটা তোলা হয়েছিল ১৯৩৭-এর ৫ মে। ছবিতে রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।

নভেল্টি স্টোর্সে নেতাজির ছবি

এই ছবির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই ইন্দরবীর তাঁর পরিবারের সঙ্গে জড়িত গর্বের এক ইতিহাসের কথা বললেন। ১৯৩৭-এ নেতাজি যখন ডালহৌসি এসেছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গী ছিলেন ইন্দরবীরের দাদু গোপাল সিং। তখন গান্ধী চকে দোকান ছিল গোপাল সিংদের, কালক্রমে উত্তরাধিকার সূত্রে নভেল্টি স্টোর্সের মালিক এখন ইন্দরবীর। আমাদের কাছে এই দোকানও ডালহৌসির অন্যতম একটা দ্রষ্টব্য স্থান হয়ে উঠল।

পাহাড়ি শহর হিসেবে ডালহৌসি খুব একটা বড়ো কিছু নয়। গান্ধী চক এবং সুভাষ চককে ঘিরেই এই শহর। তা ছাড়া শহরটা বেশ ছড়ানো ছেটানো, ছিমছাম। গান্ধীচকের এক কোণে রয়েছে সেন্ট জন্‌স গির্জা। পাশেই রয়েছে একটা বসার জায়গা, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে পিরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণি।

গান্ধী চক থেকে সুভাষ চকের রাস্তাটি মল রোড হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়রা এই রাস্তাকে আবার ‘ঠান্ডী সড়ক’ বলে। বোধহয় এই রাস্তায় রোদের দেখা বেশি মেলে না তাই তার এ রকম নাম।

ঠান্ডি সড়ক দিয়ে হেঁটে চলা।

এই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ল মেহর হোটেল। মনে পড়ল, কিছু দিন আগেই জেনেছি যে এই হোটেলে ছিলেন নেতাজি। নেতাজি যে ঘরে থাকতেন সেটা দেখা যাবে, এই আশাতেই কিছু চিন্তা না করেই ঢুকে পড়লাম হোটেলের ভেতর। ম্যানেজারকে নেতাজির ঘর দেখানোর আবদার করতেই তা মিটে গেল। যে ঘরে নেতাজি থাকতেন, সেই ঘরে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন। ঘরটা দেখতে দেখতে এমন সব অনুভূতি হচ্ছিল, যা বলে বোঝানো যাবে না। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দু’বার নেতাজিকে পেয়ে এক মন ভালো করা স্মৃতি নিয়ে ফিরে চললাম হোটেলের উদ্দেশে।

সেই মেহর হোটেল

হোটেলের ঘর পশ্চিমমুখী। সূর্যোদয়ের অসাধারণ সব মুহূর্তে ধরে রেখে দিনাবসান হল ডালহৌসিতে, সেই সঙ্গে বাড়ল ঠান্ডা।

সকাল হতেই অনেকের মধ্যে একটা স্বস্তির ভাব দেখতে পেলাম। অনেকের মধ্যে রাতটা ভালোয় ভালোয় কাটিয়ে দেওয়ার আনন্দ। প্রাতরাশ করে বেরিয়ে পড়লাম। ডালহৌসির দর্শনীয় স্থানগুলি দেখে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাব।

ডালহৌসির প্রধান দ্রষ্টব্য স্থান তিনটে, পঞ্চপুল্লা জলপ্রপাত, সাতধারা এবং সুভাষ বৌলি। প্রথমে দেখলাম পঞ্চপুল্লা এবং সাতধারা, এবং দু’টো জায়গাতেই যথেষ্ট হতাশ হলাম। পাহাড়ের গায়ে সাতটা নল দিয়ে জল পড়ছে, সেটাকেই বলা হচ্ছে সাতধারা। রাস্তার ধারে এই জায়গা যথেষ্ট নোংরা। পঞ্চপুল্লাতে জলপ্রপাতের কোনো চিহ্নই দেখতে পেলাম। সরু হয়ে জল পড়ছে একটা জায়গা দিয়ে, সেটাই মনে হল জলপ্রপাত। তবে এখানেই একটা শহিদ স্মারক রয়েছে, ভগত সিং-এর কাকা, অজিত সিং-এর নামে।

হতাশ করল সুভাষ বাউলিও। ডালহৌসি শহরের একটু বাইরে অবস্থিত সুভাষ বাউলি আসলে একটা প্রস্রবণ। ১৯৩৭-এ নেতাজি প্লুরোসিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হাওয়া পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসকরা তাঁকে ডালহৌসিতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কথিত আছে, ডালহৌসিতে থাকার সময়ে প্রতি দিন নেতাজি এখানে আসতেন আর এই প্রস্রবণের জল খেতেন। এর পরেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন নেতাজি।

সুভাষ বাউলির সেই প্রস্রবণ।

সুভাষ বাউলিকে সংরক্ষণ করার জন্য সরকারি তরফে কোনো উদ্যোগ যে নেই সেটা বোঝা গেল। যেটুকু যা করছে, সেটা হল ভারত বিকাশ পর্ষদ নামক স্থানীয় একটি সংস্থা।

সুভাষ বাউলির পর আমাদের গন্তব্য চামেরা লেক। ডালহৌসিকে বিদায় জানালাম। বানিখেত হয়ে চম্বার দিকে ৩০ কিমি দূরে এই লেক। ইরাবতীর জলকে ঘিরে তৈরি হয়েছে জলাধার। কৃত্রিম হ্রদ, কিন্তু বেশ সুন্দর। চামেরাও নতুন স্পট হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে হিমাচল পর্যটন। সমুদ্রতল থেকে হাজার তিনেক ফুট উচ্চতায় মনোরম পরিবেশে তৈরি হয়েছে হ্রদ। এই হ্রদের ধারে কিছুক্ষণ সময়ে কাটিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল নতুন একটা গন্তব্যের উদ্দেশে।

চামেরা হ্রদ

কী ভাবে যাবেন

হাওড়া বা দিল্লি থেকে ট্রেনে পাঠানকোট পৌঁছোন। সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে ডালহৌসি। পাঠানকোট থেকে ডালহৌসির দূরত্ব ৮১ কিমি।

কোথায় থাকবেন

ডালহৌসিতে থাকার জন্য অনেক হোটেল রয়েছে, নানা দামের নানা মানের। হোটেল বুকিং-এর বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে তাদের সন্ধান পেয়ে যাবেন। হিমাচল পর্যটনের দু’টি হোটেল রয়েছে ডালহৌসিতে। গীতাঞ্জলি এবং মণিমহেশ। অনলাইনে বুক করার জন্য লগইন করুন www.hptdc.in।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *