গাড়োয়ালের অলিগলিতে / প্রথম পর্ব : ধনৌলটি ছুঁয়ে নিউ টিহরী

enchanting view from dhanaulti
tanmoy bhattacharya
তন্ময় ভট্টাচার্য
গাড়োয়ালের প্রবেশদ্বারে

গাড়োয়াল শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আকাশপারে গাড়োয়াল হিমালয়ের বরফাবৃত শৃঙ্গরাজি, আর নীচে দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার বা যমুনার বিভিন্ন উপনদী। স্বপ্নের কাছাকাছি এই অঞ্চলে যাওয়ার জন্য আমাদের পরিকল্পনা প্রায় এক বছরের। ঠিক হল, সুগত বসুর নেতৃত্বে আমাদের ১৯ জনের দল ১৭ অক্টোবর মহাষ্টমীর দিন হরিদ্বারে মিলিত হবে। হরিদ্বারকে গাড়োয়ালের প্রবেশদ্বার বলা যায়। এখান থেকেই শুরু করা যায় গাড়োয়াল হিমালয় ভ্রমণ। সেইমতো বিমানে দমদম থেকে দিল্লি, সেখানে রাত কাটিয়ে পরের দিন ভোরে দেরাদুন শতাব্দী ধরে সাড়ে এগারোটা নাগাদ হরিদ্বারে পৌঁছে গেলাম।

আরও পড়ুন ‘লাল কাঁকড়ার দেশ’- তাজপুর

হরিদ্বার বা হরদুয়ার, হরির দ্বার আর হরেরও দ্বার। হর-কি-পউড়ি ঘাট এর প্রাণকেন্দ্র। আমাদের হোটেলের নামও হোটেল হর কি পউড়ি। একদম ঘাটের পাশে। আরও অনেক হোটেলই ঘাটের আশেপাশে আছে। তবে গঙ্গা লাগোয়া হোটেলগুলির রেট খুব চড়া। স্টেশন থেকে এই সব হোটেলে পৌঁছোতে অটো বা টোটো ভরসা। নো এন্ট্রির ভয় দেখিয়ে প্রথমেই অনেক ভাড়া চাইবে, দরাদরিতে কমবে। নিরমিষ খাবার। তবে হৃষীকেশের দিকে রাস্তায় কিছু আমিষ খাবার পাওয়া যায়। খাবারের মান খারাপ নয়, তবে দাম বেশি। জনপ্রতি ১০০-১২০ টাকা লাগবেই এক এক বেলা খেতে।

har ki pauri
হর-কি-পৌড়ি।

আমরা হরিদ্বার পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম ঘাট দেখতে। ঘাটে পৌঁছোনোর জন্য ব্রিজ আছে, ব্রিজ থেকে ঘড়িঘর দেখা যায়। ঘাটে পৌঁছে মাথায় গঙ্গাজল নিলাম। এখানে মূল গঙ্গা নয়, রয়েছে গঙ্গার একটি ধারা, কৃত্রিম চ্যানেল দিয়ে দ্রুত বয়ে চলেছে। দূরে মহাদেবের সুউচ্চ মন্দির। এখানেই বিকেলে আরতি ও পূজাপাঠ হবে।

ইচ্ছা হল কঙ্খল যাওয়ার। ২৫০ টাকায় অটো ভাড়া করে আমরা ৫ জন চলে গেলাম সেখানে। কঙ্খল শহরের দক্ষিণে। এখানকার দ্রষ্টব্য দক্ষেশ্বর মহাদেব মন্দির, সতীকুণ্ড, মা মনসা মন্দির, আনন্দময়ী মায়ের মন্দির ইত্যাদি। আমাদের প্রথম গন্তব্য দক্ষেশ্বর মহাদেব। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। দক্ষযজ্ঞের স্মরণে নিবেদিত এই মন্দির। পাশেই সতীকুণ্ড (বলা হয় এখানেই সতী জীবন ত্যাগ করেন) ও মা মনসা মন্দির। সেখান থেকে একটু এগিয়ে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম। বাঙালি অধ্যুষিত এই আশ্রমে ঢুকলে মন শান্তিতে ভরে যায়।

dakkha temple
দক্ষ মন্দির।

কঙ্খল থেকে ফিরে এলাম হর-কি-পউড়িতে। সিগাল জাতীয় কিছু পাখির খানিক আনাগোনা দেখে আসন গ্রহণ করতে হল ঘাটের ঠিক উলটো দিকে। ভালো ভিড় এর মধ্যেই। পূজার সময় গোনা শুরু। উলটো দিকের ঘাটের সিঁড়িতে বসে গঙ্গাপূজা দেখতে লাগলাম। সাড়ে পাঁচটা থেকে আধ ঘণ্টা মতো পূজাপাঠ হওয়ার পর শুরু হল আরতি। এর মধ্যে অনেকেই পাতার ভেলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভুতি। কম করে ১০ জন পুরোহিত ১৫ মিনিট ধরে গঙ্গামায়ের আরতি করলেন। সঙ্গে ঘণ্টাবাদন ও স্তোত্রপাঠ পরিবেশকে ভাবগম্ভীর করে তুলল। ‘জয় গঙ্গা মাইয়া’ ধ্বনি দিয়ে আরতি শেষ হওয়ার পর আর বিশেষ কিছু করার ছিল না, হোটেলে ফিরে পরের দিনের প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া। দুঃখ একটাই, আমাদের এই ভ্রমণসূচিতে হৃষীকেশ নেই, তাই রামঝুলা, লক্ষণঝুলা পরের বারের জন্য তোলা থাকল। তবে হরিদ্বার বা দেরাদুনে দু’ দিন থাকলে হৃষীকেশ দেখে আসা সম্ভব।

গাড়োয়াল-সুন্দরী ধনৌলটি

পরের দিন সকাল ৮ টায় হরিদ্বার থেকে টেম্পো ট্রাভেলারে চেপে দেরাদুন হয়ে চললাম ধনৌলটি। দেরাদুন পেরোতেই চড়াই শুরু। তার আগে রাস্তায় প্রাতরাশ সেরে নিলাম। ধনৌলটির খ্যাতি লালিগুরাস বা রডোডেন্ড্রন-সহ বিভিন্ন ফুল ও দিগন্তবিস্তৃত বরফাবৃত পর্বতমালা দর্শনের জন্য। প্রায় চার ঘণ্টা সড়কযাত্রায় আমাদের উন্মাদনা তুঙ্গে, সঙ্গে চলছে নতুন স্বপ্ন বোনা। পথিমধ্যে হনুমানকুলকে বাই বাই করে, অজস্র বার ছবি তুলে আমরা পৌঁছোলাম ধনৌলটি ইকোপার্ক সংলগ্ন ‘আওয়ারা ক্যাম্পে’। এই ‘আওয়ারা ক্যাম্প’ আজ আমাদের ঠিকানা। রাস্তা থেকে প্রায় ৫০০-৬০০ ফুট নীচে পর পর তাঁবু খাটানো। কিন্তু নামা-ওঠার পথটি বিপদসঙ্কুল। পথটি বেশ খাড়া, সাবধানে না নামলে স্লিপ করে পড়ে চোট লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়ানোছেটানো তাঁবুর সারিতে পৌঁছে যাওয়ার পর মজাই আলাদা। কনকনে ঠান্ডা। চারিদিক খোলা, তাই ঠান্ডা হাওয়ার দাপট খুব। ১৮০ ডিগ্রি খোলা অঞ্চলে হিমালয়ের তুষারাবৃত শৃঙ্গরাজি দর্শন দেবে আমাদের।

আরও পড়ুন কুমারী সৈকত চাঁদপুরে একটা দিন

এক ধাপ উঁচুতে এদের রান্নঘর। বুকিং-এর সময়েই জনপ্রতি থাকা-খাওয়া খরচ এক সঙ্গে দেওয়া আছে। সুন্দর পানীয়র মাধ্যমে স্বাগত জানানো হল। অনেকটা নামার কষ্ট এক নিমিষে উধাও। দুপুরের খাওয়া ভালোই ছিল। খাওয়া শেষে যে যার তাঁবুতে গিয়ে হালকা বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে কেউ কেউ দর্শন দিলেন আমাদের। শ্রীকান্ত, গঙ্গোত্রীর তিনটি চূড়া ও থলয়সাগর আমাদের দর্শন দিলেন। সোনালি আবিরের খেলায় মেতে উঠল দিগন্ত। অবগুণ্ঠন খুলে ধীরে ধীরে স্বপ্নপুরী বানিয়ে ফেললেন হিমালয়। দোলনা খাটানো ছিল। সেখানে বসে দোল খেতে খেতে সূর্যাস্তের পর্বতমালা দর্শন যেন শুরুতেই জানিয়ে দিল কী হতে চলেছে এই ভ্রমণ। এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু ‘আওয়ারা ক্যাম্প’ আমাদের জন্য ক্যাম্পফায়ার, নাচগানের আয়োজন করে ওই ঠান্ডার রাতকে আরও মায়াবী করে তুলল।

রাতে ঠান্ডা ভালোই ছিল। কিন্তু রাত কাটতেই যে দৃশ্য চোখের সামনে এল তা ভুলিয়ে দিল সমস্ত কষ্ট। হিমালয়ের দিগন্তবিস্তৃত শৃঙ্গরাজি খানিকক্ষণের জন্য সবার সামনে আবার উন্মুক্ত হল। কিন্তু বিধি বাম। বেশিক্ষণ থাকলেন না তাঁরা। চলে গেলেন মেঘের আড়ালে। যেন লুকোচুরি খেলা। আমরাও আর তাঁদের জন্য অপেক্ষা করতে পারলাম না। একটু পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে টিহরির উদ্দেশে। প্রাতরাশ সেরেই শুরু হল পরের গন্তব্যে যাওয়ার প্রস্তুতি।

more view from dhanaulti
ধনৌলটি থেকে আরও দৃশ্য।

৫০০-৬০০ ফুট খাড়া পথ ভেঙে ফের ওপরে উঠে আসা সহজ ছিল না, বিশেষ করে বয়স্কদের। তার ওপর খাড়াই পথে পা হড়কে যাওয়ার ভয় থাকে। ভালো গ্রিপের জুতো পরে আসা আবশ্যক। আমার স্ত্রী-কন্যা দ্রুত উঠে গেল। মালপত্র নিয়ে চলে গেল ক্যাম্পের লোকজন। আমি মিনিট ১৫ সময় নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। রাস্থার পাশেই গাড়ি রাখা ছিল। শুরু হল আবার সড়কযাত্রা। একটু এগোতেই রাস্তার ধারে পাইনের সারি জানান দিল এটাই ধনৌলটি ইকোপার্ক। এখানেই পাইনের সারির ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি ঝলমলিয়ে ওঠে। ব্যাকগ্রাউন্ডে পর্বতরাজি। যেন এক স্বপ্নপুরী।

মোহময়ী টিহরী

প্রায় ঘণ্টা তিনেক চলার পর চাম্বা পেরোতেই এক দিকে এঁকেবেঁকে ভাগীরথী। এখানে ভাগীরথীর ওপর বাঁধ হয়েছে। এই বাঁধ নিয়ে তো অনেক সংগ্রামের কাহিনি, সে সব শুনলাম স্থানীয়দের কাছে। পুরাতন টিহরী এখন বসবাসের অযোগ্য। বাঁধ তৈরির ফলে যাঁরা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তাঁদের নিয়েই একটু ওপরে তৈরি হয়েছে নতুন টিহরী। এখানে ছোটো একটি জলধারা ভাগীরথীতে মিশেছে। এবং জলাধারকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক সুন্দর লেক। জলের গতি বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এখানে ভাগীরথী ধীরস্থির। কিন্তু চারিদিকে সুউচ্চ পর্বতমালা লেকের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে। আমাদের দলের বেশির ভাগেরই জায়গা হোটেল মনার-এ। ১২০০ টাকা ঘরভাড়ায় এখানে প্রায় সবাই থাকলেও দু’টি পরিবারের জন্য অন্যত্র ব্যবস্থা করতে হবে। গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের সুন্দর কটেজ আছে। তৈরি হয়েছে ভাসমান কটেজও। সেগুলি লেকের ওপরে ভেলায় ভাসমান। পারে যাতায়াতের জন্য নৌকা আছে। কিন্তু সবেরই দাম আকাশছোঁয়া। গেলাম টিহরী হাইড্রো ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন কিমিটেডের অতিথিনিবাসে। এখানে থাকার ঘর পাওয়া মুশকিল, কিন্তু ফাঁকা থাকলে দিয়ে দেয়। ভাগ্যক্রমে দু’টি ঘর পাওয়া গেল। ভাড়া ২৫০ টাকা করে। সব চেয়ে সস্তা, কিন্তু সুন্দর। ঘরগুলি সাজানো, একেবারে নদীর পাশেই। সামনে বিস্তৃত খোলা অঞ্চল, পেছনের ফুলের বাগানের পাশেই ভাগীরথীর বহমান ধারা এবং একটু দূরে বাঁধ। যেন এক স্বর্গীয় অনুভুতি। সকলের খাওয়া কিন্তু হোটেল মানাআরে। হোটেল মানাআর থেকে দৃশ্য একটু আলাদা। অনেকটা পাখির চোখের দৃশ্য। কিন্তু দু’ জায়গা থেকেই সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়।

বিকেলে গেলাম জলক্রীড়ায়। এখানে বোটে করে ভাগীরথীর এ-পার ও-পার করায়, আধ ঘণ্টা জনপ্রতি ৪০০ টাকায়। এ ছাড়া রয়েছে ওয়াটার স্কুটারও। দাম একটু চড়া। ছাউনিদেওয়া সাধারণ মোটরবোটে লেকতুল্য নদীতে এ-পার ও-পার করে পড়ন্ত সূর্যালোকে টিহরীকে অবলোকন করলাম।  মোহময়ী টিহরী যেন মায়ালোকে পরিণত। সূর্য ডোবার সাথে সাথে ঠান্ডা বাড়তে লাগল। তাই অন্ধকার হতেই সবাই ঘরবন্দি হয়ে গেলাম। কালকের গন্তব্য উত্তরকাশী। (চলবে)

ছবি লেখক 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *