পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৫/ নবী হয়ে ফের গুনজিতে

সুব্রত গোস্বামী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আজ ২ আগস্ট। ভোর ৪টেয় উঠে রেডি হয়ে গেলাম। বোর্নভিটা বিস্কুট দিয়ে চা-পর্ব সাঙ্গ হল। বাইরে এখনও গাঢ় অন্ধকার। হেড টর্চ মাথায় লাগিয়ে বাইরে এলাম। আজকের গন্তব্য ১৭ কিমি দূরের গুনজি বেস ক্যাম্প। প্রতি দিনের মতো শিবের ভজন গেয়ে যাত্রা শুরু হল।

সামনেই বিশাল পাহাড়। এই পাহাড় টপকে যেতে হবে আমাদের। যাত্রার শুরুতেই চড়াই, পাহাড়ে সিঁড়ির পর সিঁড়ি। যত ওপরে উঠছি, ততই হাঁপ ধরছে। রাতে বৃষ্টি হয়েছে, পথ অসম্ভব পিছল। প্রতি মুহূর্তে ধরাশায়ী হওয়ার আশঙ্কা। হাতের লাঠিই ভরসা। গণেশ অবশ্য পাশেই রয়েছে, অভয় দিয়ে যাচ্ছে – “স্যর আর একটু, ওই দেখুন পাহাড়ের চূড়া, ওটাই ছায়লেক। তার পর আর চিন্তা নেই। রাস্তা খুব ভালো।”

এই পথেই চলেছি গুনজি।

সাথি তীর্থযাত্রীরা অনেকেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে এগিয়ে চলেছেন। বেশির ভাগই বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোটো। এঁরা কষ্ট করতে চান না। এঁদের অনেকেই চলেছেন পাহাড়-জয়ের মানসিকতা নিয়ে। কিন্তু পাহাড় তো জয় করার নয়। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই আমাদের জীবনের চড়াই-উতরাই পার হতে শেখায়। ঘণ্টাদুয়েক পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেলাম। পিছনে ফেলে এসেছি বুধি। এখান থেকে বুধির ক্যাম্প দেশলাই বাক্সের মতো লাগছে।

ছায়লেক-এ পৌঁছে চমকে গেলাম। সামনেই ঝকঝক করছে বরফাচ্ছাদিত মাউন্ট অন্নপূর্ণা। তার পিছনে সূর্যদেব উঁকি মারছেন। সূর্যের আলোর ছটা মনের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল তুলল। পাহাড়ের চূড়ায় সোনালি রোদ, ঈশ্বরের কী অপরূপ সৃষ্টি! এই শান্ত মায়াবী পরিবেশে মন আরও মোহময় হয়ে উঠল। এখানে সামান্য সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি। প্রাতরাশ সারা হল। আইটিবিপি-র জওয়ানরা আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করলেন।

আবার এগিয়ে চলা। পিছনে পড়ে রইল মাউন্ট অন্নপূর্ণা। ইশ্বরের অশেষ করুণা, তাই এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ হচ্ছে আমার। ক’জনের ভাগ্যে এই সুযোগ ঘটে। কারও হয়তো অর্থ আছে, কিন্তু এখানে আসার মতো শরীর নয়। আবার কারও হয়তো স্বাস্থ্যের কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। কারও আবার অর্থ আর স্বাস্থ্য, দুই-ই আছে, কিন্তু ঈশ্বরের কৃপা নেই।

আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৪/ ফুলের উপত্যকা ছাড়িয়ে বুধিতে

পাহাড়ের রাস্তা ছেড়ে এ বার কালী নদীর পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। নদী এখানে অনেকটাই শান্ত। মাঝে মাঝে নদীর জল আমাদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই উপত্যকাতেও প্রচুর ফুল ফুটে আছে। বছরের চার মাস এরা চার দিক আলোকিত করে রাখে। বাকি সময়টা বরফের নীচে চলে যায়। নদীর ধার ছেড়ে আবার চড়াই ভাঙতে শুরু করলাম। পথে পড়ল গার্বিয়াং গ্রাম। এখানে চা পান করে আবার হাঁটা শুরু হল। এ-দিক ও-দিকে ছড়িয়ে আছে ভূমিকম্পে ধ্বংসের কিছু চিহ্ন।

পথেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা। গণেশকে সেই খাবার দিয়ে আমি এগিয়ে চললাম। কম খেলেই আমি ভালো থাকি। বড়ো বড়ো পাথর আর কাঁটাগুল্মে ভরা দৈত্যাকৃতি বিশাল বিশাল গাছের পাশ দিয়ে একা হেঁটে চলেছি। দু’ ধারে নিবিড় বনানী। কত ধরনের লতা আর বন্যফুল। বন্যপ্রকৃতি এখানে তার সবটুকু সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছে। আমি মুগ্ধ, বাক্যহারা। পেরিয়ে এলাম কালী আর টিংকার নদীর সঙ্গম।

গুনজি বেস ক্যাম্প যাওয়ার পথে।

দূর থেকে গুনজি বেস ক্যাম্প দেখা গেল। গুনজি ক্যাম্প দেখতে পেয়ে মনটা আনন্দে ভরে গেল। নদীর ও পারে ইগলুর মতো ফাইবারের কিছু ঘর। পাশেই আইটিবিপি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। কালী নদী পেরিয়ে যেতে হবে। পারাপারের জন্য রয়েছে দড়ির ঝুলন্ত সেতু, অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সেতুতে উঠতেই ভীষণ দুলতে লাগল। কোনো কোনো কাঠের পাটাতন ভেঙে গিয়েছে। নীচে কালী নদীর ভয়ংকর রূপ। প্রভুর নাম জপতে জপতে পেরিয়ে এলাম নদী। অল্প চড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম বেস ক্যাম্পে।

ক্যাম্পে ঢুকে দেখি মনীশভাই প্রথম ঘরেই আমাদের জন্য্য জায়গা রেখে দিয়েছেন। জহরভাই আর সুরজভাই এসে গিয়েছেন। একটু পরেই চলে এল শরবত। শরবতের পরেই এল স্যুপ। গরম গরম স্যুপ খেয়ে শরীরটা চাঙ্গা হল। সন্ধেবেলায় আইটিবিপি-র ডাক্তারবাবুরা কিছু পরামর্শ দিলেন। ডায়ামেক্স নামে একটা ওষুধ সকলকে খেতে বললেন। তা ছাড়া প্রচুর জল খেতে বললেন।

কাল আমরা ৩ কিমি দূরের নবীগাঁও যাব। শরীরকে প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য একটা পুরো দিন সেখানে থাকব। পরের দিন ফিরে আসব গুনজিতে। এখানে আমাদের মেডিক্যাল টেস্ট হবে। সেই টেস্টে যাঁরা ফিট সার্টিফিকেট পাবেন, তাঁরাই সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাবেন। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। দু’ দিন কোনো যোগাযোগ নেই। কবে আবার ফোন করতে পারব, কে জানে।

নবীগাঁও যাওয়ার পথে।

৩ আগস্ট। আজ আর ওঠার কোনো তাড়া নেই। নবীগাঁও যাওয়ার জন্য ৮টায় বেরোতে হবে। এখানকার অধিবাসীরা রঙ-লো ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষায় নবী মানে পাঁচ। পাঁচ পাহাড়ের মাঝে এই গ্রাম, তাই নবীগাঁও। বেরোতে বেরোতে সাড়ে ৮টা বাজল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নবীগাঁওয়ে।

গ্রামের মানুষজন তাঁদের চিরাচরিত পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে তাঁদের বাদ্যযন্ত্র, ফুল-চন্দন আর শরবত। বাজনা বাজিয়ে, কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে, হাতে ফুল দিয়ে আর শরবত পান করিয়ে আমাদের স্বাগত জানালেন তাঁরা। তাঁদের এই আতিথেয়তা ভোলার নয়। পাথর দিয়ে তৈরি এদের ঘরবাড়ি। ভিতর দিকে মাটির প্রলেপ। একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মেঝের উপর ম্যাট্রেস পাতা, আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জাতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটল। তাঁদের নাচ-গান মন ভরিয়ে দিল।

নবীগাঁওয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

নবীগাঁও গ্রামটা ছোট্ট। ১০৫টি পরিবার এখানে থাকে। যদিও ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে এই গ্রামের জনসংখ্যা ৩২। তাই সরকারি হিসেবে গ্রামের জনসংখ্যা ৩২ হলেও, বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা ৫৪০ জনের মতো। স্থানীয় মানুষ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। কৈলাস-মানস যাত্রার তিন মাস এঁরা মেতে থাকেন যাত্রীদের নিয়ে। সরকারি সাহায্য এখানে তেমন আসে না। স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও এই গ্রামে কোনো স্কুল নেই, নেই কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বিদ্যুতের খুঁটি আছে, কিন্তু আলো নেই। নদীর জলই এঁদের ভরসা। আধুনিক সভ্যতার জগৎ থেকে এঁরা বহু দূরে। গ্রামের মধ্যে অবস্থা যাঁদের একটু ভালো, তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়তে যায় ধরচুলায়। বুধি হয়ে ধরচুলা দু’ দিনের পথ। কাউকে ফোন করতে হলে যেতে হয় ৪ কিমি দূরের সেনাশিবিরে। বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে ফোন করা যায়, দু’ মিনিটের জন্য। এত অসুবিধার মধ্যেও এই গ্রামের ছেলে আইএএস, আইপিএস, জজ ইত্যাদি হয়েছে। গ্রামের কোনো উৎসবে এঁরা দল বেঁধে আসেন শিকড়ের সন্ধানে।

রাতের খাবার খাওয়া হল। পঞ্চায়েত প্রধান সনমদিদির নেতৃত্বে গ্রামের মহিলারা এই খাবার বানিয়েছেন।সকালে যখন বিদায় নিচ্ছি, সনমদিদির দু’ চোখে জলের ধারা। সত্যি, এঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। এঁরা যে সত্যিই অতিথিদের দেবতা বলে মনে করেন।

গুনজির ক্যাম্প।

১০টা নাগাদ ফিরে এলাম গুনজির ক্যাম্পে। আবার মেডিক্যাল টেস্ট হল। আলাপ হল ডা. চক্রবর্তীর সঙ্গে। কলকাতা থেকে এসেছি শুনে নিজেই এসে আলাপ করলেন। ডা. চক্রবর্তী বর্তমানে লে-লাদাখে কর্মরত। আমাদের সঙ্গে যাবেন লিপুলেখ পাস পর্যন্ত। এই যাত্রায় সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে আমাদের ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। দুপুরের মধ্যে সকলের মেডিক্যাল টেস্ট হয়ে গেল। আমার তো অদ্ভুত কাণ্ড। যাত্রার আগে দিল্লিতে আমার প্রেসার ছিল ১৩৫/৮৫, আর এখানে এখন ১২০/৮০। এ কি সবই ঈশ্বরের লীলা? রাজস্থান থেকে আগত এক যাত্রীকে ফিরে যেতে হবে। ওঁর হার্টের অবস্থা এই যাত্রার অনুমতি দিল না। প্রভু কৃপা না করলে যে কৈলাস-মানস পরিক্রমা করা যায় না, তা আবার বুঝলাম।

দুপুরে একটু বিশ্রাম করে ছুটলাম সেনাশিবিরে। দু’ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে এক মিনিট বাড়ির সঙ্গে কথা বলতে পারলাম। মাউন্ট অন্নপূর্ণা যেন গুনজি ক্যাম্পের সঙ্গে লেপটে আছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আকাশে মেঘ ছিল। হঠাৎ দেখলাম মেঘ কেটে যাচ্ছে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় অন্নপূর্ণার শীর্ষ আলোকিত। মনে হচ্ছে পাহাড়ের চূড়ায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বরফের উপর সূর্যের আলো পড়ে পুরো পর্বতশীর্ষ রাঙিয়ে দিয়েছে। (চলবে)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *