পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৬/ লিপুলেখ দিয়ে তাকলাকোটে

সুব্রত গোস্বামী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৫ আগস্ট। আজ চলেছি কালাপানি, ১০ কিমি। সকালেই বেরিয়ে পড়লাম, সাথে জহরভাই আর সুরজভাই, আমার প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী। পাহাড়ি পথের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি। একটি পাকদণ্ডি পথ অতিক্রম করতেই এক সুবিশাল শৃঙ্গ চোখে পড়ল। এতক্ষণ রোদ ঝলমল করছিল শৃঙ্গটি, সহসা দেখলাম কোথা থেকে এক খণ্ড মেঘ ভেসে এল। জলভারে নত মেঘ পর্বতচূড়ায়। পর্বতচূড়ায় মেঘাবরণ, কিন্তু আকাশ রৌদ্রোজ্জ্বল। চার  দিক ভাসছে সোনালি রোদে।

কখন যেন একা হয়ে গিয়েছি, খেয়াল করিনি। আমার দুই সঙ্গী পিছিয়ে পড়েছে। জনমানবশূন্য প্রান্তর দিয়ে হেঁটে চলেছি। দূর থেকে চোখে পড়ল বশিষ্টমুনির গুহা। এই সব মুনি-ঋষির যে দৈবিক ক্ষমতা ছিল, তা এই গুহা দেখলেই বোঝা যায়। সামনে পড়ল দু’টি সেতু। সেতু পেরোতেই একটি সুন্দর মন্দিরপ্রাঙ্গণে উপস্থিত হলাম। শ্বেতশুভ্র মন্দিরটি দেখে দেহের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এই মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে কালী নদীর উৎপত্তি। তাই এই জায়গাটির নাম কালাপানি। মন্দিরে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। পূজারি আমার হাতে কমণ্ডলুটি দিয়ে বললেন, “অব পানি চড়াইয়ে”। কিছুটা জল ঢেলে কমণ্ডলুটি তাঁর হাতে দিলাম। তিনি বাকি জল শিবের মাথায় ঢেলে বললেন, হর হর মহাদেব। পূজারিজির মন্ত্রধ্বনিতে মন্দির গমগম করতে লাগল। আমি রোমাঞ্চিত। বেদমন্ত্র জপ করতে লাগলাম।

kali river
কালী নদীর উৎপত্তিস্থল।

প্রসাদ হাতে একটু সামনে এগোতেই দেখি চেকপোস্ট। আমার পাসপোর্ট পরীক্ষার পর এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। আইটিবিপি-র ক্যাম্প ছাড়িয়েই কেএমভিএন-এর অতিথিশালা। চারিদিকে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি, মাঝে ছোট্ট এক ফালি জায়গায় আমাদের রাত্রি-আবাস। যথারীতি শরবত খাইয়ে অভ্যর্থনা। গরম জলে স্নান করে শরীর অনেক চাঙ্গা হয়ে উঠল।

বৃষ্টির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে। ৮টা নাগাদ বৃষ্টি একটু কমতেই আমরা রওনা দিলাম। আজ আমাদের গন্তব্য ৯ কিমি দূরের নাবিডাং, উচ্চতা ১৩৯৮০ ফুট। প্রথমেই অনেকটা চড়াই। আজ আমার সঙ্গী আমার পুত্রসম গণেশ। ওর সঙ্গে গল্প করতে করতে এগিয়ে চলা। মাঝে আবার বৃষ্টির তেজ বাড়ল। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। ভালো ট্রেকিং-শু না পরলে এই পথে হাঁটা খুব দুষ্কর। যারা ভয়ংকরের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে অভয়ংকরের প্রসাদে পদে পদে বরাভয় লাভ করে তাদের ঈশ্বরবিশ্বাস পাকা হয়ে যায়।

১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম নাবিডাং। কেএমভিএন-এর কর্মী-ভাইরা শরবত তুলে দিলেন। একটু পরেই খাবারের ডাক পড়ে গেল। গরম গরম খিচুড়ি আর পাঁপড়ভাজা, যেন অমৃত। আজ রাতের খাবার সন্ধে ৬টায় দিয়ে দেবে। রাত ২টোয় যাত্রা শুরু হবে।

Navidang Base Camp
নাবিডাঙ বেস ক্যাম্প।

নাবিডাং থেকে ‘ওম’ পর্বতের দর্শন মেলে। পাহাড়ের চূড়ায় বরফে লেখা ওঁ। কপাল খারাপ। আবহাওয়া এত খারাপ যে কিছুই দেখা গেল না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমুচ্ছি। হঠাৎ অনেকের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। ভক্তের কাতর আহ্বানে ঈশ্বর অবশেষে করুণা করলেন। বাইরে এসে দেখি, মেঘ কেটে গিয়েছে। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে ওঁ। প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টিকে প্রণাম করলাম।

রাত ১২টায় ঘুম ভেঙে গেল। অঝরে বৃষ্টি পড়ছে। তাপমাত্রা ৪-৫ ডিগ্রি। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথায় হেডটর্চ লাগিয়ে, গায়ে চার সেট জামা চাপিয়ে, মাথায় ২টো টুপি পরে রওনা হলাম। তবু ঠান্ডা যেন কাটে না। এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে ছাতা নিয়ে গাইড গণেশকে অনুসরণ করে সন্তর্পণে এগিয়ে চললাম। আমাদের গন্তব্য ১২ কিমি দূরে ১৬৭৩০ ফুট উচ্চতায় লিপুলেখ পাস। গণেশ বার বার সতর্ক করে বললল – “স্যর, আপ পনি লিজিয়ে।” আজকের রাস্তা সব থেকে দুর্গম। আমি আবার দুর্গম পথ চলতেই বেশি ভালোবাসি। যে পথে রোমাঞ্চ নেই, সেই পথ আমায় টানে না। আমার ‘প্রভুর’ উপর অগাধ আস্থা। তিনি যদি কৃপা করেন, কোনো পথই আমার কাছে বাধা নয়।

‘ওঁ নমঃ শিবায়’ জপতে জপতে পাহাড়ের পাকদণ্ডি ধরে এগিয়ে চললাম। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, বিন্দু বিন্দু আলোকশিখা পিঁপড়ের মতো লাইন করে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলছে। ডান দিকে নদীর জলের শব্দ। হঠাৎ দেখি জহরভাই অন্ধকারে পথ বুঝতে না পেরে খাদের দিকে এগিয়ে চলেছে। আর এক ফুট দূরেই খাদ। সাক্ষাৎ মৃত্যু। হ্যাঁচকা টান দিয়ে জহরভাইকে আমার দিকে টেনে আনলাম। ঈশ্বরের অপার করুণায় এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়া গেল। এই ভাবে একটা পাহাড় থেকে আরেকটা পাহাড় পেরিয়ে চলেছি। গলা শুকিয়ে আসছে। সঙ্গে গরম জল ছিল। একটু খেয়ে তাজা হলাম।

way to Lipulekh Pass
লিপুলেখ পাস যাওয়ার পথ।

খাড়া পাহাড়ে শুধুই হেঁটে চলেছি। সামনে গণেশ, আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। রাতের পাহাড়ে চলার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। আজ এই রাতে আমি উপলব্ধি করলাম, মহারণ্যের নিজস্ব সংগীত আছে। অরণ্য-প্রকৃতির সোঁ সোঁ শব্দ ওঁকারে পরিণত হচ্ছে। অনেকক্ষণ পরে পর্বতের সানুদেশে এসে পৌঁছোলাম। পুবের আকাশ আলোকিত করে সূর্যদেব উঠছেন। সূর্যের প্রথম আলোয় পর্বতের চূড়াগুলি হিরের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ব্যাগ থেকে যে ক্যামেরা বার করব, সে ক্ষমতাও নেই। শুধুই প্রাণভরে দেখা। এই দেখার কোনো শেষ নেই। যত দেখছি, বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি। প্রকৃতির এই রূপের সন্ধানেই তো আসা। এই রূপে যারা একবার মজেছে, তারা ঘর-সংসার ফেলে বার বার ছুটে আসে।

গণেশের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। চার দিকে শুধু বরফ আর বরফ। তবে রাস্তার বরফ গলে গিয়েছে। না হলে এই পথে হাঁটতে আরও কষ্ট হত। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে লিপুলেখ পাস, ভারত-চিন সীমান্ত। সামনের রাস্তা আরও চড়াই। অনেকের অক্সিজেনের সমস্যা হচ্ছে। দু’ পা হাঁটছি, দাঁড়িয়ে পড়ছি। কিন্তু দাঁড়ালে চলবে না। গণেশ তাড়া দিচ্ছে। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে পা ধরে যাবে। ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরের তেজ কমে আসছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। গরম জল শেষ। পকেট থেকে চকোলেট বার করে মুখে দিলাম। এ ভাবেই শরীর আর মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে তিন কিমি চড়াই অতিক্রম করে পাহাড়ের চূড়ায় এসে পৌঁছোলাম।

আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৫/ নবী হয়ে ফের গুনজিতে

শরীরে আর শক্তি নেই। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর কাঁপছে। গণেশ আমাকে একটা পাথরের আড়ালে বসাল। কিছু খেজুর খেলাম। ধীরে ধীরে শরীরের বল ফিরে পেলাম। গণেশ এখান থেকে ফিরে যাবে। ও আবার ১৫ আগস্ট আসবে আমাদের এখান থেকে নিয়ে যেতে। এই দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় গণেশরাই ভরসা। এদের ছাড়া পাহাড়ে এক মুহূর্ত চলা যায় না। গণেশ কাল রাত থেকে আমাদের সঙ্গে হাঁটছে, কিছুই খায়নি। ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো খাবার গণেশকে দিলাম। ওর চোখে জল।

সকাল ৮টা। পাহাড়ের নীচে গাড়ি দেখা যাচ্ছে। ১১ নম্বর ব্যাচের যাত্রীরা উপরে উঠে আসছেন। সঙ্গে চিনা অফিসারেরা। ওঁরা এ পারে এলে আমরা ও পারে যাওয়ার অনুমতি পাব। ওঁরা উপরে উঠে আসতেই ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল লিপুলেখ। ওঁরা আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। চিনা অফিসারেরা আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। পাহাড়ের নীচে দু’টি গাড়ি অপেক্ষা করছে। গাড়িতে উঠতেই ফলের রস আর আপেল দিয়ে আমাদের স্বাগত জানানো হল। ফলের রস খেয়ে একটু বল ফিরে পেলাম। গাড়ি ছাড়ল। চললাম তাকলাকোট।

road to taklakot
তাকলাকোটের রাস্তা।

তিব্বতের এই ভূমির সঙ্গে আমাদের লে-লাদাখের খুব মিল। কোনো গাছপালা নেই। শুষ্ক মরুভূমি। বিস্তীর্ণ এই রুক্ষ প্রান্তরে শুধু মাটি আর পাথর। বড়ো বড়ো গাছ এনে রাস্তার দু’ পাশে বসানো হচ্ছে। সুন্দর, মসৃণ রাস্তা, কোথাও একটা গর্ত চোখে পড়ল না। তাকলাকোটে পৌঁছে আমাদের নিয়ে গাড়ি পৌঁছোল অভিবাসন দফতরে। সেখানে আমাদের পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে মুখের ছবি মেলানো হল। আমাদের পাঁচ আঙুলের ছাপ নেওয়া হল। চোখের মণির ছবি তুলে রাখা হল। এ বার আমাদের গন্তব্য কাস্টমস অফিসে। এখানে আমাদের মালপত্র পরীক্ষা করা হল। ক্যামেরা আর মোবাইলের সব ছবি দেখে নিলেন অফিসারেরা। সব নিয়নকানুন মিটিয়ে বেলা আড়াইটা নাগাদ হোটেলে এলাম। ঘরে ঢুকে গরম জলে স্নান করতেই সমস্ত ক্লান্তি উধাও। দুপুরে গরম গরম ভাত খেয়ে হোয়াটস অ্যাপে বাড়ির সঙ্গে কথা বললাম। চোখ জ্বালা করছে। হোটেল ঘরের সুন্দর বিছানায় শরীর ছুড়ে দিলাম। (চলবে)

ছবি: লেখক                          

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *