পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৮/ কৈলাস-দর্শনের সিংহদুয়ারে

সুব্রত গোস্বামী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১০ আগস্ট। আজ আমাদের কৈলাস পরিক্রমা শুরু হবে, নয় কিমি দূরের যমদুয়ার থেকে। ছোটো বাসে চেপে পৌঁছে গেলাম সেখানে। পুরাণে আছে, যমরাজ এখানেই নাকি খাতা খুলে বসে  থাকেন। আমাদের কৃতকর্ম ভালো হলে স্বর্গের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি মেলে। নচেৎ ফেরত যেতে হয় মনুষ্যজন্মে। ভাগ্যিস এখন যমরাজ নেই!

শুরু হল হাঁটা। ৪৮ কিমি দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা। আমাদের সঙ্গী হল পোর্টার প্রেমা। স্থানীয় ভাষা ছাড়া কিছুই বোঝে না। আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে হয় সব কিছু। রুকস্যাকটা প্রেমার হাতে তুলে দিয়েছি। প্রথমে যমদুয়ারের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে তাকে প্রদক্ষিণ করলাম। বিভিন্ন পশুর মাথার খুলি টাঙানো আছে যমদুয়ারে। এটা তিব্বতি রীতি। কৈলাস পর্বতকে ডান দিকে রেখে এগিয়ে চললাম ১৬৬০০ ফুট উঁচু দেরাফুকের উদ্দেশে।

যমদুয়ার।

ছোটো একটা নদীর পাড় ধরে এগিয়ে চলেছি। ডান দিকে বিশাল কৈলাস পর্বতমালা। ছবিতে আমরা শুধু এই পর্বতের চূড়াটুকুই দেখতে পাই। কিন্তু এর ব্যাপ্তি ৪৮ কিমি জুড়ে। আমরা সাধারণত কৈলাস পর্বতের দক্ষিণ দিকের রূপই ছবিতে দর্শন করি। এ বার সুযোগ হবে চার দিক থেকে দেখে এর অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার। দু’ পাশে বিশালাকার পর্বতশ্রেণি, তার মাঝখানের উপত্যকা ধরে আমরা চলেছি। এখানে দেখলাম তাঁবু খাটিয়ে কিছু অস্থায়ী হোটেল চলছে। নুডলস্‌ জাতীয় খাবার পাওয়া যায়। চাই-কি রাতে থাকাও যায়, মেঝেতে কাঠের ওপর ঘাস বিছিয়ে, গায়ে ঢাকা দেওয়ার কম্বলও মেলে।

বেশ কয়েকটা খরস্রোতা পাহাড়ি ঝরনা পার হতে হল। পোর্টাররা বোল্ডার ফেলে আমাদের হাত ধরে একে একে পার করালেন। ভিজে পাথরে পা রেখে চলতে গিয়ে বেশ কয়েক বার হড়কে যাওয়ার দশা হয়েছিল। কোনো রকমে সামলে নিয়েছি। এই পথের যেন কোনো শেষ নেই। আসলে এ হল তিব্বতি পথের নমুনা। অক্সিজেনের প্রচণ্ড অভাব। তাই দু’ কিমি পথ ভাঙলে মনে হয়, দশ কিমি পথ চলে এসেছি।

পরিক্রমার প্রস্তুতি।

যা-ই হোক, দু’ চোখ ভরে প্রকৃতির রূপ প্রত্যক্ষ করতে করতে ধীরে ধীরে চলেছি। চারি দিক নিস্তব্ধ। শুধু কানে আসছে ঘোড়ার গলায় বাঁধা ঘণ্টার আওয়াজ আর ছোটো নদীর কুলকুল করে বয়ে যাওয়ার শব্দ। নিস্তব্ধতারও যে একটা রূপ আছে, এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না। হঠাৎ দেখা পেলাম ব্রাউন হেডেড গাল-এর। এক দল ধূসর মাথাওয়ালা সাদা রঙের পাখির যেন তর সইছিল না  আমার ক্যামেরায় বন্দি হওয়ার। মনে হচ্ছিল, হাত বাড়ালেই ওরা ধরা দেবে।

ডুবে গিয়েছিলাম প্রকৃতির রূপে। প্রেমার গলার স্বরে হুঁশ এল। সামনে দেখি কৈলাস পর্বতের পশ্চিম দিকের মোহময় রূপ। সূর্যালোকে ঝকঝক করছে তুষারাবৃত কৈলাস। অনিন্দ্যসুন্দর এই রূপ দেখে মোহিত হয়ে গেলাম। এই কৈলাসেই রয়েছেন তিনি, যিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের কারণ। তাঁকে প্রণাম করি।

এই হল দেরাফুক, কৈলাস-দর্শনের সিংহদুয়ার। কৈলাসশিখরের দু’ পাশে দাঁড়িয়ে আছে দু’টি ছোটো পাদশৈল। তিব্বতিরা বলে, কাং রিনপোচের (কৈলাস) পাহারায় রয়েছেন বজ্রপাণি আর অবলোকিতেশ্বর। নদীর বাঁ দিকে একটি সুন্দর প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে, এর উলটো দিকেই আমাদের রাতের আস্তানা। প্রতি ঘরে চার জন করে থাকতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তবে সমস্যা একটাই। টয়লেট বাইরে। কিন্তু সেখানে জল নেই। যাই হোক, সব রকম অবস্থাই মানিয়ে নিতে হবে।

দেরাফুকে অতিথিনিবাস।

অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। রাত তিনটে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রাতঃকৃত্য সেরে রেডি হয়ে গেলাম। জলে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। যাই হোক, গরম বোর্নভিটা খেয়ে শরীর একটু গরম হল। হাতে লাঠি, মাথায় টর্চ লাগিয়ে প্রতিদিনের মতো শিবের নামগান করে যাত্রা শুরু হল। আজ চলেছি দোলমা পাসের উদ্দেশে। পরিক্রমা-পথে সব চেয়ে কঠিন যাত্রা। মনকে প্রস্তুত করেছি। মানসিক শক্তি ঠিক থাকলে কোনো পথই দুর্গম নয়। পরমেশ্বরের ইচ্ছায় যদি এত দূর হেঁটে আসতে পারি, তবে বাকি পথও এ ভাবেই চলে যাব।

সামনে আমাদের গাইড। তার মাথায় শক্তিশালী টর্চ। তাঁকে অনুসরণ করে পাহাড়ি রাস্তায় এগিয়ে চললাম। আশেপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধুই সোঁ সোঁ শব্দ। দু’ কিমি টানা চড়াই। অক্সিজেন যথেষ্ট কম। আমার সঙ্গে অক্সিজেনের ছোটো সিলিন্ডার রয়েছে। প্রয়োজনে ব্যবহার করব। যেতে যেতে এক সময় মনে হল পথ হারিয়ে ফেলেছি। অনেক কষ্টে হারানো পথ খুঁজে পেলাম। সবার মুখে শুধু ‘ওঁ নমঃ শিবায়’। এই ভাবে এক চড়াই অতিক্রম করে আর এক চড়াই। পথ ফুরোয় না।

পরিক্রমাপথে সাক্ষাৎ।

দু’ ঘণ্টা ধরে টানা হেঁটে চলার পর ধীরে ধীরে পুব আকাশে আলোর রেখা দেখা গেল। সূর্যদেব দেখা দিচ্ছেন। কৈলাসের চূড়ায় সূর্যের আলো। বিহ্বল চিত্তে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হল স্বর্গের কাছাকাছি কোনো স্বপ্নলোকে রয়েছি। কৈলাস রঙ বদলাচ্ছে। প্রথমে হালকা সোনালি, তার পর পুরো স্বর্ণ বর্ণ। আমি বিমোহিত। কৈলাস পর্বতের চূড়ায় প্রভূর প্রতিকৃতি, আমার দু’ চোখে জল। মনে মনে বলে উঠলাম –

ওঁ বন্দে দেবমুমাপতিং সুরগুরুং বন্দে জগৎ কারণং/বন্দে পন্নগভূষণং মৃগধরং বন্দে পশুনাং পতি।/বন্দে সূর্য শশাঙ্কবহ্নিনয়নং বন্দে মুকুন্দ প্রিয়ং/বন্দে ভক্তজনাশ্রয়ঞ্চ বরদং বন্দে শিবং শংকরম।। (হে স্বপ্রকাশ উমাপতি, তুমি দেবতাদেরও গুরু, তোমাকে বন্দনা করি। সর্পভূষণ মৃগধরকে বন্দনা করি। হে পশুপতি, তুমি চন্দ্র, সূর্য ও বহ্নিরূপ ত্রিনয়নধারী এবং মুকন্দপ্রিয়, তোমাকে বন্দনা করি্। ভক্তজনের আশ্রয়, বরদাতা হে মঙ্গলময় মহাদেব, তোমাকে বন্দনা করি।।)

আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৭/ মানসদর্শন

জহরভাইয়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে শুধুই ছবি তুলছি। পোর্টার প্রেমা তাড়া দিচ্ছে। দোলমা পাস অতিক্রম করতে হবে। সূর্য উঠলে বরফ গলতে শুরু করবে, পথ আরও বিপৎসংকুল হয়ে উঠবে। ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত কৈলাসকে পিছনে ফেলে মন যেতে চাইছে না। এই রূপ দেখার জন্যই তো এত কষ্ট করা। আমরা যারা হেঁটে এসেছি, তারাই কৈলাসের এই অপরূপ সৌন্দর্য দর্শনের সুযোগ পেলাম। যাঁরা ঘোড়ায় চড়ে আসছেন, তাঁরা এই রূপ দর্শনের সুযোগ পেলেন না। তাঁরা তো আমাদের চেয়ে দু’ ঘণ্টা পরে যাত্রা শুরু করেছেন। এই কাকভোরে, অন্ধকার থাকতে থাকতে যে সব যাত্রী কৈলাস পরিক্রমায় দোলমা পাসের দিকের এগিয়ে চলেন, প্রভু শুধু তাঁদেরই কাছে এই রূপে ধরা দেন। (চলবে)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *