পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৭/ মানসদর্শন

manas sarovar

সুব্রত গোস্বামী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৮ আগস্ট। প্রতি দিনের অভ্যাসমতো ঘুম ভাঙল ভোর ৫টায়। আমার ঘড়িতে ভোর ৫টা। আদতে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৭টা। তিব্বত তথা চিনা সময় আড়াই ঘণ্টা এগিয়ে। যা-ই হোক, ভোর ৫টা হোক বা সকাল সাড়ে ৭টা, সূর্যদেব কিন্তু তখনও ওঠেননি। বাইরে বেশ অন্ধকার। আরও আধ ঘণ্টা পর সূর্যোদয় হল। আমরাও একটু পরে ফ্রেশ হয়ে প্রাতরাশের টেবিলে মিলিত হলাম। মুখে কিন্তু ‘গুড মর্নিং’, ‘ওঁ নমঃ শিবায়’।

বেরিয়ে পড়লাম তাকলাকোট শহরটা দেখতে। সমুদ্রতল থেকে ১২৯৩০ ফুট উচ্চতায় এই শহর খুব বড়ো কিছু নয়। জনসংখ্যাও খুব কম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। আমাদের হোটেলের পাশেই বাজার। আছে বেশ কিছু রেস্তোরাঁও। এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ঘুরতে লাগলাম। তবে ভাষা একটা সমস্যা। কোনো জিনিসের দাম জানতে চাইলেই, দোকানি ক্যালকুলেটর দেখিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের হোটেলের পাশেই ৩ ইউয়ান (৩২ ভারতীয় টাকা, চিনা মুদ্রা ১ ইউয়ান ১০.৬ ভারতীয় টাকার সমান) দিয়ে অনেক কিছু পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে থেকে উপহারের জন্য বেশ কিছু স্মারক কিনলাম।

hotel in Taklakot
তাকলাকোটের হোটেল।

ফলের দোকানগুলো খুব সুন্দর। দাম একটু বেশিই মনে হল। যে আম কলকাতায় এখন ৫০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যাবে, তা-ই এখানে বিকোচ্ছে ২০০ টাকা কেজি। এখানে একটা ভারতীয় বাজারও আছে। তবে সেখানে যাওয়া হল না। ইচ্ছা ছিল কোনো রেস্তোরাঁয় চাইনিজ ফুড চেখে দেখব। কিন্তু ভাষা সমস্যার জন্য সেই ইচ্ছা পূরণ হল না। ফিরে এলাম হোটেলে। বাকি সময়টা ওয়াইফাই-এর মাধ্যমে বাড়ির সঙ্গে গল্প করে সময় কাটালাম।

প্রাতরাশ সেরেই গাড়িতে রওনা। আজ আমাদের গন্তব্য ১০২ কিমি দূরের দারচেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫৩২০ ফুট উঁচুতে, কৈলাস পর্বতের ঠিক নীচে ছোট্ট জনপদ। তিব্বতের মালভূমির উপর দিয়ে গাড়ি চলেছে। চারদিকে রুক্ষ পাহাড়। কিন্তু এই রুক্ষ পাহাড়েরই যে কত রূপ, চোখে না দেখলে বোঝানো যায় না। যেমন বিচিত্র সব ভাস্কর্য, তেমনই রঙের বাহার। ধূসর, সাদা, গেরুয়া, কালো…। কোথাও কোথাও সবুজও উঁকি মারছে। পেরিয়ে চলেছি পথ, রাস্তা খুব সুন্দর। আশেপাশের দৃশ্যে মগ্ন ছিলাম। সহযাত্রীদের চিৎকারে চমকে উঠলাম। এক সুন্দর সরোবর সামনে হাজির। মানস এসে গেল? না, আমার হিসেব বলছে মানস আসার কথা নয়। ভুল ভাঙিয়ে দিলেন গাইড – এটা রাক্ষসতাল তথা রাবণহ্রদ।

rakshastal
রাক্ষসতাল।

মনে পড়ে যায় পুরাণের কাহিনি। রাবণরাজা ছিলেন পরম শিবভক্ত। তাঁর প্রবল ইচ্ছা, কৈলাস-সহ শিবকে লঙ্কায় নিয়ে যাবেন। শুরু করলেন শিবের তপস্যা। ভক্তের তপস্যায় তুষ্ট ভগবান। বর দিতে চাইলেন। রাবণ তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন। বেগতিক বুঝে শিব তাঁর ইচ্ছা মঞ্জুর করলেন, কিন্তু জুড়ে দিলেন একটা শর্ত। সূর্যোদয়ের আগেই পৌঁছে যেতে হবে কৈলাসে। রাবণ রাজি। এ আর এমন কী শর্ত! কিন্তু কৈলাসে যাওয়ার পথে পথ হারিয়ে ফেললেন রাবণ। কিছুতেই কৈলাসে পৌঁছোতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে কৈলাস উৎপাটনের চেষ্টা করতে লাগলেন। পাহাড় টলতে লাগল, পাথর এ-দিক ও-দিক ছিটকে পড়তে লাগল। শিবের অনুচর-সহ কৈলাসের প্রাণীকুল ভয়ে অস্থির। এমনকি পার্বতীও আতঙ্কে শিবকে জড়িয়ে বসে থাকলেন। দেবাদিদেব শিব কিন্তু নির্বিকার। ডান পা বাঁ পায়ের ওপরে তুলে বসে আছেন। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিলেন। সমস্ত প্রলয় থেমে গেল। রাবণের সাধ্য কি আর কৈলাস টলায়! শিবের বুড়ো আঙুলের চাপে সৃষ্ট গর্ত রাবণের দেহের ঘামে ভরে গেল। কিন্তু ভক্তের সম্বল তপস্যা। আবার শিবের তপস্যা শুরু করলেন রাবণ। শিব তুষ্ট হয়ে বর দিলেন, এই হ্রদের নাম হবে তাঁর ভক্তের নামে। হ্রদের নাম হল রাবণহ্রদ।

অর্ধচন্দ্রাকার এই হ্রদের জল নোনতা। দেখতেও সাগরের মতো। বাতাসে ঢেউ উঠছে হ্রদের জলে, আছড়ে পড়ছে তীরে এসে। গাঢ় নীল জল। বেশ কিছু সময় এখানে কাটিয়ে ফের রওনা। দেখতে দেখতে চোখের আড়ালে চলে গেল রাক্ষসতাল।

আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৬/ লিপুলেখ দিয়ে তাকলাকোটে

বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর বাস পাকা রাস্তা ছেড়ে পাথরের রাস্তা ধরল। একটু পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমার স্বপ্নের মানস সরোবরে। মানসের মায়াবী নীল জল যেন আবাহন করছে অবগাহনের জন্য। সঙ্গে জামাকাপড় নেই। তাই মানসের জল মাথায় ছুঁয়ে তৃপ্ত হলাম, মুখে দিয়ে অমৃতের স্বাদ পেলাম। জল কোথাও হালকা নীল, তো কোথাও ঘন নীল, কোথাও আবার সবুজাভ। সূর্যের আলো পড়ে জল কোথাও কোথাও হিরের মতো চিকচিক করছে। একই অঙ্গে এত রূপ! স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তা এইখানেই। আমার ছোটো ক্যামেরার সাধ্য কী প্রকৃতির এই রূপ বন্দি করার!

দু’ চোখ ভরে দর্শন করে মনে মনে প্রভুর কাছে আত্মনিবেদন করে বললাম – আত্মা ত্বং গিরিজা মতিঃ সহচরাঃ প্রাণাঃ শরীরং গৃহং/পূজাতে বিষোয়পভোগরচনা নিদ্রা সমাধিস্থিতিঃ। সঞ্চারঃ পদয়োঃ প্রদক্ষিণবিধিঃ স্তোত্রাণি সর্বাগিরো/যদযৎ কর্ম করোমি তত্তদখিলং শম্ভো তবারাধনম।। (হে শম্ভু, তুমিই আমার আত্মা, দেবী পার্বতী আমার বুদ্ধি, আমার ইন্দ্রিয়গণ তোমার দাস, আমার দেহ তোমার মন্দির, আমার বিষয় উপভোগ তোমার পূজা, তোমাতে সমাহিত হওয়াই আমার নিদ্রা, আমার পদসঞ্চারই তোমার প্রদক্ষিণবিধি, আমার বাকসমূহ তোমার স্তব, আমি যে কর্মই করি, তা সবই তোমার আরাধনা।)

darchen
দারচেন।

মানস সরোবর দেখে চললাম দারচেনের উদ্দেশে। বেলা ১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম দারচেনের অতিথিশালায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মহাদেবের আবাসস্থল কৈলাস পর্বত। মূলত তীর্থযাত্রীদের কথা ভেবেই এই জনপদের সৃষ্টি। এখানে বেশ ঠান্ডা। রাতের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নেমে যাবে।

বিকেলে মেঘ কেটে গেল। ঝকঝক করছে কৈলাস। করজোড়ে প্রণাম করলাম। কাল শুরু হবে কৈলাস পরিক্রমা। (চলবে)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *