পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৪/ ফুলের উপত্যকা ছাড়িয়ে বুধিতে

সুব্রত গোস্বামী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১ আগস্ট। ঘড়ির অ্যালার্মে ঘুম ভেঙে গেল। ভোর ৪টে। দুধ-কর্নফ্লেক্স খেয়ে ৫টা নাগাদ টাটা সুমোয় চেপে রওনা হলাম। আপাতত গন্তব্য ৫৬ কিমি দূরে নাজাং। সেখান থেকে শুরু হবে হাঁটা। কিছু দূর যাওয়ার পরেই বিপত্তি। ধসে বড়ো বড়ো পাথর পড়ে রাস্তা বন্ধ। রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য জেসিবি আছে, কিন্তু চালক নেই। অতএব অপেক্ষা। ঘণ্টাখানেক পরে চালক এলেন, রাস্তা পরিষ্কার করলেন। আবার যাত্রা শুরু হল। সকাল ৯টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম নাজাং।

প্রাতরাশ সারা হল। শুরু হল পায়ে চলা। এখানেই যোগ দিল আমাদের পোর্টার গণেশ। ২২ বছরের গণেশ আমার সন্তানের চেয়ে এক বছরের বড়ো। কলেজে পড়ে। এই সময়ে কৈলাস-মানসযাত্রায় পোর্টারের কাজ করে যা রোজগার করে তা দিয়ে কলেজে পড়ার খরচ চালায়।

নাজাং-এর পথে ধস।

প্রথমেই যে পাহাড়টা অতিক্রম করতে হবে, তা দেখেই তো আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। একদম খাড়া পাহাড়। অমরনাথ যাত্রায় পিসু টপের কথা মনে পড়ে গেল। পিসু টপে যাওয়ার তো তবু রাস্তা ছিল, কিন্তু এখানে তা-ও নেই। শুধুই পাথরের সিঁড়ি। পরমেশ্বরের চরণে প্রণাম জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। দেবাদিদেব মহেশ্বরের উদ্দেশে মনে মনে বললাম – তোমার দর্শনাকাঙ্ক্ষী হয়ে এই মহাপর্বতে উপস্থিত হয়েছি। তোমার দর্শনলাভের জন্যই এই দুঃসাহস দেখিয়েছি। আমি তোমার শরণাগত।

প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগল পাহাড়ের মাথায় উঠতে। তার পর চড়াই ভেঙে, উতরাই নেমে এগিয়ে চলা। এ পথে আবার আমাদের সঙ্গী হল কালী নদী। ভয়ংকর তার রূপ। এক বার পা পিছলে পড়ে গেলে আর খোঁজ পাওয়া যাবে না। গত বছর এই জায়গাতেই এক দম্পতি ছবি তুলতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে নদীতে পড়ে যান। তাঁদের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। নদীর এই রূপ টিভির পর্দায় দেখেছিলাম উত্তরাখণ্ড বিপর্যয়ের সময়। মনে হচ্ছে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। নদীর এই প্রলয়ঙ্করী রূপের জন্যই হয়তো নাম কালী।

কালী নদীকে ডান হাতে রেখে আমরা এগিয়ে চলেছি। দু’ পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। বর্ষার জল পেয়ে গাছপালা সব সবুজ। মনে হচ্ছে, আমরা আসব বলেই প্রকৃতি সবুজে সেজে বসে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সামনে পড়ল আবার একটা বিশাল পাহাড়। এটাও টপকাতে হবে। চড়তে হবে ৪৪৪৪টা সিঁড়ি। ভাবতেই পাচ্ছি না, অভয় দিল সন্তানসম গণেশ – “স্যর, শোচিয়ে মত, হম হ্যায় তো আপকে সাথ”।

হাঁটা শুরু করার পরে এই পাহাড়ই প্রথমে টপকাতে হয়।

গণেশকে দেখি আর আমার পুত্র ঋষভের কথা মনে পড়ে যায়। কিছু সমস্যা সৃষ্টি হলেই ও-ও বলে, “বাবা, চিন্তা কোরো না, আমি তো আছি”। ভোলানাথ বোধহয় এই যাত্রায় ঋষভকেই আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

গণেশের সঙ্গে গল্প করতে করতে কখন যে পাহাড় টপকে গেলাম, জানি না। পথে পড়ল মালপা গ্রাম। নামেই গ্রাম। আজ আর এর কোনো অস্তিত্ব নেই। ১৯৯৮-এর ১৭ আগস্ট এক বিধ্বংসী বন্যায় ২০০ জন কৈলাসযাত্রী-সহ গ্রামের প্রায় সব মানুষ জলের তোড়ে ভেসে যায়। অধিকাংশকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী প্রতিমা বেদীও ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। আমরা ওঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।

রাস্তায় পড়ল এক বিশাল ঝরনা, দুধ-সাদা জল। নাচতে নাচতে সেই জল নীচে নেমে আসছে। আমাদের এই হাঁটাপথে রয়েছে প্রচুর ঝরনা। কোনোটা প্রচণ্ড গতিতে ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে, আবার কোনো কোনোটা পাহাড়ের গা বেয়ে তিরতির করে নেমে আসছে। ঝরনার জলকণা উড়ে এসে আমাদের একপ্রস্ত স্নান করিয়ে দিচ্ছে। সূর্যের আলোকছটায় সেই শত সহস্র জলকণা হিরের মতো চকচক করছে। ঋষভ থাকলেই ছবি তুলতে যেত। কিন্তু প্রকৃতির এই রঙিন ছবি কোন ক্যামেরায় ধরা দেবে? এ ছবি শুধু মনের ক্যামেরাতেই বন্দি করা যায়। এখানে দরকার গোপরো ক্যামেরা, যে ক্যামেরায় জলের মধ্যেও ছবি তোলা যায়। আমার সঙ্গে যে ক্যামেরা আছে, তাতে এ ছবি তোলা সম্ভব নয়। ক্যামেরা বার করলেই তাতে জল ঢুকে যাওয়ার তীব্র সম্ভাবনা।

অসংখ্য ঝরনার একটি।

ঝরনার জল পাহাড় থেকে তীব্র গতিতে নেমে এসে আমাদের পথ ভাসিয়ে দিয়ে নীচে কালী নদীতে মিশছে। কী ভাবে পেরোব এই পথ! জুতো বাঁচাতে গেলে একদম রাস্তার ধার দিয়ে যেতে হবে। কোনো ভাবে পা পিছলে গেলেই সোজা নীচে কালী নদীতে। তাই জুতোর মায়া ত্যাগ করে জল ভেঙেই এগিয়ে চললাম। এই জায়গাটুকু পার করার জন্য দড়ির ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। বয়স্ক যাত্রীরা পোর্টারের হাত ধরে কোনো রকমে পার হলেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চলা। আজ আমাদের ১৯ কিমি পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রথম দিনেই অগ্নিপরীক্ষা।

পথে পড়ল ফুলের উপত্যকা। কত বাহারি ফুল, বিচিত্র সব রং। কোনো শিল্পী যেন রং-তুলি দিয়ে ক্যানভাসে ছবি এঁকেছেন। প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টি দেখতে দেখতে আমার ক্লান্তি যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল। আমি সম্মোহিত হয়ে গেলাম। ফুলের এই বাগিচা দেখে মনে পড়ে গেল গাড়োয়ালের ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এর কথা।

এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া হাত বুলিয়ে গেল চোখে, মুখে। বৃষ্টি নামল। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতেই হাঁটছি। একটু পরেই বৃষ্টি নামল তার সবটুকু নিয়ে। পথ ভাসিয়ে, মন ভিজিয়ে তার নিজের মতো করে। চায়ের ছোটো ঝুপড়ি থাকলে তাতে আশ্রয় নেওয়া যেত। কিন্তু বিধি বাম। তাই রেনকোট আর ছাতাই ভরসা। চলল অঝোর ধারা, প্রায় আধ ঘণ্টা। অবশেষে সে বিরাম নিল। কিন্তু আকাশের মুখ এখনও ভার। কালী নদীর ও পারে পাহাড়ের দেওয়াল বেয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঝরনা পাইন-ফার-দেবদারু সমন্বিত সবুজ জংলা শাড়ির ঘোমটার ফাঁকে যেন এক রুপালি টিকলির ঝলক। সেই সবুজের ফাঁকে ভেসে থাকা কালচে মেঘ গ্রামবাংলার তন্বী মেয়েটার কাজলকালো চোখের কথা মনে করিয়ে দেয়।

ফুলের উপত্যকা।

বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গাঢ় বেগুনি রঙের ঘণ্টা ফুল তথা বেলফ্লাওয়ার, তাদের ওপরে মাথা তুলে রয়েছে হেরাক্লিয়াম, তাদের মাঝে অসংখ্য জেনসিয়ানা, পোটেনটিলা, প্রিমুলা…আরও কত কী! শুধু ফুল আর ফুল। আমার চলার পথ ফুলে ঢাকা। প্রতি পদক্ষেপেই আমাকে থামতে হচ্ছে। কী অপরূপ এই সৃষ্টি। আমি ভাষাহীন। কে যেন কানে কানে বলে গেল – এত দেরিতে এলে বন্ধু। কী অদ্ভুত এক অনুভূতি। আমার দু’ চোখে জল – এ আনন্দাশ্রু। কোথায় যেন আমি হারিয়ে যাচ্ছি। পাথরের আড়াল থেকে একটা নীল ফুল উঁকি দিচ্ছে – নীল পপি। আমি পরম স্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আমার স্নেহ পেয়ে খুশিতে সে হেলে পড়ল।

আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৩/ পৌঁছে গেলাম ধারচুলা

মাঝে দুপুরবেলায় খাবারের জন্য খানিক বিরতি। তার পর আবার পথ চলা। বেলা পড়ে আসছে। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় হিমালয় উদ্ভাসিত। এই রঙিন হিমালয়ের অমোঘ টানেই তো ছুটে আসা এখানে। ঘড়িতে বিকেল ৫টা। দূরে দেখা গেল বুধির কেএমভিএন অতিথিশালা। এক ঝলক খুশির হাওয়া বয়ে গেল। যাক অবশেষে বুধি দেখা যাচ্ছে। শরীর আর চলছে না। জহরভাই, সুরজভাইদের দেখতে পাচ্ছি না। ওরা বোধহয় একটু পিছিয়ে পড়েছে।

পৌঁছে গেলাম বুধি। অতিথিশালার এক কর্মী শরবত দিয়ে স্বাগত জানাল। ধড়ে যেন প্রাণ এল। ঘরে ঢুকে গরম জলে হাত-পা ধুয়ে সাদা বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ওঠার আর শক্তি নেই। জহরভাই রাতের খাবার নিয়ে এল। কোনো রকমে খেয়েই আবার ঘুম। কাল যে আবার খুব ভোরে উঠতে হবে। (চলবে)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *