পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ১১/ ফেরার পথে গুনজি হয়ে বুধি

Mount Kailas from Manas

সুব্রত গোস্বামী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কাল প্রায় সারা রাত জেগে কেটেছে। চোখ জ্বালা করছে। কিন্তু যে দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছি, তাতে মনে অপার শান্তি। অতিথিশালায় ফিরে এসে বাকি সময়টা বসে বসেই কাটিয়ে দিয়েছি। আজ মানসকে বিদায় জানানোর পালা।

আরেক বার গেলাম মানসের পাড়ে। দূরে উজ্জ্বল কৈলাস পর্বত। ভোররাতের ঘটনার কথা ভেবে এখনও লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। বৌদ্ধমন্দির থেকে ভেসে আসছে ‘ওম মণি পদ্মে হুম’-এর সুর। ভেসে আসছে ড্রামের আওয়াজ। মন কিছুতেই চাইছে না এই জায়গা ছেড়ে যেতে। বাসের হর্ন শোনা যাচ্ছে। শেষ বারের মতো মানসের জল মুখে নিয়ে, পরমেশ্বরের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে ছুটলাম বাসের দিকে। বাসের যাত্রীরা সবাই শিবের ভজন গাইছে। বাস এগিয়ে চলল আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আমার স্বপ্নের মানস-কৈলাস। আমার দু’ চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। কে যেন কানে কানে বলছে – আবার আসিস।

আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ১০/ সেই জ্যোতিদর্শন

কখন যে তাকলাকোট পৌঁছে গিয়েছি, খেয়াল করিনি। হোটেলে ফিরেও হোয়াটস অ্যাপে বাড়ির সঙ্গে কথা বললাম। কত দিন পর প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা হল। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে শহরটা ঘুরে এলাম।

খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। আজ ১৫ আগস্ট। এই পুণ্য দিনে ফিরে চলেছি ভারতে। তাড়াতাড়িই হয়ে গেলাম। ৯টা নাগাদ আমাদের নিয়ে যাওয়া হল চিনা অভিবাসন দফতরে। তার পর কাস্টমস অফিসে। আমাদের মালপত্র পরীক্ষার পর তিব্বত তথা চিন ত্যাগের অনুমতি পেলাম। আধ ঘণ্টার মধ্যে বাসে করে চলে এলাম লিপুলেখ পাস সংলগ্ন ভারত-চিন সীমান্তে। চিনা অফিসারেরা আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করলেন। মিলল পাহাড়ে চড়ার অনুমতি। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি ১৫ নম্বর ব্যাচের যাত্রীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।

Manas Sarovar
আরেক বার মানস দর্শন।

গণেশ যথারীতি চলে এসেছে। ওর কাছে আমার রুকস্যাক দিয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম। ১৫ নম্বর ব্যাচের যাত্রীরা আমাদের দেখে ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি দিতে লাগলেন। আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। আজ স্বাধীনতা দিবস। তাই মহাদেবের পাশাপাশি ভারতমাতার নামেও জয়ধ্বনি হল।

লিপুলেখ পাসের নীচেই আইটিবিপি-র ক্যাম্প। গরম কফি আর পকোড়া সহযোগে তারা আমাদের আপ্যায়ন করল। আইটিবিপি-র জওয়ানদের সঙ্গে ছবি তোলা হল।

আজ আমাদের গন্তব্য গুনজি, ২৬ কিমি। আসার সময় যে পথ তিন দিনে এসেছিলাম, সেই পথ এক দিনে পেরোব। একটু যে টেনশন হচ্ছে না, তা নয়। তবু হাঁটতে তো হবেই।

খুব জোরে হাঁটতে পারছি না। পথের সৌন্দর্যও সে ভাবে আকর্ষণ করছে না। কেবল কৈলাস-মানসের কথা মনে পড়ছে। মানস সরোবরে ভোররাতের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ যেন চোখের সামনে ভাসছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর একটা বিশাল ঝরনার কাছে চলে এলাম। গোটা পথকে প্লাবিত করে ঝরনা প্রবল বেগে নীচে নেমে যাচ্ছে। লাঠির সাহায্যে অতি সন্তর্পণে পথটুকু অতিক্রম করলাম। চলে এলাম নাভিডাং। এখানে সেনাশিবিরে স্বল্পক্ষণের যাত্রাবিরতি। দেখলাম জওয়ানরা জাতীয় পতাকা উত্তোলনে ব্যাস্ত। ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত। এখানে প্রাতরাশ সেরে আবার হাঁটা শুরু করলাম কালাপানির উদ্দেশে।

কিছুটা হাঁটার পর বুঝতে পারছি, বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রামের প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পাথরের উপর বসে রইলাম। শ্বাসপ্রশ্বাস অনেকটা মসৃণ হল, বেশ আরাম লাগছে। আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু চলার ক্ষমতা যে বেশ কমছে, বুঝতে পারছি। বাঁ পায়ের হাঁটুতে একটা ব্যথা টের পাচ্ছি। জহরভাইয়েরও একই সমস্যা হয়েছিল। আমার দেওয়া ওষুধ খেয়ে কিছুটা সামলেছে। সমতলে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু চড়াই-উতরাই এলেই সমস্যা।

A monastery
মানস থেকে ফেরার পথে মন্যাস্টেরি।

পথের দু’ পাশে সুউচ্চ পর্বতমালা। তার মধ্যের উপত্যকা দিয়ে একটি নদী বয়ে চলেছে। সেই নদীকে ডান হাতে রেখে আমরা এগিয়ে চলেছি। মখমলের মতো সবুজ ঘাস আর গুল্ম দিয়ে মোড়া পুরো উপত্যকা। অসংখ্য রঙিন ফুল ফুটে রয়েছে। এ যেন এক স্বপ্নলোক। এ ভাবে ২-৩ ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা ১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কালাপানির অতিথিশালায়। দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা এখানেই। আমি দুপুরের খাবার না খেয়ে এগিয়ে চললাম। কালাপানিতে পাসপোর্টে সিল মারিয়ে আবার এগিয়ে চলা। পথেই আলাপ হল আইটিবিপি-র এক জওয়ানভাইয়ের সঙ্গে। উনি আমাদের হাতে চকোলেট তুলে দিলেন। বাড়িতে ওঁর ছোটো একটা ছেলে আছে। তার বিদেশি মুদ্রা জমানোর খুব শখ। আমি ওঁর হাতে ১০০ চিনা ইউয়ানের একটি নোট তুলে দিলাম। সারা পথ ওঁদের সুখ-দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম গুনজি ক্যাম্পে। এসেই দেখি মনীশভাই আমাদের জন্য জায়গা রেখে দিয়েছেন। গুনজি ক্যাম্পে আজ খুব ভিড়। ক্যাম্পের পাশেই পাহাড়ে মেলা বসেছে। দূরদূরান্ত থেকে গ্রামবাসী আসছেন। গুনজি আইটিবিপি ক্যাম্প রাতে আমাদের জন্য ডিনার পার্টির আয়োজন করেছে। অনেক দিন পর দেশের খাবার খেলাম। জওয়ানভাইদের আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে যায়।

ঘুম থেকে উঠতেই চার দিক থেকে ধসের খবর আসতে লাগল। পাহাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল রাতেও বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের রূপ বদলে যায়। ছোটো ছোটো পাহাড়ি ঝোরা বিশাল আকার ধারণ করে। এখানেও তাই। আজ গণেশ ছাড়াই পথ চলা শুরু হয়েছে। মেলার জন্য গণেশ একদিন গুনজিতে থেকে গেল। কাল সকালে বুধিতে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

গুনজি থেকে ছায়লেক পর্যন্ত রাস্তা সমতল। তার পর পাহাড়ি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে হবে। সেই পথটা খুব বিপজ্জনক। দু’-তিন ঘণ্টা একটানা হেঁটে চলেছি। ফুসফুস ক্রমশ হাপর হয়ে উঠছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। লজেন্স মুখে দিলাম। লজেন্সের মোড়ক বুকপকেটে রেখে দিলাম প্রকৃতির বুকে দূষণ এড়ানোর জন্য। কৈলাস পরিক্রমার সময় দেখেছিলাম জায়গায় জায়গায় ডাস্টবিন রাখা। আমাদের উত্তরাখণ্ডে সে সবের বালাই নেই।

gunji camp
গুনজি ক্যাম্প।

আরও কিছুটা এগোনোর পর জলপতনের গর্জন শোনা গেল। যতই এগোচ্ছি, গর্জন ক্রমশ বাড়ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সেই জায়গায় পৌঁছে গেলাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হুড়হুড় করে পড়ছে ঝরনার জল। যেন বিরাট তুলোর বস্তা। প্রচণ্ড গতিতে নেমে আসা সেই জল রাস্তা বাসিয়ে কালী নদীতে পড়ছে। ঝরনার জল সারা গা ভিজিয়ে দিল। তবে নিজেকে নিয়ে চিন্তা নয়, চিন্তা ক্যামেরাটা নিয়ে। ক্যামেরার ছবি আমার কাছে মহা মূল্যবান, আমার সারা জীবনের সম্পদ, আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। ক্যামেরা বাঁচিয়ে কোনো রকমে পেরিয়ে এলাম সেই জায়গা।

১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম ছায়লেকে। খাওয়ার জন্য সাময়িক বিরতি। আবার পথ চলা শুরু। এ বার নীচে নামার পালা। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে, পথ ভয়ংকর পিছল। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। পাহাড়ের বুকে আমি একা। ট্রেকিং-এ এ রকম হয়, কেউ যায় এগিয়ে, কেউ থাকে পিছিয়ে – যার যেমন চলার সামর্থ্য বা গতি।

পাহাড় থেকে নামতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বাঁ পায়ের হাঁটুর ব্যথা প্রচণ্ড বেড়েছে। কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। বাধ্য হয়ে ব্যথা কমানোর ওষুধ খেলাম। অনেক নীচে বুধির ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যেই বৃষ্টির তেজ প্রচণ্ড বাড়ল। এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে লাঠি নিয়ে, পা টিপে টিপে পরমেশ্বরের নাম করতে করতে এগিয়ে চললাম ক্যাম্পের দিকে।

ঈশ্বরকে মনেপ্রাণে ডাকছি – আর একটা দিন তুমি শক্তি দাও, এতটা রাস্তা যদি হেঁটে আসতে পারি, তা হলে শেষ বেলায় কেন এত পরীক্ষা নিচ্ছ? তোমার কৃপা না থাকলে এতটা পথ আসতে পারতাম না। হাঁটুতে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ব্যথা কমানোর মলম স্প্রে করলাম। একটু যেন স্বস্তি এল। ধীরে ধীরে নেমে চললাম। পৌঁছে গেলাম বুধি। কেএমভিএন-এর যথারীতি শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের স্বাগত জানাতে। (চলবে)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *