পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ১০/ সেই জ্যোতিদর্শন

Mount Kailas from Qugu

সুব্রত গোস্বামী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কিউগুতে। মানসের তীরে এই জনপদ। সরোবরের নীল জলরাশি সূর্যের আলোয় হিরের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শত সহস্র জলকণা সূর্যের আলোয় তারার মতো জ্বলজ্বল করছে। দূরে দেখা যাচ্ছে কৈলাস পর্বত। সরোবর সংলগ্ন এক অতিথিশালায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের ঘরের জানলা দিয়ে হাত বাড়ালেই যেন মানসের জলের স্পর্শ পাওয়া যাবে। ঘরে ঢুকেই সবাই বেরিয়ে গেলাম। ছুটলাম মানসের জলে অবগাহন করতে। হিমশীতল জল। বাইরের তাপমাত্রা ৭-৮ ডিগ্রির কাছাকাছি, সঙ্গে প্রবল হাওয়া। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো বাধাই আর বাধা নয়। মানস সরোবর যেন দু’ হাত বাড়িয়ে আমাদের ডাকছে। এই সেই মানস সরোবর। স্বয়ং দেবাদিদেব যেখানে অবগাহন করেন।

আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৯/ পরিক্রমা অন্তে হোর-এ

মানস সরোবরের জলে নেমে স্নান করার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। বালতি করে জল তুলে এনে স্নান করতে হয়। কিন্তু কে মানে সেই বিধিনিষেধ! মানসের জলে নেমে সবাই আনন্দে আত্মহারা। ‘হর হর মহাদেব’ আওয়াজে মুখরিত চারিদিক। মানসের জল আর চোখের অশ্রু মিলেমিশে তখন সব একাকার। মানসের জল তো শুধু জল নয়, এর মধ্যে আছে ঈশ্বরের ছোঁয়া। এ আমার কাছে চরণামৃত। সরোবরের জলে অবগাহন করতে করতে বললাম –

করচরণকৃতং বাক্কায়জং কর্মজং বা শ্রবণনয়নজং বা মানসং বাহপরাধম।/বিহিতমবিহিতং বা সর্বমেতত ক্ষমস্ব জয় জয় করুণাব্ধে শ্রীমহাদেব শম্ভো।। (হে প্রভু, আমার এই জন্মে হস্তপদের দ্বারা কৃত অপরাধ, বাক্যজ, শরীরজ, কর্মজ, শ্রবণজ, নয়নজ কিংবা মানস অপরাধ, সঞ্চিত কিংবা ভবিতব্য অপরাধ, সব ক্ষমা কোরো।)

সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। হে প্রভু, তুমি না থাকলে এই পুণ্যধামে আমার আসার সুযোগ হত না। কত বাধা, কত বিঘ্ন উপস্থিত হয়েছে। তুমি সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে আমাকে এই পুণ্যধামে নিয়ে এসেছ। এ তোমার অপার মহিমা। আমাকে তোমার চরণে স্থান দাও।

manas sarovar at qugu
কিউগুতে মানস সরোবর।

পিতৃপুরুষদের স্মরণ করার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হব, এ আশাও আমি করি না। যত দিন বাঁচব, পিতৃঋণ আমি সানন্দে বহন করতে চাই। এই বলে মানস সরোবরের জল নিয়ে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ শুরু করলাম। তর্পণ করার কোনো সামগ্রীই আমার কাছে ছিল না, সামান্য একটু তিল ছাড়া। সেই তিল হাতে নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে পিতৃদেবকে স্মরণ করে বললাম –

ওঁ পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপঃ/পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।

কতক্ষণ জলের মধ্যে ছিলাম জানি না, জহরভাইয়ের ডাকে হুঁশ এল – তাড়াতাড়ি চলুন স্যর, হোমযজ্ঞ যে শুরু হয়ে যাবে। মানসের জলে ডুব দিয়ে কিছু পাথর সংগ্রহ করে অতিথিশালার দিকে পা বাড়ালাম।

সরোবরের পাশেই যজ্ঞের স্থান। মুম্বইনিবাসী মুকেশভাই যজ্ঞ করার দায়িত্ব নিলেন। তাঁকে সাহায্য করলেন জহরভাই। যজ্ঞের সামনে বসে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ যেন এক আলাদা অনুভূতি। সবাই মিলে হোম-যজ্ঞে পরমেশ্বরের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। মুকেশভাই বেদির উপর মাথা ঠুকতে ঠুকতে অশ্রুসিক্ত নয়নে স্তব পাঠ করতে লাগলেন।

সব তীর্থযাত্রীর চোখে জল। আসলে এই চোখের জল তো শুধুমাত্র জল নয়, এ আনন্দাশ্রু – ঈশ্বরকে দেখার, ঈশ্বরকে কাছে পাওয়ার যে আনন্দ, তারই প্রকাশ। এই বিরল মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দি করলাম অতি দ্রুত।

Yagna by the side of Manas
মানসের ধারে যজ্ঞের আয়োজন।

যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর অতিথিশালায় ফিরে জানলার ধারে বসে রইলাম। মানস সরোবরের এই রূপ থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। নীল জলের অপর প্রান্তে কৈলাস পর্বত এখনও ঝকঝক করছে। কখন যে চোখ লেগে গিয়েছে, টের পাইনি। জহরভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। রাতের খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। ভোররাতে উঠতে হবে। শুনেছি, ভোররাতেই শিব-পার্বতী মানসের জলে অবগাহন করতে আসেন। চিত্রকল্পটা মনের মধ্যে আঁকতে আঁকতে কখন যে ঘুম এসে গেল!

১৩ আগস্ট। রাত ৩টের সময় সুরজভাইয়ের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, কয়েক জন যাত্রী মানসের পাড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাইরে এখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে। সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া। বাইরে এসে দেখি আমাদের বন্ধুরা সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছেন। সবার মুখে তখন ‘ওঁ নমঃ শিবায়’। ওই মন্ত্র ছাড়া কারও মুখে কোনো কথা নেই। ধীরে ধীরে পুব আকাশে সূর্যের উদয় হল। চারি দিক আলোকিত হয়ে উঠল। কিন্তু স্বপ্নপূরণ হল না। তাঁরা এলেন না। অতিথিশালায় ফিরে এলাম।

আজ আমাদের অখণ্ড অবসর। আজ শুধু মানসের চার পাশে ঘুরে বেড়ানো আর ছবি তোলা। অতিথিশালার সংলগ্ন গুম্ফায় গেলাম। চার দেওয়ালে বৌদ্ধের বাণী আর তৈলচিত্র। বুদ্ধের মূর্তির সামনে বসে এক উপাসক ড্রাম বাজাচ্ছেন। ড্রামের ডুম ডুম আওয়াজ আর ধূপের গন্ধ চারি দিকে স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বুদ্ধের মূর্তির সামনে আমিও বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম। লাউডস্পিকারে অতি মৃদু স্বরে ভেসে আসছে – বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি (আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম)/ধম্মং শরণং গচ্ছামি (আমি ধর্মের শরণ নিলাম)/ সংঘং শরণং গচ্ছামি (আমি সংঘের শরণ নিলাম)। জানতে পারলাম এই গুম্ফা ৩০০ বছরের পুরোনো। ভিতরের তৈলচিত্রগুলোও সেই সময়কার। অথচ এখনও কত উজ্জ্বল।

দুপুর হতেই দল বেঁধে চললাম স্নান করতে। কেউ নিয়ম মানছেন না। আশেপাশে কোনো পাহারাদার নেই দেখে সবাই ডুব দিতে জলে নেমে পড়ল। আমিও নেমে পড়লাম মানসের জলে। কাচের মতো স্বচ্ছ জল। সরোবরের অনেক গভীর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।

monastery by the side of Manas
মানসের ধারে গুম্ফা।

দুপুরের খাওয়ার পর মানসের জল আনতে ছুটলাম। বোতলে ভরলাম। কলকাতার অনেকেই মানসের জল আনতে বলেছেন। জানি না, এই জল শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছোবে কি না। ঘোড়ার পিঠে করে আমাদের মালপত্র যাবে নাজাং পর্যন্ত। সেখান থেকে ট্রাকে করে দিল্লি, তার পর ট্রেনে কলকাতা। তখনও জানতাম না ফেরার সময় আমাদের জন্য কী দুর্যোগ অপেক্ষা করছে।

রাতের খাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে দিল ঘড়ির অ্যালার্ম। হালকা বৃষ্টি পড়ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আকাশ মেঘলা থাকলে দৃশ্যমানতা কমে যায়। তবে কি আজও তাঁর দেখা পাব না? এক অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল। মানস সরোবরে আজই আমাদের শেষ রাত। কাল সকালেই আমরা রওনা দেব তাকলাকোটের উদ্দেশে। হাতে ছাতা নিয়ে মানসের জেটিতে গিয়ে বসলাম। বেশ কিছু যাত্রী অনেক আগে থেকেই অধীর আগ্রহে বসে আছেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। কৈলাসের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রভুকে ডেকে চলেছি।

ঠিক ৩.২৫ মিনিট। হঠাৎ দেখি মানসের জল স্থির হয়ে গেল। কৈলাস পর্বতের মাথায় একটা হলুদ আলো দপদপ করে জ্বলে উঠল। অনেকটা হ্যালোজেন আলোর মতো। সেই আলোর জ্যোতিতে মানস আলোকিত। আলোটা কৈলাস পর্বত থেকে নেমে এসে মানসের জলে ঘুরপাক খেতে লাগল। ৩০-৪০ সেকেন্ডের পর আলোটা জল থেকে উঠে কৈলাস পর্বতে মিলিয়ে গেল। উত্তেজনায় আমাদের শরীর কাঁপছে, আমরা মূক। কতক্ষণ যে এই ভাবে ছিলাম, জানি না। পাশের যাত্রীর ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনিতে সম্বিত ফিরে পেলাম। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। এ আমি কী দেখলাম! পরমেশ্বর অবশেষে আমাদের দেখা দিলেন। তা হলে কি সেই কাহিনি সত্যি? সত্যিই কি শিব-পার্বতী ভোররাতে মানসের জলে অবগাহন করতে আসেন?

এই অলৌকিক ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা বিজ্ঞান আজও দিতে পারেনি। কী ভাবে এই আলোর উৎপত্তি? কেনই বা সেই আলো এসে পড়ে মানসের জলে? আমার সারা শরীর শিহরিত। গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। সহযাত্রী জহরভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। দেখলাম জহরভাই আর সুরজভাই উত্তেজনায় কাঁপছে, মুখে শুধু ‘হর হর মহাদেব’। আমার দু’ চোখে জলের ধারা। পবিত্র মানসের জল মুখে-মাথায় দিলাম। পরমেশ্বরের এই রূপ দেখতেই তো এত কষ্ট করে, বাড়ি-ঘর-সংসার ফেলে এখানে ছুটে আসা। ধীরে ধীরে পুব আকাশে সূর্যদেব দেখা দিলেন। আমরা এখনও বিস্ময়ে বিমূঢ়। (চলবে)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *