তিন দিনের অজ্ঞাতবাস ১/ দারিংবাড়ির পথে

শম্ভু সেন

এই ভ্রমণ একটু পুরোনো, বছর পাঁচেক আগের, ২০১৫-এর মার্চের। তাতে কী? ঘরবন্দি মন যে স্মৃতি হাতড়ে ফিরে গেল সেই দিনগুলোয়।

কী দেখলাম, দার্জিলিং? চোখটা একটু ভালো করে কচলে নিলাম – না, দার্জলিং। দার্জলিং অটো স্ট্যান্ড – চৌমাথায় এক কোনায় একটা সাইনবোর্ডে জ্বল জ্বল করছে। ওই একই হল – দার্জিলিং আর দার্জলিং।  

বাহ! এ যে দেখি একই আধারে দার্জিলিং আর কাশ্মীর। অটো স্ট্যান্ডের সাইনবোর্ডে লেখা দার্জলিং আর লোকের মুখে আদরের ডাকনাম কাশ্মীর – ওড়িশার কাশ্মীর।

কোথাও যাওয়ার আগে সবাই মনে মনে একটা ছবি আঁকে সেই জায়গার। আমিও এঁকেছিলাম। বলতে দ্বিধা নেই, ছবিটা মিলল না। ভেবেছিলাম খুশবেড়ানোওয়ালাদের মহলে একটু একটু করে পরিচিত হয়ে উঠলেও এখনও খুব একটা জমজমাট নয় সে। ভুল ভাঙল চৌমাথায় এসে।

গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। একটা চৌমাথা। আমার ডান দিকে সেই রাস্তা, যে রাস্তা ডিঙিয়ে পৌঁছেছি এখানে। এই রাস্তাতেই বাজার, দোকানপাট, এক-আধটা খাওয়ার জায়গাও। আর হ্যাঁ, একটা হোটেলও। নামটি বেশ, হোটেল ইউটোপিয়া। বাঁ দিকের রাস্তায় এই লোকালয়ের ঘরসংসার। পিছনের রাস্তায় থানা, পঞ্চায়েত অফিস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদি। আর সামনের রাস্তাটা মেলার মাঠ ছুঁয়ে, বেশ কিছু ঢেউ দিয়ে, হিল ভিউ পয়েন্ট পাশে রেখে ছুটে গেছে কোন সুদূরের পানে!

দারিংবাড়ি চৌমাথা।

আটসকালে রওনা ভুবনেশ্বর থেকে। জাতীয় সড়ক পাঁচ ধরে দৌড়। কাছে-দূরে পাহাড়, কোনোটা উচ্চতায় মন্দ না। জাতীয় সড়কের ধারের পাহাড়গুলোর ভাবভঙ্গি এমন যেন ওরা পাহারা দিচ্ছে সড়ককে। মাথা নিচু করে সসম্ভ্রমে পেরিয়ে এলাম সেই সব পাহাড়। এই রাস্তায় গেছি মাসছয়েক আগেই। তাই ভাবখানা এমন যেন এ রাস্তা আমার কত কালের চেনা। পেরোলাম নিরাকারপুর, বরকুল থেকে পুরী গিয়েছিলাম তো এই নিরাকারপুর হয়েই। সে পথে চোখ মেলে দিলাম, যত দূর যায়। একটু পরেই পাখির স্বর্গ মংলাজোরি যাওয়ার দু’টো পথ বাঁ দিকে রেখে চলে এলাম বালুগাঁও। তার পরেই বানপুর – ভগবতী মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা চিনে নিতে অসুবিধা হল না। মিনিটপাঁচেক পরেই বরকুল। ছ’ মাস আগে ওড়িশা ভ্রমণে চিল্কার ধারে এই বরকুলে কাটিয়েছিলাম দু’টো রাত। তার পরেই ডান দিকে পড়ল নারায়ণী মন্দির যাওয়ার পথ। ৪-৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথটুকু নারায়ণী মন্দিরেই শেষ। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া এই পথ একটু একটু করে উঠেছে পাহাড়ে। নির্জনতাই এর রূপ। এ যাত্রায় আমরা সে পথের সওয়ার নই। এগিয়ে চলেছি। শুধু সালিয়া ড্যাম যাওয়ার সেই প্রায়-গ্রাম্য রাস্তাটা কখন পেরিয়ে গেছি, বুঝতে পারিনি।

ঘণ্টাদুয়েক পর খালিকোটে আমাদের অবনমন হল – আর জাতীয় সড়ক নয়, এ বার আমাদের মিতে হল রাজ্য সড়ক, যার গায়ে ‘৪০’ তকমা। খালিকোটের এই পথের বাঁ দিকে সবুজ পাহাড়ের টানা পর্দা, যেন ও-পারের দৃশ্যপটকে এ-পারের চোখের নাগালের বাইরে রেখে দিতে চায় সে। নির্মলঝরের টানে এ পথও চেনা। তবে এ বার সেই নির্মলঝরের উপর দূর থেকে চোখ বুলিয়ে এগিয়ে চলি আসকার দিকে।

পাহাড় আমাদের যাত্রাসঙ্গী, সব সময়েই রয়েছে সে। তবে এ পথে যেন খাপছাড়া, কেবল পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়। পথের বাঁ দিকে কিলোমিটার-ফলকে দেখলাম, পরবর্তী গঞ্জ ‘মথুরা’। বাহ, মথুরা! এ যাত্রায় মথুরা-ভ্রমণও হল তা হলে।

ঘণ্টা আড়াই হয়ে গেল আমাদের এই ছুটে চলা। ওয়াগন-আরের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে একটু হাত-পা ছাড়ালাম। জায়গাটার নাম কোডালা, বাজার দোকানপাট প্রচুর, বাস-আড্ডা ঘেরা জায়গায়। স্কুলবাড়িটিও বেশ বড়ো। সূর্য তত রাগী নয়। ভালোই লাগছিল হাঁটাহাঁটি করতে। কিন্তু দিব্যই তাড়া দিল। এখনও প্রায় আধা পথ বাকি। তাই বোতল-জল কিনে ফের চলা।

নির্মলঝরকে পাশে রেখে এগিয়ে চলা।

দিব্যর একটু পরিচয় দিয়ে দিই। এই ওয়াগন-আরের মালিক দিব্য। স্নাতক-শিক্ষিত দিব্য প্রায়ই পর্যটকদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভুবনেশ্বর থেকে। ওদের একটা পর্যটন পোর্টাল আছে, নাম ‘নেচারস অ্যালি’। ওড়িশার বিভিন্ন ‘অফবিট ডেস্টিনেশন’ প্রোমোট করার চেষ্টা করছে ওরা। তার জন্য দিব্য আমারও সাহায্য চায়।

যা-ই হোক, দিব্যর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পেরিয়ে এলাম কবি সূর্যনগর – গাড়ি ঘুরল ডান দিকে। ৪০ রাজ্য সড়ক আমাদের তুলে দিল ৪১ রাজ্য সড়কের হাতে। এ পথে সব চেয়ে বড় জায়গা আসকা, এখনও ১১ কিলোমিটার। দিব্য বলল, আসকায় মাছের খোঁজ করতে হবে। ইকো হোমের অনিলবাবু (অনিল সোয়েন) বলে দিয়েছেন। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে তো মাছ পাওয়া যায় না। তাই অতিথিদের যদি মাছ খাওয়ানো যায়। কিন্তু বেলা প্রায় ১২টায় মাছের বাজার খোলা থাকবে, এত বড়ো শহর আসকা নয়। ভালোই হল, দৈনন্দিন রুটিনের ব্যত্যয় হলে ক্ষতি কী?

৪১ রাজ্য সড়কের দায়িত্ব শেষ। আসকার পর আমাদের যাত্রা জাতীয় সড়ক ৫৯ ধরে। এই পথ আসছে ব্রহ্মপুর (গঞ্জাম) থেকে। যেতে যেতেই সঙ্গী পেয়ে গেলাম রুষিকুল্যাকে (ঋষিকুল্যা ওড়িয়ায় হয়েছে রুষিকুল্যা)। আমাদের পথের ডান দিকে। রাস্তা আর নদীর পাড়ের মাঝে একটা এক-দেড় ফুট উঁচু বাঁধের মতো। রুষিকুল্যা যেন কত কালের চেনা, এমন ভাবেই দেখছিলাম তাকে। না, চেনা হয়তো ছ’ মাসের, কিন্তু আলাপটা তো গভীরই হয়েছিল।

রুষিকুল্যার সঙ্গে আলাপ তারাতারিণীতে, এবং প্রথম দর্শনেই ভালোবাসা। ব্রহ্মপুর থেকে ৩২ কিলোমিটার উত্তরে তারাতারিণী, কুমারী পাহাড়ের শীর্ষে তারাতারিণী মন্দির। আর পাহাড় বেড় দিয়ে বয়ে গেছে রুষিকুল্যা, সাগরের কাছে ধরা দিতে। প্রথম চোটে হোটেল নিরুপমার বারান্দা থেকেই রুষিকুল্যার রূপে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আসলে গোটা পরিবেশটাই ছিল রুষিকুল্যার প্রেমে পড়ার মতো। ডান দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কুমারী পাহাড়। ঠাহর করলে তারাতারিণী মন্দির চোখে পড়ে। সামনেই রুষিকুল্যা তার রুপোলি-গেরুয়া আঁচল বিছিয়ে রেখেছে। যেন আমাদের কাছে ধরা দিতেই চায় সে। সূর্য পাটে নামতেই সে আড়াল নিয়েছে বটে, কিন্তু তার নিরন্তর চলার নূপুরধ্বনি আমাদের শুনিয়ে গেছে।

এখানে রুষিকুল্যার চেহারা, ভাবগতিক যেন অন্য রকম। গেরুয়া নয়, অঙ্গে তার সবুজ পাড়, আর একটু যেন চঞ্চলাও। আদতে পাহাড়িকন্যা তো। রুষিকুল্যার সঙ্গে ভাব করেছিলাম তার পাড়ে বসে। কিন্তু এখন আর বসার সময় নেই। ছুটে চলেছি। তাই বোধহয় অভিমানভরেই সে হারিয়ে গেল।

পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ।

চলে এলাম সুরাডা। যে পাহাড়গুলো এতক্ষণ ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, সেগুলোই এ বার ধরা দিতে লাগল আমাদের কাছে, নাকি আমরাই ওই পাহাড়গুলোর হাতে বন্দি হয়ে গেলাম। গজলবাড়িতে আমাদের একেবারে ঘিরে ফেলল, ‘যেতে নাহি দিব’। আমরাও পথ খুঁজে খুঁজে একটু একটু করে উঠতে লাগলাম।

পাহাড়গুলোর গায়ে লেপটে রয়েছে অসংখ্য গাছগাছালি। আর এই শেষ বসন্তে তাদের গায়ে ধরেছে নানা রং। লাল-সবুজেরই কত রূপ। দূর থেকে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে গাছের মাথা যেন ছাড়িয়ে গেছে পাহাড়ের মাথাকে। পাহাড়ের গা ধরে বেশ খানিকটা গিয়ে দেখা গেল, সামনে অন্য পাহাড়ের অবরোধ। টপকে যাওয়ার উপায় নেই। অগত্যা আগের পাহাড়কে আশ্রয় করেই বাঁক নিয়ে আরও উঠতে হল। এ ভাবেই খালি উঠে চলা। পাহাড়ের গায়ে গাছগুলো চাঁদোয়ার মতো তাদের ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। তাই প্রায় পুরো পথটাই ছায়াচ্ছন্ন। অদূরের বনানীতে ধোঁয়া কেন? দাবানলের সময় এল যে।

ইকো হোমের পথে।

পেরিয়ে এলেম…। না, অন্তবিহীন পথ নয়, ঘাট-পথ। পাহাড়শীর্ষে চলে এলাম। প্রায় সমতল ক্ষেত্র। দৃষ্টি আর অবরুদ্ধ হয় না পাহাড়ের দেওয়ালে। যে পাহাড়গুলো বন্দি করেছিল আমাদের, তারা আমাদের মুক্তি দিয়ে দূরে দূরে চলে গেল। কিন্তু দূরে থেকেই ঘিরে রাখল আমাদের। নজর রাখতে লাগল। বাড়িয়ে দিল বন্ধুত্বের হাত। জাতীয় সড়ক ৫৯ আমাদের পৌঁছে দিয়ে উধাও হয়ে গেল বালিগুডার পথে। আমরা এলাম দারিংবাড়ি। আপাতত তিন দিনের অজ্ঞাতবাসে। অজ্ঞাতবাসে, কারণ এখানকার ইকো হোমে যে মোবাইলের টাওয়ার মেলে না। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *